ইসলামি পরিভাষার প্রতি ভালোবাসা
‘আল্লাহ’ হচ্ছে মহান রাব্বুল আলামিনের জাত নাম। এর কোনো অনুবাদ হয় না। স্রষ্টা, সৃষ্টিকর্তা, প্রভু, বিধাতা, গড, ঈশ্বর, ভগবান কিংবা ক্রিয়েটর এমন কোনো শব্দই আল্লাহর সমান নয়। আল্লাহ আল্লাহই। এর কোনো প্রতিশব্দ নেই, হয় না। আল্লাহ সবভাষাতেই আল্লাহ। এর লিঙ্গান্তর কিংবা লিঙ্গভেদ নেই।
তার পরও দেখা যায়, অনেকেই আল্লাহ শব্দের পরিবর্তে স্রষ্টা, সৃষ্টিকর্তা, প্রভু, বিধাতা প্রভৃতি শব্দমালা লিখেন অথবা বলেন। তাদের যুক্তি, বাংলা আমাদের সমৃদ্ধ ভাষা। স্রষ্টার বহু প্রতিশব্দ থাকতে আমরা বিদেশি ভাষা আরবি কেন ব্যবহার করবো? তাদের এ যুক্তি অনেক সরল মানুষ সহজে গ্রহণও করেন। কিন্তু এর মধ্যে যে গভীর ষড়যন্ত্র রয়েছে, তা এসব সরলসোজা মুসলিমদের কে বোঝাবে? আপাতদৃষ্টিতে তাদের কথা যৌক্তিক মনে হলেও গভীরে গিয়ে ভাবলে ষড়যন্ত্রের ভয়াবহতা স্পষ্ট হবে সহজেই।
আল্লাহ শব্দটি এমনই নিরঙ্কুশ যে, এর কোনো পরিবর্তন, পরিবর্ধন নেই। সংযোজন ও বিয়োজন নেই। আরবি আল্লাহ শব্দের ‘আলিফ’ বর্ণটি একত্ববাদের প্রতীক। আল্লাহর প্রথম অক্ষর আলিফ বাদ দিলে হয় লিল্লাহ, দ্বিতীয় অক্ষর লাম বাদ দিলে হয় লাহু এবং তৃতীয় অক্ষর লাম তুলে দিলে থাকে হু। আল্লাহ শব্দের প্রতিটি বিচ্ছিন্ন অক্ষর বা হরফ দ্বারা মহান আল্লাহকে নির্দেশ করে। তাই ‘আল্লাহ’ এমনই একটি নিরবচ্ছিন্ন ও নিরঙ্কুশ শব্দ যার ক্ষয় নেই, ব্যয় নেই। চিরস্থির ও চিরস্থায়ী। অক্ষয় ও অব্যয় বলতে যা বোঝায়। আর কোনো শব্দ এমন নিরঙ্কুশ ও নিরবচ্ছিন্ন নয়।
দুর্ভাগ্যের বিষয় হলো, একশ্রেণির বুদ্ধিজীবী আল্লাহ, রাসুল, ইবাদত-বন্দেগি, নামাজ, রোজা, সালাম প্রভৃতি শব্দ মুখে উচ্চারণ করতে ভীষণভাবে আড়ষ্ট হন, লজ্জিতবোধ করেন। তাই এসব ইসলামি পরিভাষা তারা এড়িয়ে চলেন। এ কারণে দেখা যায়, অনেক অনুষ্ঠানে সালাম-কালাম উঠে গেছে। তারা অনুষ্ঠানের শুরুতে গুড মর্নিং, গুড ইভিনিং ও ওয়েলকাম ইত্যাদি সম্বোধন করে বক্তব্য শুরু করেন কিংবা সম্ভাষণ জানান। এই শ্রেণির লোকেরা আল্লাহ শব্দের পরিবর্তে স্রষ্টা, সৃষ্টিকর্তা, প্রভু, বিধাতা, ঈশ্বর প্রভৃতি বলতে বিশেষভাবে তৎপর। তারা আল্লাহ, রাসুল, পয়গম্বর, ইবাদত, রহমত প্রভৃতি শব্দমালায় ভিন্ন কিছুর ঈঙ্গিত খুঁজেন। তাই তারা এসব বরকতময় শব্দ এড়িয়ে চলেন। এমন আচরণ কোনোভাবেই কাম্য নয়।
তারা ভুলে গেছেন, এ দেশের সাধারণ মানুষের হৃদয়ে এমন কিছু শব্দ গেঁথে আছে, যা কেউ মুছে ফেলার হাজার চেষ্টা করলেও সম্ভব নয়। আর আল্লাহ, রাসুল, রহমত, বরকত, মাগফেরাত, সহি-সালামত, কুদরত, মসজিদ, ঈদগাহ এমন শব্দগুলো বাংলাভাষী মুসলিমদের কাছে বিদেশি নয়। এগুলো হাজার বছর ধরে এ দেশবাসীর নিজস্ব ভাষা হয়ে আছে। এসব শব্দের অর্থ কেউ বোঝেন না, এমন কেউ এ দেশে নেই। অথচ এগুলো খাঁটি বাংলাভাষার শব্দ নয়। এগুলোর বেশিরভাগই আরবি, দুয়েকটা ফারসিও। কিন্তু এদেশের অক্ষরজ্ঞানহীন মানুষও এগুলো বোঝেন, বুঝতে চান না কেবল আধুনিক শিক্ষিতরা।
আগেই বলা হয়েছে, আল্লাহ শব্দটি পৃথিবীর সবভাষাতেই আল্লাহ। এর কোনো অনুবাদ নেই, হয়ও না। যারা আল্লাহর অনুবাদ করে, তারা জ্ঞানপাপী; ষড়যন্ত্রকারী। উদ্দেশ্যমূলকভাবে তারা আল্লাহ শব্দের ভাষান্তর করতে চান। কিছুদিন আগে দেখা যায়, বায়তুল্লাহ তথা কাবা শরিফ থেকে টেলিভিশনে পবিত্র কোরআন এবং মসজিদে নববি থেকে হাদিস শরিফের অনুবাদ সম্প্রচারের সময় আল্লাহর অনুবাদ করা হয় ‘গড’ যা সঠিক নয়। এমন অবিবেচনাপ্রসূত কাজ ভবিষ্যতে মুসলিম মিল্লাতের জন্য আত্মঘাতী হয়ে দাঁড়াতে পারে। এখনই সতর্কতা দরকার।
‘আল্লাহু আকবার’ এর অর্থ ‘আল্লাহ সবার বড়।’ এটাই হচ্ছে ওই শ্রেণির লোকদের আপত্তির মূল বিষয়। কারণ, আল্লাহকে বড় স্বীকার করে নিলে যে আর কিছু থাকে না। প্রভু, স্রষ্টা, সৃষ্টিকর্তা, বিধাতা সবই শেষ হয়ে যায়। তারা বলতে চায়, সব প্রভু আর আল্লাহ সমান (নাউজুবিল্লাহ)। কিন্তু আল্লাহর সমকক্ষ কোনো কিছু নেই, এটাই তারা মানতে চান না। সমস্যার সূচনা এখানেই।
এখানে স্পষ্টভাবে একটি কথা মনে রাখা দরকার, আল্লাহ, রাসুল, রহমত, বরকত, সালাম, কালাম এসব শব্দ মুসলমানদের প্রিয় পরিভাষা। এসব পরিভাষা যারা ভুলিয়ে দিতে চান, তারা মুসলমানদের বন্ধু নন; তিনি যে পরিচয়ের লোকই হোন না কেন।
আসলে মুসলমানরা নিজেদের আসল পরিচয় ভুলতে বসেছে। তাই কথিত আধুনিকতার নামে অস্তিত্বহারা হতে চলেছে তারা। এ কারণে, অন্যের কাছ থেকে ধার নিয়ে সভ্য সাজতে হচ্ছে। এ যে মুসলমানদের আত্মবিনাশের পথ- তা কে বোঝাবে?