রাণী জুবাইদার বিস্ময়কর কীর্তি
লোকটি আজই প্রথম খলিফার প্রাসাদে এসেছেন। হেঁটে এসেছেন দজলার পাড় দিয়ে। প্রাসাদে ঢুকতে কোনো সমস্যা হয়নি, স্বয়ং রাণী তাকে ডেকে পাঠিয়েছেন। খাদেমরা তাকে মহলে বসিয়েছে যত্ন করেই। তিনি বসে আছেন। ওপাশের পর্দাটা মৃদু নড়ে উঠল। মৃদুস্বরে সালাম বিনিময় হলো। তারপর আলাপ-
সম্রাজ্ঞী : কেমন আছেন?
আগন্তুক : আলহামদুলিল্লাহ! ভালো আছি, আপনি কেমন আছেন?
সম্রাজ্ঞী : আলহামদুলিল্লাহ, ভালো। আপনার খবর বলুন।
আগন্তুক : কাজ সুন্দরভাবে এগোচ্ছে। ইতোমধ্যে ওয়াদি নোমান থেকে আরাফাত ময়দান পর্যন্ত খাল খনন করা হয়েছে। এখন আরেকটি শাখা হুনাইন থেকে মক্কা পর্যন্ত খনন করা হবে। সমস্যা হলো, এই এলাকায় কয়েকটি পাহাড় আছে। পাহাড় কেটেই নহরের কাজ করতে হবে। এতে প্রচুর খরচ হবে।
সম্রাজ্ঞী : আপনি কাজ চালিয়ে যান। খরচ আমি পাঠিয়ে দেব। যদি শ্রমিকদের হাঁতুড়ির প্রতিটি আঘাতের জন্য এক দিনার করে খরচ হয়, তবুও পরোয়া করবেন না। কাজ চালিয়ে যাবেন।
আগন্তুক : আপনি ব্যাপারটা বুঝার চেষ্টা করছেন না, ইতোমধ্যে প্রায় ১০ লাখ দিনার খরচ হয়ে গেছে।
সম্রাজ্ঞী : আমি কোনো কথা শুনতে চাই না। আপনি কাজ চালিয়ে যান। আজ থেকে সব হিসাব বন্ধ। মহাহিসাবের দিনের জন্য আমি এই হিসাব ত্যাগ করলাম। সেই হিসাবের দিন আমি আল্লাহকে এই হিসাব দেবো।
এরপর আর কথা চলে না। আগন্তুক বিদায় নিলেন।
গল্পটি ‘নহরে জুবাইদা’ খননকালের। এটা খননে মোট ব্যয় হয়েছিল ১৭ লাখ দিনার। এতে হাজীদের ও সংশ্লিষ্ট এলাকার কৃষকদের পানির কষ্ট লাঘব হয়। আরাফাতের ময়দান, মুজদালিফা ও মিনার পাশ দিয়ে প্রবাহিত সেই নহরটি আজ প্রাণহীন। কিন্তু পড়ে আছে রাণী জুবাইদার মহান স্মৃতিচিহ্ন। আজও বিশ্ব মুসলিম শ্রদ্ধাভরে সেই স্মৃতি স্মরণ করেন।
রাণী জুবাইদার আসল নাম আমাতুল আজিজ। তিনি ১৪৯ হিজরিতে ইরাকের মসুলে জন্মগ্রহণ করেন। বেড়ে উঠেন দাদা খলিফা আবু জাফর মানসুরের প্রাসাদে। দাদা আদর করে তাকে ডাকতেন ‘জুবাইদা’ নামে। পরে এই নামেই তিনি ইতিহাসের পাতায় স্থান করে নেন। ১৬৫ হিজরিতে খলিফা হারুনুর রশীদের সঙ্গে তার বিয়ে হয়। তিনি ছিলেন নবী কারিম (সা.)-এর রক্তের ধারক।
বলা হয়, সম-সাময়িক দুনিয়ায় তার মতো বিদ্বান, ধর্মপরায়ণ, পরোপকারী এবং বুদ্ধিমতী নারী দ্বিতীয়জন ছিল না। কোরআন, হাদিস, ইজমা, কিয়াস, ইতিহাস, ভূগোল, জ্যামিতি এবং ধর্মতত্ত্ব সম্পর্কে রাণীর পাণ্ডিত্যের সুনাম ছড়িয়ে পড়েছিল সর্বত্র। রাণী জুবাইদা ছিলেন যেকোনো ভালো কাজে সর্বাধিক আগ্রহী এবং যেকোনো নেক ও পুণ্যের কাজে সবার চেয়ে অগ্রবর্তী।
রাজপ্রাসাদে তিনি ১০০ জন নারী হাফেজ রেখেছিলেন। তারা একজনের পর একজন কোরআন মাজিদ তেলাওয়াত করতে থাকতেন। ২৪ ঘণ্টা তার প্রাসাদে কোরআন তেলাওয়াতের শব্দ শোনা যেত। তিনি প্রচুর দান করতেন।
মরুময় মক্কায় জমজম ছাড়া পানির তেমন উৎস ছিলো না। ফলে সেকালে হাজীরা খুব কষ্ট পেতেন। খলিফা হারুনুর রশিদের সময়ে পানির অভাব এতই তীব্র হয়েছিল যে, এক বালতি পানি ২০ দিরহামে বিক্রি করা হতো। খলিফা কর্তৃক পানির অতিরিক্ত ব্যবস্থাপনাও হাজীদেরকে পানির সমস্যা থেকে মুক্তি দিতে পারেনি।
১৯৩ হিজরিতে খলিফার মৃত্যুর পর রাণী জুবাইদা হজপালনে যান। নিজ চোখে পানির সমস্যা দেখে তিনি এতটাই ব্যথিত হন যে, পানির সমস্যা সমাধানে একটি খাল খননের তাৎক্ষণিক সিদ্ধান্ত নেন। এ নহরের মাধ্যমে পানি সরবরাহের মধ্য দিয়ে হাজী ও মক্কা এলাকার খাবার পানির সমস্যা মুক্ত হয়।
আরব অঞ্চল কঙ্করময়, অনুর্বর, শুষ্ক এবং আবহাওয়া উষ্ণ। ভূপৃষ্ঠে খালের অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখা কঠিন। তাই ভূগর্ভস্থ টানেল খনন করা হয়। জনগণ যেন খাল থেকে পানি সংগ্রহ করতে পারে, এ জন্য কিছু দূর অন্তর অন্তর ভূপৃষ্ঠে পানির স্টেশন স্থাপন করা হয়। খেয়াল করুন, তখন সালটি ছিল ৮০৯। ‘নহরে জুবাইদা’ একটি প্রসিদ্ধ বাক্য। একে জুবাইদার নহরও বলা হয়। আরবি নহর অর্থ সরু, স্রোতস্বিনী, জলধারা, খাল, নালা ইত্যাদি। খালটি এমন সময়ে খনন করা হয়েছিল, যখন আধুনিক প্রযুক্তিগত সুযোগ-সুবিধা ছিলো না। হাজার বছরব্যাপী এ খালটি জনমানুষের সেবা করেছে।
নহরের এক শাখা ওয়াদি নোমান থেকে আরাফাত ময়দান ও অপর শাখা হুনাইন থেকে মক্কা পর্যন্ত খনন করা হয়েছিল। পানি যাতে সুপেয় হয়, তাই সমুদ্র বাদ দিয়ে বিভিন্ন পাহাড়ি ঝর্ণা ও প্রাকৃতিক উৎস স্থায়ীভাবে ক্রয় করে সেই পানি নহরে প্রবাহিত করা হয়ে। এতে হাজী ও কৃষকদের কষ্ট স্থায়ীভাবে দূর হয়েছিল।
সেকালে মরুভূমিতে যাতায়াত ছিল দুঃসাধ্য। আধুনিক প্রকৌশল বিদ্যা ছাড়াই রাণী জুবাইদা কুফা থেকে মক্কা ও মদিনা পর্যন্ত মরুভূমির ওপর ১৪০০ কিলোমিটার দীর্ঘ সড়ক নির্মাণ করেন। মানব কল্যাণে তিনি অগণিত উদ্যোগ গ্রহণ করেছিলেন। বর্ণিত নহরটি ছাড়া তিনি মক্কায় আরও ৫টি জলাধার ও অনেক অজুখানা নির্মাণ করেছিলেন।
দাদার দেওয়া আদুরে ডাকনাম ‘জুবাইদা’ নিয়েই তিনি ইতিহাসে স্থান করে নেন। এতটাই খ্যাতি অর্জন করেন যে, অনেকে ভুলেই যান যে, তিনি হারুনুর রশিদের স্ত্রী। তার খ্যাতির সামনে হারুনুর রশিদও ম্লান। আজও অনেক মুসলিম দম্পতি শখ করে তাদের মেয়ের নাম জুবাইদা রাখেন।
এই মহীয়সী সম্রাজ্ঞী ২৬ জমাদিউল উলা ২১৬ হিজরি মোতাবেক ১০ জুলাই ৮৩১ সালে ইন্তেকাল করেন। আল্লাহতায়ালা তাকে জান্নাতে উচুঁ মাকাম দান করুন। আমিন।