বাংলাদেশের প্রান্ত হতে সালাম জানাই হে রাসূল (সা.)
আজ থেকে ১৪৪৫ বছর আগে শান্তির দূত মহানবী হজরত মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের কল্যাণময় আবির্ভাব হয়েছিল এই পৃথিবীতে। তাঁর জন্ম ও ওফাতের স্মৃতি বিজড়িত রবিউল আউয়াল মাস। এই মাসের ১২ তারিখ তিনি জন্মগ্রহণ করেন, আবার তাঁর মোবারক জীবনের অবসানও হয় ১২ রবিউল আউয়াল তারিখে। তিনি আল্লাহতায়ালার প্রেরিত সর্বশেষ এবং সর্বশ্রেষ্ঠ নবী ও রাসূল।
প্রথম মানব হজরত আদম (আ.)-এর মাধ্যমে শুরু হওয়া নবুওয়তের সিলসিলা হজরত মুহাম্মদ (সা.)-কে দিয়ে পূর্ণতা পেয়েছে, পূর্ণতা পেয়েছে দ্বীন ইসলামও। পরিপূর্ণ হয়েছে আল্লাহতায়ালার হুকুম-আহকাম মানুষের মধ্যে পৌঁছে দেওয়ার দাওয়াতি মিশন।
এখন সে মিশনকে সামনে এগিয়ে নেওয়ার জন্য মানুষের সামনে রয়েছে দু’টি উপকরণ। একটি আল্লাহর কিতাব কোরআন অন্যটি রাসূল (সা.)-এর হাদিস তথা সুন্নাহ।
মানুষের ইহলৌকিক ও পারলৌকিক নাজাতের মাধ্যম হলো- কোরআন ও সুন্নাহ।
হজরত মুহাম্মদ (সা.)-এর আগমন ও তার শিক্ষার বদৌলতে বদলে যায় তৎকালীন পৃথিবীর নানাবিধ অনাচার ও কুপ্রথা।
মানুষ সন্ধান পায় এক আল্লাহর। ফলে আইয়ামে জাহেলিয়াতের ঘুমন্ত হৃদয়গুলো জেগে উঠে ঈমানের উষ্ণতায়।
তৎপর ও উদ্যমী মানবকূল দলে দলে বেরিয়ে পরে সিরাতুল মুস্তাকিমের অন্বেষণে।
তারপর বিরান ও অনাবাদ হৃদয়গুলোকে তিনি আবাদ করলেন আল্লাহতায়ালার প্রেমের মশাল জ্বেলে। বইয়ে দিলেন, জ্ঞান-বিজ্ঞান, সাহিত্য-সংস্কৃতি ও হিকমত-মারেফতের হাজারও সালসাবিল। নির্যাতিত মানুষের হৃদয়ে স্থাপন করলেন জুলুম-নিপীড়ন, অন্যায়-অবিচার এবং দুশমনি ও ষড়যন্ত্রের বিরুদ্ধে প্রতিবাদদীপ্ত এক প্রচণ্ড বিদ্রোহ ও আন্দোলন। নির্যাতিত, অবমানিত ও লাঞ্ছিত মানবতাকে শিক্ষা দিলেন সাম্য ও ভ্রাতৃত্ব এবং উপেক্ষিত, বিতাড়িত ও অসহায় মানবগোষ্ঠীকে টেনে নিলেন সেই বুকে, যে বুকে স্থান হয় কেবল প্রেম-মায়া-মমতা-ভালোবাসা-ত্যাগ-সৌহার্দ্য ও কল্যাণের।
এক সুমহান বৈপ্লবিক পরিবর্তন সমাজে ও মানুষের মননে সম্ভবপর করেছিলেন শান্তির দূত মহানবী হজরত মুহাম্মদ (সা.)। তিনি সূচনা করেছিলেন গৌরবদীপ্ত মানবিকতার এক নতুন যুগের। আল্লাহতায়ালার অসীম রহমতে নবী মুহাম্মদ (সা.)-এর নতুন যুগের আহ্বান স্থান-কাল-পাত্রের সীমাবদ্ধ গণ্ডিকে অতিক্রম করে বিশ্বজনীন হয়ে উঠেছিল।
আল্লাহতায়ালা পবিত্র কোরআনে এ প্রসঙ্গে ইরশাদ করেন, ‘আমি তো তোমাকে জগতসমূহের জন্য কেবল রহমতরূপেই প্রেরণ করেছি। ’-সূরা আম্বিয়া: ১০৭
বস্তুত আল্লাহতায়ালার অপার রহমতের নিদর্শন নিয়ে আগমন ঘটে শান্তির দূত হজরত মুহাম্মদ (সা.)-এর। তিনি সর্বযুগের সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ মানব। তিনি সর্বশ্রেষ্ঠ ও সর্বশেষ নবী এবং রাসূল। তিনি অসাধারণ গুণাবলীর অধিকারী। তিনি শুধু একজন ধর্ম প্রবর্তকই নন, মানব সমাজের জরাজীর্ণ ও ঘুণেধরা কাঠামোর সফল সংস্কার ও বৈপ্লবিক পরিবর্তনকারী। গোটা বিশ্বে বর্তমানে বিরাজমান অশান্তি, নৈরাজ্য, হানাহানি, সন্ত্রাস ও বিশৃঙ্খলার অবসানে শান্তির দূত নবী মুহাম্মদ (সা.) প্রবর্তিত আদর্শ ও শিক্ষা প্রকৃতভাবে পালন ও গ্রহণই মুক্তির একমাত্র উপায়। মানুষের ইহকালীন ও পরকালীন মুক্তি, কল্যাণ আর নাজাতও নিহিত রয়েছে নবী করিম (সা.)-এর সীরাত ও সুরতের মধ্যে, তাঁর সুন্নাহ ও আহলে বাইতের মাঝে।
প্রকৃতপক্ষে বর্তমান সময় ও আগামী যুগ সম্পূর্ণরূপে নবী মুহাম্মদ (সা.)-এর আবির্ভাব, তাঁর ব্যাপকভিত্তিক, সার্বজনীন ও চিরন্তন দাওয়াত, তাঁর মানবতাবাদী কল্যাণকামী চেষ্টা-সাধনা-ত্যাগ-তিতিক্ষার কাছে ভীষণভাবে ঋণী। তিনি নাঙা তলোয়ারের নিচ থেকে বিপন্ন মানবতাকে উদ্ধার করেছেন। অতঃপর মানবতার হাতে তুলে দিয়েছেন এক নতুন উপহার। যা মানবতাকে দান করেছে এক নতুন জীবন, নতুন জীবনবোধ, নতুন উদ্যম, নতুন শক্তি, নতুন প্রতীতী, নতুন সম্মান এবং নতুন করে পথচলার পাথেয়। আর সেই উপহারের বদৌলতে মানবতা শিল্প-সাহিত্য-সংস্কৃতি-সভ্যতা-কৃষ্টি-জ্ঞান-বিজ্ঞান-শিক্ষা-প্রযুক্তি সর্বোপরি ন্যায়নিষ্ঠা, আধ্যাত্মিকতা এবং চরিত্র ও সমাজ দর্শনের মাপকাঠিতে নতুন করে মানুষ গড়ার; সমাজ গড়ার কত হাজার মনজিল অতিক্রম করতে সক্ষম হয়েছে।
শান্তির দূত নবী মুহাম্মদ (সা.)-এর দিক-নির্দেশনা, সংশোধন ও সংস্কার প্রচেষ্টা, প্রণোদনা এবং পদক্ষেপের সফল পরিসমাপ্তিতে পৃথিবী ভরে উঠেছিল সোনালী মানুষে। পৃথিবীতে শুরু হয়েছিল স্বর্ণযুগ। আল্লাহতায়ালা কোরআনে কারিমে তাঁর মর্যাদা ও মাহাত্ম্য ঘোষণা করে বলেন, ‘আল্লাহর রাসূলের মধ্যে তোমাদের জন্য উত্তম আদর্শ রয়েছে; যারা আল্লাহর সাক্ষাৎ ও কিয়ামত দিবসের আশা রাখে এবং যারা আল্লাহকে অনেক স্মরণ করে। ’
আল্লাহতায়ালা নবী মুহাম্মদ (সা.)কে রিসালতের সম্পদ দ্বারা ধন্য করেছেন। তাঁকে আপন মাহবুব বানিয়েছেন এবং উত্তম আদর্শ ও মনোনয়নে মনোনীত করেছেন। তিনি বিলাসী ও আরাম-আয়েশের জীবন কেবল নিজের জন্যই অপছন্দ করতেন না, বরং তাঁর পরিবারের জন্যও এর পক্ষপাতী ছিলেন না। তিনি দোয়া করতেন, ‘হে আল্লাহ! মুহাম্মদের পরিবারবর্গের যতটুকু প্রয়োজন কেবল ততটুকু রিজিক দিও। ’
হাদিস থেকে জানা যায়, হজরত আবু হুরায়রা (রা.) বর্ণনা করেন, ‘শপথ সেই সত্তার, যার হাতে আবু হুরায়রার জীবন। আল্লাহর নবী ও তাঁর পরিবারবর্গ কখনও উপর্যুপরি তিন দিন গমের রুটি পেট ভরে খেতে পারেননি আর এ অবস্থায় তাঁরা দুনিয়া থেকে বিদায় নিয়ে গেছেন। ’
মহানবী হজরত মুহাম্মদ (সা.) যখন মক্কা বিজয় করেন এবং শেষ হজ আদায় করেন, তখন তার সামনে ছিল মুসলমানদের জনসমুদ্র, সমগ্র আরব ভূখণ্ড ছিল তাঁর পদানত, অথচ তাঁর নিজের অবস্থা ছিল একজন দরিদ্রের ন্যায়; তাঁর গায়ে ছিল একটি মাত্র চাদর; যার মূল্য মাত্র চার দিরহামের বেশি ছিল না। তথাপি উজ্জ্বলতম অনুসরণীয় আদর্শের মাধ্যমে শান্তির দূত মহানবী হজরত মুহাম্মদ (সা.) বিশ্ব মানবতার মুক্তির জন্য এক অনন্য আলোকবর্তিকা। সকল ধরনের শোষণ-নিপীড়ন, জুলুম-অত্যাচার, অজ্ঞানতা-অন্ধকার বিরুদ্ধে জ্ঞান-শান্তি-আলোর অনিঃশেষ ঝর্ণাধারা তিনি। তিনি মানবতার মুক্তির মহান দূত, মহান শিক্ষক; বিশ্ব জাহানের জন্য রহমতস্বরূপ। তাঁর মিশন, তাঁর কথা, তাঁর কর্ম- যা কোরআন- হাদিসের মাধ্যমে আমরা আজও অনুপ্রেরণার উৎসরূপে বুকে জড়িয়ে ধরে পেতে পারি দুনিয়া ও আখেরাতের কল্যাণ ও মুক্তি। সমগ্র বিশ্বকে করতে পারি সকল অনাচার-হানাহানি থেকে মুক্ত এক শান্তির বাগান। তাঁর প্রতি আমাদের অগণন দরুদ ও সালাম:
"হে আল্লাহ! তুমি মুহাম্মাদ (সা.) এবং তাঁর বংশধরদের ওপর এই রূপ রহমত নাজিল করো, যেমনটি করেছিলে ইব্রাহিম ও তার বংশধরদের ওপর। নিশ্চয়ই তুমি প্রশংসনীয় ও সম্মানীয়। হে আল্লাহ! তুমি মুহাম্মাদ (সা.) এবং তার বংশধরদের ওপর বরকত নাজিল করো, যেমন বরকত নাজিল করেছিলে ইব্রাহিম ও তার বংশধরদের ওপর। নিশ্চয়ই তুমি প্রশংসনীয় ও সম্মানীয়।"