হাজিদের সেবায় বিশাল বহর, প্রয়োজনে খোঁজ মেলে না কারও
এক সিনিয়র সাংবাদিক পবিত্র হজ পালন শেষে এখন মদিনায় অবস্থান করছেন। সোমবার (২৪ জুন) তিনি ফেসবুকে লিখেছেন, ‘শরীর ব্যাথা ও ১০৩ ডিগ্রি জ্বর নিয়ে গেলাম মদিনায় হজ মিশনে। পুরো বর্ণনা শোনার মতো সময় মনে হচ্ছে তাদের নেই। চিকিৎসক এজিথ্রোমাইসিন আর প্যারাসিটামল দিলেন। একই এন্টিবায়োটিক তারা হাতের ফোস্কার জন্যও দিয়েছে এক রোগীকে। সবরোগের মহৌষধ এক এন্টি বায়োটিক! হজ মিশনের এই দূরবস্থা কবে কাটবে?’
ওই স্ট্যাটাসের নিচে একজন মন্তব্য করেছেন, ‘মাকে নিয়ে গিয়েছিলাম অসুস্থ ছিলেন, কিন্তু তারা একটুও কেয়ার করেনি; ওষুধও দেয়নি-নিদারুণ অবহেলা করেছে। তাদের কাজ নিজেদেরকে নিয়ে ব্যস্ত থাকা।’ আরেকজন লিখেছেন, ‘২০০০ সালে প্রথমবার যখন যাই, তখনও মিশনে কর্মকাণ্ড প্রত্যক্ষ করতে গিয়ে হতাশ হই।’
মদিনায় বাংলাদেশের হজ মিশন নিয়ে এমন অভিযোগ নতুন কিছু নয়, মক্কা হজ মিশন নিয়েও রয়েছে বিস্তর অভিযোগ। বিশেষ করে এবার হজের পাঁচ দিন মিনা-আরাফাত ও মুজদালিফায় হজ মিশনের লোকদের দেখা মেলেনি বলে অভিযোগ করেছেন অনেকে। অথচ বাংলাদেশি হজযাত্রীদের সার্বক্ষণিক সেবা প্রদান করার লক্ষে চলতি বছর ৪৫৩ জন ব্যক্তি সরকারি খরচে হজে গেছেন। এ জন্য সরকারের ১৫ কোটি টাকা ব্যয় হবে। কিন্তু প্রয়োজনীয় সময়ে এই বিশাল বহরের কারও দেখা মেলেনি বলে বার্তা২৪.কমের সঙ্গে আলাপকালে অভিযোগ করেছেন সরকারি-বেসরকারি হাজিরা।
আরাফাতের ময়দান, মুজদালিফা ও বিশেষ করে মিনায় মানুষকে চরম ভোগান্তির শিকার হতে হয়েছে। মুজদালিফায় খোলা ময়দান থেকে জামারাত যাওয়া এবং জামারাত থেকে দলছুট হাজিদের নির্দিষ্ট তাঁবু চিনতে না পারার কারণে ক্লান্ত ও ক্ষুধার্ত অবস্থায় রাস্তায় রাস্তায় ঘুরতে হয়েছে। ছায়া ও পানিহীন গরম পরিবেশে সাহায্যের জন্য বিভিন্ন দেশের স্বেচ্ছাসেবকদের দেখা মিললেও বাংলাদেশি কোনো স্বেচ্ছাসেবকের দেখা মেলেনি।
এ ছাড়া বাংলাদেশ সরকার মিনার যে ম্যাপ হজপোর্টালে আপলোড করেছে, তাতে রয়েছে মারাত্মক ভুল। ৫৮ নম্বর ও ৫৯ নম্বর মক্তবের স্থান অদল-বদল হয়েছে। এই ম্যাপ দেখে আরও ঘুরতে হয়েছে। এ ছাড়া বাংলাদেশ সরকারের পক্ষ থেকে হজযাত্রীদের জন্য কোনো কার্যকারী হেল্পলাইন নেই, সবক্ষেত্রে হাজিদের প্রতি দায়সারা ভাব। সরকারি খরচে বিশাল বহরের হজসেবকদের থেকে সেবা পাওয়া নিতান্তই ভাগ্যের বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে। সৌদি আরব থেকে এভাবেই নিজেদের অসহায়ত্ব ও কষ্টের কথা বলছিলেন এক হজযাত্রী।
বেসরকারি ব্যবস্থাপনায় হজ পালনে যাওয়া অবসরপ্রাপ্ত ওই আমলা অত্যন্ত সচেতনভাবেই নিজের কষ্টের বদলে অন্য হাজিদের কষ্টের কথা বলছিলেন। তার মতে, মিনা-আরাফাত-মুজদালিফা ও জামারাতেই তো হজের সব। এখানেই যদি কোনো স্বেচ্ছাসেবকের দেখা না মেলে, তাহলে এর চেয়ে দুঃখের আর কিছু নেই।
সুমাইয়া নামের এক নারী পরিবারের ৭ জন সদস্যসহ হজ পালনে সৌদি আরব অবস্থান করছেন। তার অভিজ্ঞতা আরও খারাপ। তার মতে, ‘আমি জানি না, এ বছর কি হয়েছে! এই কয়দিন অনেক কিছুর মধ্য দিয়ে যেতে হলো। সব হাজিদেরই কষ্ট পেতে হয়েছে। সৌদি সরকার, বাংলাদেশ সরকার কিংবা মোয়াল্লেমও ভালো আচরণ করেননি। ৪৫ ডিগ্রী গরমে ১ বোতল পানির জন্য রীতিমতো কান্নাকাটি করেছে লোকজন। চারদিকে মানুষ কাঁদছে। তীব্র গরমে সবাই একটু আশ্রয় ও ছায়ার সন্ধান করেছে। পাকিস্তান ও ভারতের প্রচুর স্বেচ্ছাসেবক রাস্তায় নিজ নিজ দেশের হাজিদের সেবা দিয়েছে। কিন্তু কোনো বাংলাদেশি স্বেচ্ছাসেবকের দেখা মেলেনি।’
চলতি বছর হাজি সেবার নামে সরকারি খরচে হজে যাওয়া বন্ধ করার সিদ্ধান্ত নিয়েছিল সরকার। সেই সিদ্ধান্ত মানেনি ধর্ম মন্ত্রণালয়। কারণ এবার বিভিন্ন মন্ত্রণালয়ের ৩০ কর্মকর্তা হজে গেছেন। আবার হজ ব্যবস্থাপনা বিষয়ে সংবাদ পরিবেশনসহ হজযাত্রীদের সহায়তার জন্য সরকারি খরচে হজে গেছে ১০ সদস্যের একটি গ্রুপ।
ধর্ম মন্ত্রণালয় সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা জানান, বিভিন্ন মন্ত্রণালয়, বিভাগের কর্মকর্তা ও কয়েকজন মিডিয়াকর্মী নানাভাবে তদবির করে রাষ্ট্রীয় অর্থে হজে যাওয়ার দলে যুক্ত হয়েছেন। এ ছাড়া ধর্ম মন্ত্রণালয়ের সচিব ও মন্ত্রী তাদের পছন্দের কয়েকজনকে এই দলে যুক্ত করেছেন। এই তালিকায় আছেন একাধিকবার হজে যাওয়া ব্যক্তিরাও। প্রায় ১৫ কোটি টাকা ব্যয় হলেও হাজিরা কোনোভাবেই উপকৃত হননি, সেটা হাজিদের কথাতেই বেশ স্পষ্ট।
যদিও হজযাত্রীদের সেবায় পাঠানোদের শর্ত দেওয়া হয়েছে, হজযাত্রীদের সার্বক্ষণিক সেবা প্রদান করা। কিন্তু কে কোন ধরনের সেবা প্রদান করবেন তা স্পষ্ট বলা হয়নি। আরও বলা হয়েছে, টিমের সদস্যরা সার্বক্ষণিক দায়িত্বে নিয়োজিত আছেন মর্মে বিবেচিত হবেন। কিন্তু তাদের ব্যক্তিগত খাওয়া-দাওয়া ও বিশ্রামের বিষয়ে কিছু বলা নেই। সরকারি খরচে হজে যাওয়ার তালিকায় অনেক ব্যক্তির হজ সম্পর্কে কোনো জ্ঞান নেই।
তালিকাভুক্ত একাধিক ব্যক্তির সঙ্গে বার্তা২৪.কমের কথা হয়েছে, তারা তাদের দায়িত্ব সম্পর্কে সুনির্দিষ্টভাবে বলতে না পারলেও ‘হাজি সাহেবদের সেবা’ করতে গেছেন- এমন একটি সাধারণ উত্তর পাওয়া গেছে।
আর ধর্ম মন্ত্রণালয় বলছে, সৌদি সরকারের সিদ্ধান্ত অনুসারে হাজি সেবা দলের সদস্যদের হজ করার কোনো সুযোগ নেই। তালিকাভুক্তরা বলছেন, প্রতিবছর বলা হয় হজ করা যাবে না। কিন্তু সবাই হজ করে আসেন।
ধর্ম মন্ত্রণালয় সূত্রে জানা গেছে, এবার সরকারি খরচে হজে যাওয়া ব্যক্তিরা বিমানের টিকিট বাবদ এক লাখ ৯৪ হাজার ৮০০ টাকা জমা দিয়েছেন। এ ছাড়া প্রত্যেককে ৩৫ হাজার টাকা করে হজ অফিসে জমা দিতে হবে খাওয়ার খরচ বাবদ। মন্ত্রণালয়ের একজন ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা জানান, বিমানভাড়ার বাইরে সব খরচ সরকার বহন করবে। একেকজনের পেছনে সরকারের খরচ হবে চার লাখ টাকা।
চলতি বছর হাজিদের সেবায় সৌদি আরবে অনেকগুলো দল গিয়েছে। ধর্মমন্ত্রী ফরিদুল হক খানের নেতৃত্বে হজ প্রতিনিধিদলে রয়েছেন বিভিন্ন মন্ত্রণালয় ও বিভাগের সাতজন সচিব ও জ্যেষ্ঠ সচিব, দুজন অতিরিক্ত সচিব, দুজন সংসদ সদস্য এবং একজন নির্বাচন কমিশনার। ৫৫ সদস্যের হজ প্রশাসনিক দলে বিভিন্ন মন্ত্রণালয়, বিভাগের কর্মকর্তা আছেন ২২ জন এবং ধর্ম মন্ত্রণালয়ের ৩৩ জন। হজ প্রশাসনিক সহায়তাকারী ৭৪ সদস্যের দলে রয়েছেন ধর্ম মন্ত্রণালয়ের ২২ পিয়ন এবং ১২ জন গাড়িচালক। ২৫ সদস্যের কারিগরি দলে আছেন ধর্ম মন্ত্রণালয়ের সাতজন কম্পিউটার অপারেটর। সমন্বিত হজ চিকিৎসা দলে আছেন ২৮৯ জন। এর মধ্যে ৮৫ জন চিকিৎসক, ৫৫ জন নার্স, ২৪ জন ফার্মাসিস্ট, ২৫ জন ওটি/ল্যাব অ্যাসিস্ট্যান্ট। এখানেও ইসলামিক ফাউন্ডেশনের প্রকল্প ইসলামিক মিশনে কর্মরতদের সংখ্যা অনেক। সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা বলেন, এসব দলের অনেক কর্মকর্তা সংশ্লিষ্ট দলের কাজ সম্পর্কে কিছু জানেন না।
অন্যদিকে সরকারি খরচে হজে নিতে এবার সাংবাদিকদের নামে অসাংবাদিকদের নিয়ে দল গঠন করার অভিযোগ উঠেছে। ধর্মমন্ত্রী ও সচিব তাদের নিজ এলাকার তিনজন সাংবাদিকের নাম দিয়ে ১০ জনের একটি তালিকা করেন। এখানেও চালাকির আশ্রয় নেয় ধর্ম মন্ত্রণালয়। সাংবাদিকদের তালিকা প্রকাশের প্রজ্ঞাপনে কে কোন গণমাধ্যমে কর্মরত সেটা উল্লেখ না করে তাদের নাম ও পাসপোর্ট নম্বর দিয়ে প্রজ্ঞাপন প্রকাশ করে। তাদের মক্কা, মদিনা, মিনা ও আরাফাতের ময়দানসহ বাংলাদেশের হজ ব্যবস্থাপনা বিষয়ে সংবাদ পরিবেশনসহ হজযাত্রীদের সহায়তা করার কথা বলা হয়েছে। কিন্তু দুই একজন বাদে আর কারো কোনো সংবাদ পরিবেশন নজরে আসেনি।
গত বছর (২০২৩) হাজিদের সেবায় গিয়ে না জানিয়ে তায়েফ ভ্রমণ করার দায়ে ৭ জনকে শোকজ করা হয়। অন্যদিকে চলতি বছরের সমন্বিত হজ চিকিৎসক দলে নার্স না হয়েও নার্স হিসেবে তালিকাভুক্তি, বয়স বেশিসহ বিভিন্ন অনিয়ম করে এক বা একাধিকবার চিকিৎসক দলে নাম থাকা নয় নার্সের ওপর হাইকোর্টের স্থগিতাদেশ বহাল রাখে, ফলে তারা সৌদি যেতে পারেননি। এর আগে নানা অভিযোগে তালিকা সংশোধন চারজনের বাদ দেয় ধর্ম মন্ত্রণালয়।
এসব ঘটনায় সহজেই অনুমান করা হয়, সেবার নামে সৌদি আরবে যাওয়ার এত মরিয়া চেষ্টা কেন? অভিযোগ সম্পর্কে জানতে ধর্ম মন্ত্রণালয় ও হজ মিশনের একাধিক কর্তকর্তার সঙ্গে যোগাযোগ করেও কোনো সাড়া মেলেনি।