বেহেস্তি আবহে হাজরে আসওয়াদ
রহমতের বারিধারা বেষ্ঠিত চতুষ্কোণ বিশিষ্ট পবিত্র কাবাগৃহ তাওয়াফ শুরু করার সময় প্রাণস্পন্দন বেড়ে যায় হাজরে আসওয়াদকে ঘিরে। সমবেত জনতার স্রোতের ভেতর থেকে আস্তে আস্তে কাছে চলে আসি। একজন প্রহরী অনন্য ভালোবাসায় আরও কাছে আসার সুযোগ করে দেন। এমন সহজে সেখানে পৌঁছতে পেরে মহান মাবুদের কাছে কায়মনো বাক্যে কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করি। হাজরে আসওয়াদে চুমু খেয়ে অন্তরাত্মায় জাগরিত হয় বেহেস্তি আবহ, অফূরান প্রশান্তি।
হাজরে আসওয়াদ বেহেস্তের মর্যাদাপূর্ণ একটি পাথর। কাবা ঘরের দক্ষিণ-পূর্ব কোণে মাতাফের দেড় মিটার উঁচুতে অবস্থিত। দেয়ালের ভেতরে পোঁতা কালো থালার মতো গোল পাথর। একটি রূপার ফ্রেমে আটকানো। দৈর্ঘ্য প্রায় ৮ ইঞ্চি ও প্রস্থ ৭ ইঞ্চি। সারা বিশ্বের ধর্মপ্রাণ মুসলমান নর-নারী গোনাহ মাফের জন্য মক্কায় এসে তাওয়াফের সময় হাজরে আসওয়াদে চুম্বনে সচেষ্ট হন।
এই জান্নাতি পাথর পৃথিবীর প্রথম প্রভাত থেকে মক্কা নগরীতে রয়েছে। হযরত আদম ও হাওয়াকে বেহেস্ত থেকে দুনিয়ায় প্রেরণের সময় এই পাথরও প্রেরিত হয় বলে মনে করা হয়। এটি একটি উল্কার মত বিষয় কিনা তা নিয়ে বিজ্ঞানীদের মধ্যে গবেষণা অব্যাহত আছে।
হাদিস শরীফে হাজরে আসওয়াদকে বেহেস্তি পাথর বলা হয়েছে। এ সম্পর্কে নবী করিম (সা.) বলেছেন, রোকনে আসওয়াদ অর্থাৎ হাজরে আসওয়াদ ও মাকামে ইব্রাহিম বেহেস্তের দুটো ইয়াকুত পাথর (জামে তিরমিজ)। রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসসালাম আরও বলেছেন, হাজরে আসওয়াদ একটি জান্নাতি পাথর, তার রং দুধের চেয়ে বেশি সাদা ছিল। বনি আদমের পাপরাশি এটিকে কালো বানিয়ে দিয়েছে (মুসনাদে আহমাদ)। অন্য হাদিসে রয়েছে, হাজরে আসওয়াদ জান্নাতেরই একটি অংশ (ইবনে খুজায়মা)।
কাবাগৃহ তাওয়াফ ও প্রদক্ষিণের সময় হাজরে আসওয়াদ স্পর্শ করা ও চুম্বন করা সুন্নত। তাওয়াফ কারীদের লাইনে দাঁড় করিয়ে শৃংঙ্খলাবদ্ধ করেন একদল প্রহরী। সার্বক্ষণিক ভাবে সেখানে রক্ষী মোতায়েন রয়েছেন। সমবেত জনতার দিকে নজর রাখেন তারা। নিবিড়ভাবে পর্যবেক্ষণ করেন সবকিছু। সঠিকভাবে চুম্বন দেওয়ার নিয়ম দেখিয়ে দেন। হাজরে আসওয়াদে চুম্বন করার জন্য সবাই হুমড়ি খেয়ে পড়েন। চুম্বনরতদের সামাল দিতে মাঝে মধ্যে হিমশিম খেতে হয়। যদি চুমো দেওয়া সম্ভব না হয় তাহলে হাত ইশারা করে তাওয়াফ শুরু করা যায়।
রাসুল (সা.) ৬০৫ সালে হাজরে আসওয়াদ কাবার দেয়ালে স্থাপন করেছিলেন। কাবা ঘর পুনর্নির্মাণের সময় হাজরে আসওয়াদকে আগের জায়গায় কে বসাবেন- এ নিয়ে কুরাইশদের মধ্যে তখন দ্বন্দ্ব বেধেছিল। মহানবী হযরত মুহাম্মদ (সা.) নিজের গায়ের চাদর খুলে তাতে হাজরে আসওয়াদ রেখে সব গোত্র প্রধানকে তা ধরতে বলেন। সকলে চাদরটি ধরে কাবা চত্বর পর্যন্ত নিয়ে গেলে নবী করিম (সা.) নিজ হাতে তা কাবার দেয়ালে স্থাপন করে দ্বন্দ্বের পরিসমাপ্তি ঘটান।
পবিত্র কোরআনে সূরা আল ইমরানের ৯৬ নম্বর আয়াতে কাবা ঘরকে মানবজাতির সর্ব প্রথম ঘর (উপাসনালয়) বলে উল্লেখ করা হয়েছে। সূরা হজের ২৬ নম্বর আয়াতে বলা হয়েছে, আর স্মরণ কর, যখন আমি (আল্লাহ) ইব্রাহিমের জন্য কাবা শরীফের জায়গা ঠিক করে দিয়েছিলাম, (তখন) আমি বলেছিলাম আমার সঙ্গে কোনো শরিক করিও না এবং আমার ঘরকে পবিত্র রেখ তাদের জন্য যারা তাওয়াফ করে এবং যারা নামাজে দাঁড়ায় রুকু ও সেজদা করে। হাদিস মতে, পবিত্র কাবায় এক রাকাত নামাজ অন্যত্র এক লাখ রাকাত নামাজের সমান(বুখারি)।
মহাগ্রন্থ আল-কোরআনে সূরা মায়িদার ৯৭ নং আয়াতে ‘বাইতুল হারাম’ (পবিত্র ঘর), সূরা বাকারার ১২৫ নং আয়াতে ‘আল বাইত’ (বিশেষ ঘর) এবং সূরা হজের ২৬ নং আয়াতে ‘বাইতিয়া’ (আমার অর্থাৎ আল্লাহর ঘর) ও ২৯ নং আয়াতে ’বাইতিল আতিক’ (প্রাচীন ঘর) নামে উল্লেখ করা হয়েছে। সূরা ইব্রাহিমের ৩৭ নং আয়াতে মহাপবিত্র এ স্থানকে ‘বাইতিকাল মুহাররামি’ (মহা পবিত্র ঘর) নামে সম্মানিত করা হয়েছে।
কুরআন সাক্ষ্য দেয়, দুনিয়ায় আদম সন্তানের জন্যে আল্লাহর ইবাদাতের জন্যে সর্বপ্রথম তৈরি করা হয়েছিল বায়তুল্লাহ। এটা সমগ্র বিশ্বের জন্যে কল্যাণ ও বরকতের উৎস ও হেদায়াতের কেন্দ্র। এ কাবা চত্বরেই রয়েছে বরকতময় জমজম কূপ। সাফা-মারওয়া পাহাড় এবং মাকামে ইব্রাহিম। পরবর্তী পর্বে ইনশাআল্লাহ সেগুলো আলোচনা হবে।
(চলবে, ‘ধূসর মরুর বুকে’ ডাইরি ১৯৮৫ থেকে)
লেখক: লন্ডন প্রবাসী। সাংবাদিক, কবি ও কথা সাহিত্যিক।