যেভাবে তৈরি হয় পবিত্র কাবার গিলাফ
সৌদি আরবে নতুন হিজরি বর্ষ ১৪৪৬ শুরু হবে রোববার থেকে। চাঁদের হিসাব রাত থেকে গণনা শুরু হওয়ায় নতুন বছরের চাঁদ দেখে এশার নামাজের পর থেকে শুরু হবে পবিত্র কাবাঘরের কিসওয়া বা গিলাফ পরিবর্তনের কাজ।
প্রতিবছর পবিত্র কাবাঘরের গিলাফ পরিবর্তন করে নতুন গিলাফ পরানো হয়। ইতোমধ্যে প্রস্তুত হওয়া নতুন গিলাফ সৌদি বাদশাহর পক্ষ থেকে কাবাঘরের প্রধান রক্ষকের কাছে হস্তান্তর করা হয়েছে।
সৌদি আরবের বাদশাহ সালমানের পক্ষ থেকে মক্কার উপগভর্নর ও কেন্দ্রীয় হজ কমিটির উপ-চেয়রম্যান প্রিন্স সাউদ বিন মিশাল গিলাফটি কাবাঘরের প্রধান রক্ষক আবদুল মালিক আল-শায়বির কাছে হস্তান্তর করেন। এ সময় স্বাক্ষর করেন মক্কা ও মদিনার পবিত্র দুই মসজিদের তত্ত্বাবধানকারী জেনারেল অথরিটির প্রধান ড. তাওফিক আল-রাবিয়া ও আবদুল মালিক আল-শায়বি।
ইসলামের প্রথম যুগ থেকে হাজার বছর ধরে জিলহজ মাসের ৯ তারিখ আরাফাত দিবসে কাবাঘরের গিলাফ পরিবর্তনের রীতি চলে আসছিল। ২০২২ সাল মোতাবেক ১৪৪৪ হিজরি থেকে কাবার গিলাফ পরিবর্তনের সময়সূচিতে পরিবর্তন আনে সৌদি সরকার। তখন থেকে হিজরি নববর্ষকে স্মরণীয় রাখতে মহররমের প্রথম রাতে গিলাফ পরিবর্তন করা হয়।
‘দ্য কিং আবদুল আজিজ কমপ্লেক্স ফর ম্যানুফ্যাকচারিং দ্য কাবা কিসওয়া’ ও দুই পবিত্র মসজিদের প্রেসিডেন্সি বিভাগ যৌথ বিবৃতিতে জানিয়েছে, এরই মধ্যে গিলাফ পরিবর্তনের সব প্রস্তুতি সম্পন্ন হয়েছে।
‘দ্য কিং আবদুল আজিজ কমপ্লেক্স ফর ম্যানুফ্যাকচারিং দ্য কাবা কিসওয়া’ হলো- কাবার গিলাফ প্রস্তুতকারক প্রতিষ্ঠান। ১৯২৮ সালে প্রতিষ্ঠিত ১ লাখ বর্গমিটারের এই কমপ্লেক্স এক সময় ‘কিসওয়া ফ্যাক্টরি’ নামে পরিচিত ছিল। ২০১৭ সালে রাজকীয় ডিক্রির মাধ্যমে নামটি পরিবর্তন করা হয় এবং কমপ্লেক্সের প্রযুক্তিগত ব্যাপক উন্নয়ন করা হয়।
দ্য কিং আবদুল আজিজ কমপ্লেক্স ফর ম্যানুফ্যাকচারিং দ্য কাবা কিসওয়ার আন্ডার সেক্রেটারি জেনারেল আমজাদ ইবনে আয়িদ আল-হাজমি বলেন, ‘সব কাজ শেষ। যথাযোগ্য মর্যাদায় এই পবিত্র দায়িত্ব পালন করা হবে। জাতীয় পর্যায়ের বিশেষজ্ঞদের একটি দল হাতে এটি সেলাই করে টাঙিয়ে দেবেন। এই কাজের জন্য ১৫ জন ব্যক্তিকে বিশেষভাবে প্রশিক্ষণ দেওয়া হয়েছে। পুরো কাজে অংশ নেবেন ১৬৬ জন মিস্ত্রি ও কারিগরের একটি দল।’
মসজিদে হারামের কিসওয়া রক্ষণাবেক্ষণ বিভাগের পরিচালক ফাহদ আল-জাবিরি জানান, ‘তাদের নিখুঁত প্রশিক্ষণ দেওয়া হয়েছে, যাতে তারা দারুণ নৈপুণ্যে তা সম্পাদন করতে পারেন। তারা খুবই কম সময়ে কাজটি সম্পন্ন করবেন।’
পবিত্র কাবার গিলাফ তৈরির জটিল প্রক্রিয়াটি দশটি ধাপে সম্পন্ন হয়। প্রথমে রেশম ও সুতার পিণ্ডি সংগ্রহ করে ল্যাবে সেগুলোর গুণগত মান পরীক্ষা করা হয়। এরপর সুতায় রং লাগানো হয় এবং স্বয়ংক্রিয় মেশিনে কাপড় বোনা হয়। এরপর কাপড় পুরো বছর টিকে থাকার উপযোগী হলো কি না, তা দেখা হয়।
৬৫৮ বর্গমিটারের গিলাফটি তৈরিতে ৬৭০ কিলোগ্রাম কালো রেশম ব্যবহার করা হয়। ৪৭টি কাপড়ের টুকরোকে বিশেষ মেশিনে সেলাই করা হয়। এরপর কালো গিলাফের গায়ে মেশিনের ছাপ দিয়ে লেখা হয় আল্লাহর নাম ও গুণাবলি- ‘ইয়া আল্লাহ, ইয়া মান্নান, ইয়া দাইয়ান, সুবহানাল্লাহি ওয়াবিহামদিহি সুবহানাল্লাহিল আজিম ওয়া লা ইলাহা ইল্লাল্লাহ মুহাম্মাদুর রাসুলুল্লাহ।’
এরপর গিলাফটি চলে যায় গিল্ডিং অ্যান্ড এমব্রয়ডারি বিভাগে। সেখানে ক্যালিওগ্রাফার ও হস্তশিল্পীদের হাতে পরম যত্নে চারপাশের সোনালি বেল্ট এবং কাবার দরজার পর্দা তৈরি হয়। ২৩ থেকে ৬০ বছর বয়সী ৫০ জনের বেশি দক্ষ শিল্পী তাতে পবিত্র কোরআনের আয়াত ও অন্যান্য দোয়া এমব্রয়ডারি করেন। এ কাজে ১০০ কেজি খাঁটি রুপা এবং ১২০ কেজি সোনার প্রলেপযুক্ত রৌপ্য সুতা ব্যবহৃত হয়।
কাবার সাবেক ক্যালিগ্রাফার আবদুর রহিম আমিন বোখারির তৈরি আরবি সুলুস-শৈলীর ক্যালিওগ্রাফি অনুসরণ করে লেখাগুলো ফুটিয়ে তোলা হয়। কাবার দরজাটি পাঁচটি পর্দায় তৈরি, যাতে কয়েকটি আয়াত এবং চারটি সম্পূর্ণ সুরা রয়েছে- সুরা ফাতিহা, সুরা ফালাক, আন নাস ও কুরাইশ। সোনার বেল্ট ছাড়াও তাতে আল্লাহর বিভিন্ন নাম অঙ্কিত ১৭টি ছোট ছোট বাতি সদৃশ এমব্রয়ডারি রয়েছে।
প্রথমে সাদা রঙের কাপড় টানা হয়। এরপর কালো রেশম রাখা হয়। এরপর এমব্রয়ডারি করার জন্য তা টেনে শক্ত করা হয় এবং সোনা-রুপা দিয়ে আবৃত করার আগে নিচে সাদা সুতা দিয়ে ভরাট করা হয়। গিলাফে আরবিতে ‘মক্কা আল-মোকাররমা’, চলতি সন এবং সৌদি বাদশাহর নাম যুক্ত করা হয়।
এমব্রয়ডারি শেষ করতে সময় লাগে ৮ থেকে ১০ মাস। এরপর টুকরোগুলো একসঙ্গে সেলাই করা হয় এবং কাবাঘরে ঝোলানোর আগ পর্যন্ত বিশেষ স্থানে সংরক্ষণ করা হয়।
প্রতিবছর দুটি করে (একটি সতর্কতামূলক) গিলাফ তৈরি হয়। একটি হাতে তৈরি, বানাতে সময় লাগে আট-নয় মাস। অন্যটি মেশিনে মাত্র এক মাসে তৈরি করা হয়। উম্মুল জুদ কারখানায় মদিনায় হুজরায়ে নববির গিলাফও তৈরি করা হয়। গিলাফের অভ্যন্তরীণ পর্দাটির দৈর্ঘ্য সাত মিটার, প্রস্থ চার মিটার।