নেশাজাতীয় দ্রব্য পাচারে তিন হজ এজেন্সির অভিনব কৌশল

  • স্পেশাল করেসপন্ডেন্ট, বার্তা২৪.কম, ঢাকা
  • |
  • Font increase
  • Font Decrease

অভিযুক্ত তিন এজেন্সির মালিক (বা থেকে) বাবা মো. আব্দুস সাত্তার চাকলাদার, ছেলে মোহাম্মদ আব্দুস সালাম সনি ও হাফেজ কাওছার আহমাদ, ছবি: বার্তা২৪.কম

অভিযুক্ত তিন এজেন্সির মালিক (বা থেকে) বাবা মো. আব্দুস সাত্তার চাকলাদার, ছেলে মোহাম্মদ আব্দুস সালাম সনি ও হাফেজ কাওছার আহমাদ, ছবি: বার্তা২৪.কম

পবিত্র হজ শেষ হয়েছে। ধীরে ধীরে দেশে ফিরছেন হাজিরা। তীব্র দাবদাহের দরুণ এবার হজে অনেক প্রাণহানির ঘটনা ঘটেছে। তবে এ ঘটনা ছাপিয়ে বাংলাদেশের হজ কার্যক্রমে এক এজেন্সির মালিককে নিষিদ্ধ করার প্রতিবাদে মক্কাস্থ হজ মিশনের সামনে বিক্ষোভ প্রদর্শন, কয়েকটি এজেন্সির বিরুদ্ধে নেশাজাতীয় দ্রব্য পাচারের অভিযোগ এবং নানা অনিয়ম, গাফিলতির মধ্য দিয়ে শেষ হয়েছে বাংলাদেশের হজ কার্যক্রম।

এসব ঘটনায় নড়েচড়ে বসছে ধর্ম বিষয়ক মন্ত্রণালয়। ইতোমধ্যে লাইসেন্স বাতিলের উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে অভিযুক্ত হজ এজেন্সিগুলোর।

বিজ্ঞাপন

রোববার (১৪ জুলাই) ধর্ম মন্ত্রণালয়ের হজ অনুবিভাগের সহকারী সচিব মো. তফিকুল ইসলাম খিদমাহ ওভারসীজ, জিলহজ্ব ট্রাভেলস ও আত-তাবলীগ হজ সার্ভিসের বিরুদ্ধে কারণ দর্শানোর নোটিশ জারি করেন। নোটিশে ৩০ জুলাইয়ের মধ্যে সংশ্লিষ্ট অভিযোগের বিষয়ে ব্যাখ্যা প্রদানের নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। অন্যথায় হজ লাইসেন্স বাতিলসহ তাদের বিরুদ্ধে আইনানুগ ব্যবস্থা নেওয়া হবে বলে জানানো হয়।

জানা গেছে, ২০২৪ সনের হজ মৌসুমে খিদমাহ ওভারসীজ (হজ লাইসেন্স নং ১৪০১) নিবন্ধিত ১৪১ জন হজযাত্রীর সঙ্গে সমন্বয়কারী এজেন্সি হিসেবে ৫৬ জন হজযাত্রী নিয়ে জিলহজ্ব ট্রাভেলস (হজ লাইসেন্স নং ০৩২১), ৫৪ জন হজযাত্রী নিয়ে আত-তাবলীগ হজ সার্ভিস (হজ লাইসেন্স নং ১৩৪২) এবং ৪০ জন হজযাত্রী নিয়ে আল-তাকওয়া হজ কাফেলা ট্যুরস এন্ড ট্রাভেলস (হজ লাইসেন্স নং ০৬৭৬) হজ কার্যক্রমে অংশগ্রহণ করে। হজ কার্যক্রম শুরুর পর থেকেই এসব এজেন্সি হজযাত্রী রিপ্লেসমেন্ট নিয়ে নানা টালবাহানা শুরু করে। ২০ শতাংশ রিপ্লেসমেন্ট পাওয়ার পর আরও রিপ্লেসমেন্টের জন্য দেন-দরবার অব্যাহত রাখে। রিপ্লেসমেন্টের জন্য ধর্ম মন্ত্রণালয় সংশ্লিষ্ট নিবন্ধনকারী হজযাত্রীদের উপস্থিত করাতে বললে, সেটাও তারা করতে পারেনি। একপর্যায়ে হাইকোর্টে রিট করে হজযাত্রীদের হজে যাওয়ার ব্যবস্থা করে।

বিজ্ঞাপন

হজযাত্রীদের সৌদি আরব গমনের শেষ পর্যায়ে অর্থাৎ ১১ জুন ভোর ৫টা ৫৫ মিনিটের একটি ফ্লাইটে লিড এজেন্সি খিদমাহ ওভারসীজের ১৯৫ জন হজযাত্রীর মধ্যে ওই এজেন্সির ১১১ জন, সমন্বয়কারী এজেন্সি জিলহজ্ব ট্রাভেলসের ৩৪ জন এবং আত-তাবলীগ হজ সার্ভিসের ৩৭ জন নিবন্ধিত হজযাত্রী ছিলেন।

খিদমাহ ওভারসীজের হজযাত্রীদের চেক ইন চলাকালে তামাক পাতা, জর্দা ও বিড়িসহ একটি লাগেজ সনাক্ত হয়। নেশা জাতীয় সামগ্রীসহ লাগেজ সনাক্ত হওয়ার পর খিদমাহ ওভারসীজের মোনাজ্জেম মুহাম্মদ আবদুস সালাম সনি, জিলহজ ট্রাভেলসের মালিক মো. আবদুস সাত্তার এবং গ্রুপ লিডার মো. বাবুল মিয়া সনাক্তকৃত ওই লাগেজসহ আরও ৩০টি লাগেজ নিয়ে হজক্যাম্প ত্যাগের চেষ্টা করলে ক্যাম্পের মূল ফটকে বাংলাদেশ স্কাউটের সদস্য এবং আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী কর্তৃক লাগেজসমূহ জব্দ করা হয়।

ওই ৩০টি লাগেজের মধ্যে ২টি লাগেজের তালা ভেঙে তাতে বিপুল পরিমাণ তামাক পাতা, জর্দ্দা ও বিড়ি পাওয়া যায়। সেখানে প্রাথমিক জিজ্ঞাসাবাদে গ্রুপ লিডার মো. বাবুল মিয়া জানান, ৩০টি লাগেজের সবগুলোতেই এমন জিনিস রয়েছে। বর্তমানে ওই লাগেজগুলো আশকোনা হজ অফিসে জব্দ অবস্থায় রয়েছে। এ ঘটনায় বিমানবন্দর থানায় একটি সাধারণ ডায়েরি (জিডি নং ৭২৯) করা হয়েছে।

অবাক করার বিষয় হলো, ২টি লাগেজ ব্যতিত কোনো লাগেজেই হজযাত্রীর নামসহ কোনো তথ্য পাওয়া যায়নি। লাগেজগুলোর অভ্যন্তরে রক্ষিত অবৈধ পণ্য সামগ্রী হজযাত্রীর নয় বরং সংশ্লিষ্ট ৩টি এজেন্সির। যারা পরিকল্পিতভাবে এই অবৈধ কাজটি করতে চেয়েছিলেন। এ কারণে তারা পরিকল্পনা করে শুরু থেকেই হজযাত্রী রিপ্লেসমেন্ট নিয়ে নানা ধরনের তালবাহানা করতে থাকে।

তাদের বিষয়ে খোঁজ নিয়ে জানা যায়, জিলহজ্ব ট্রাভেলসের মালিক মো. আব্দুস সাত্তার চাকলাদার। তার দুই ছেলে আত-তাবলীগ হজ সার্ভিসের মালিক মোহাম্মদ আব্দুস সালাম সনি ও খিদমাহ ওভারসীজের হাফেজ কাওছার আহমাদ। তারা জিলহজ গ্রুপ বাংলাদেশ নামে হজ ও উমরার কার্যক্রম পরিচালনা করেন। আগেও জেদ্দা বিমানবন্দরে তাদের লাগেজ থেকে বিপুল পরিমাণ জর্দা ও গুল উদ্ধার করা হয়।

সৌদি আরবগামী ফ্লাইটে তামাক পাতা, জর্দ্দা ও বিড়ি পরিবহনে সৌদি সরকারের নিষেধাজ্ঞা রয়েছে। জেদ্দা বিমানবন্দরে ইতোপূর্বে হজযাত্রীর লাগেজে তামাক পাতা-জর্দা ও গুল ধরা পড়লে সৌদি সরকারের হজ ও উমরা মন্ত্রণালয় ধর্ম বিষয়ক মন্ত্রণালয়কে লিখিতভাবে ব্যবস্থা গ্রহণের জন্য অনুরোধ জানায়।

এমতাবস্থায় তামাক পাতা, জর্দা ও গুলভর্তি এসব লাগেজ সৌদি বিমানবন্দরে ধরা পড়লে বাংলাদেশের ভাবমূর্তি চরমভাবে ক্ষুণ্ণ হতো এবং সৌদি আরব ও বাংলাদেশের মধ্যকার দ্বি-পাক্ষিক সম্পর্কে নেতিবাচক প্রভাব পড়তো। এ ধরনের কার্যক্রম হজ এজেন্সির জন্য হজ ও উমরা ব্যবস্থাপনা আইন- ২০২১ এর পরিপন্থী।

উল্লেখিত এজেন্সিগুলোর এমন কাজ হজ ও উমরা ব্যবস্থাপনা আইন- ২০২১ এর ধারা ১২ (খ) (জ) (ঞ) এবং (ঢ) মোতাবেক অনিয়ম ও অসদাচরণ হিসেবে বিবেচিত। এগুলো ধারা ১৩ (১) ও (২) অনুসারে লিড এজেন্সিসহ সংশ্লিষ্ট সমন্বয়কারী দুই এজেন্সির হজ লাইসেন্স বাতিলযোগ্য।

এ ধরনের কাজকে গুরুতর অন্যায় উল্লেখ করে হজ পরিচালক মুহম্মদ কামরুজ্জামান (উপসচিব) বার্তা২৪.কমকে বলেন, ‘অভিযুক্ত এজেন্সিদের শোকজ করা হয়েছে, শোকজের উত্তর পেলে পরবর্তীতে আইনানুযায়ী ব্যবস্থা নেওয়া হবে। আইন আইন লঙ্ঘনকারীদের অবশ্যই শাস্তি পেতে হবে।’

এ বিষয়ে জানতে অভিযুক্ত হজ এজেন্সি কর্তৃপক্ষের সঙ্গে একাধিকবার মোবাইল ফোনে যোগাযোগের চেষ্টা করেও বক্তব্য পাওয়া যায়নি।