সংখ্যা বাধা নয় কলম্বিয়ার মুসলিমদের ধর্মচর্চায়
মুসলিম বান্ধবীদের আচরণে মুগ্ধ কলম্বিয়ান তরুণী মারিয়া মেডিনার ইসলাম গ্রহণ তুরস্কে ব্যাপক আলোচনার জন্ম দেয়। ২০২২ সালের অক্টোবরে মারিয়া মেডিনা ইসলাম গ্রহণের পর জায়নাব নাম গ্রহণ করেন। এভাবে প্রায়ই দেশে-বিদেশে কলম্বিয়ার নাগরিকরা ইসলাম গ্রহণ করে থাকেন।
কলম্বিয়া প্রজাতন্ত্র দক্ষিণ আমেরিকার দেশ। যার একদিকে রয়েছে ক্যারিবীয় সাগর এবং অন্যদিকে প্রশান্ত মহাসাগর। দেশটির পূর্বে ভেনিজুয়েলা ও ব্রাজিল, দক্ষিণে ইকুয়েডর ও পেরু এবং উত্তর-পশ্চিমে পানামা অবস্থিত। বোগোটা কলম্বিয়ার সর্ববৃহৎ শহর ও রাজধানী।
চির সবুজের দেশ কলম্বিয়ার অর্থনীতি অনেকটাই কৃষিনির্ভর। কফি, অ্যাবোকাডো, পামঅয়েল, আখ, কলা ও আনারস উৎপাদনে বিশ্বের শীর্ষ দেশগুলোর একটি কলম্বিয়া। তবে কয়লা ও খনিজ তেল রপ্তানি করেও দেশটি উল্লেখযোগ্য অর্থ উপার্জন করে থাকে। কলম্বিয়ার মোট আয়তন ১১ লাখ ৪১ হাজার ৭৪৮ বর্গকিলোমিটার।
২০২৪ সালের পরিসংখ্যান অনুসারে মোট জনসংখ্যা পাঁচ কোটি ২৬ লাখ ৯৫ হাজার ৯৫২ জন, যাদের বেশির ভাগ খ্রিস্টধর্মের অনুসারী। ধারণা করা হয়, কলম্বিয়ায় মুসলমানের সংখ্যা ৮০ হাজার থেকে এক লাখ। তবে সরকারি পরিসংখ্যানে মুসলমানের সংখ্যা দেখানো হয় ১০ থেকে ১৫ হাজার মাত্র।
গবেষকদের দাবি, খ্রিস্টপূর্ব ১৫০০০-১২০০০ অব্দে কলম্বিয়ায় মানুষের বসবাস শুরু হয়। কেননা সেখানে খ্রিস্টপূর্ব ৮০০০ অব্দের প্রত্নতাত্ত্বিক নিদর্শন পাওয়া গেছে। খ্রিস্টীয় ১৬ শতকে কলম্বিয়ায় ইউরোপিয়ানদের আগমন ঘটে। ১৬ থেকে ১৯ শতক পর্যন্ত কলম্বিয়া স্পেনের একটি উপনিবেশ ছিল। ১৮১৯ সালে কলম্বিয়া স্বাধীনতা লাভ করে।
কলম্বিয়ার মানুষ স্প্যানিশ উপনিবেশের মাধ্যমের ইসলামের সঙ্গে পরিচিত হয়। স্পেন থেকে বাধ্যতামূলক নির্বাসনে পাঠানো মুসলিমদের কারো কারো কলম্বিয়ায় ঠাঁই হয়েছিল। এ ছাড়া দীর্ঘকাল মুসলিম শাসনাধীন থাকার কারণে স্পেনের সমাজ ও সংস্কৃতির সঙ্গে ইসলাম ওতপ্রোতভাবে মিশে ছিল।
মুসলিম সংস্কৃতির প্রতি কলম্বিয়ানদের বিশেষ আগ্রহ ছিল। লেখক, কবি ও সাহিত্যিকদের কেউ কেউ ইসলামি সংস্কৃতির প্রতি নিজেদের আগ্রহও প্রকাশ করেন। যেমন ডন অ্যাজুকিয়াল ও অ্যারিকোশা। স্প্যানিশ উপনিবেশ শেষ হলে সমাজ ও রাষ্ট্রের ওপর চার্চের প্রভাব কমে। তখন লেখক, কবি ও সাহিত্যিকদের অনেকেই ইসলামি সভ্যতা ও সংস্কৃতির উচ্চ প্রশংসাও করেন। তাদের মধ্যে কেউ কেউ আরবিতে কথাও বলতেন। যেমন ডন অ্যাজুকিয়াল, ফিনো, জোসে কারভো প্রমুখ।
তবে ধর্ম হিসেবে ইসলামের বিস্তার ঘটে গত শতাব্দীর মধ্যভাগে। প্রথম বিশ্বযুদ্ধের পর বাস্তুচ্যুত বহু আরব লাতিন আমেরিকার অন্যান্য দেশের মতো কলম্বিয়ায়ও আশ্রয় নেয়। তাদের বেশির ভাগ ছিল সিরিয়ার অধিবাসী। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর ১৯৫১ সালে সিরিয়া, লিবিয়া ও ফিলিস্তিনের আরো একদল মুসলিম কলম্বিয়ায় আশ্রয় নেয়। আবার কলম্বিয়ানদের অনেকেও ধর্মান্তরিত হয়ে মুসলিম হয়েছে।
কলম্বিয়ান মুসলিমদের বেশির ভাগ রাজধানী বোগোটা, মাইকাও, বানকিনা, কালি, সান অ্যান্ড্রিস দ্বীপ ও সান্তামারতায় বসবাস করে। রাজধানী বোগোটার পর সবচেয়ে বেশি মুসলিম বসবাস করে মাইকাও শহরে। এখানে এক হাজারেরও বেশি মুসলিম বসবাস করে।
কলম্বিয়ান মুসলিমদের একদল আফ্রিকান বংশোদ্ভূত। তাদেরকে স্পেন কাজের জন্য দাস হিসেবে এ দেশে নিয়ে এসেছিল। তাদের বেশির ভাগ বুবোনা বন্দরে বসবাস করে। কলম্বিয়ায় ইসলাম প্রচারে এসব আফ্রিকান দাসের গুরুত্বপূর্ণ অবদান রয়েছে। কলম্বিয়ান মুসলিমদের বেশির ভাগ ব্যবসা ও হালকা শিল্পের সঙ্গে জড়িত। তাই তাদের আর্থিক অবস্থাও ভালো।
কলম্বিয়ায় ইসলাম আগমনের প্রায় ১০০ বছর অতিবাহিত হলেও সেখানে খুব বেশিদিন ইসলামি সংস্থা, সংগঠন ও প্রতিষ্ঠান গড়ে ওঠেনি। গত শতকের আশির দশকে কলম্বিয়ায় আরব বিশ্বসহ মুসলিম বিশ্বের বিভিন্ন মিশনারি দল, রাষ্ট্রদূত ও আলেমদের আগমন শুরু হয়। তাদের অনুপ্রেরণায় কলম্বিয়ান মুসলিমরা সংঘবদ্ধ হতে আরম্ভ করে। তারই ধারাবাহিকতায় মাইকাও শহরে ১৯৯০ সালে একটি মসজিদ ও মডেল স্কুল প্রতিষ্ঠিত হয়।
দারুল আরকাম নামের এই স্কুলে বর্তমানে এক হাজার ২০০ শিক্ষার্থী লেখাপড়া করে। মুসলিম শিক্ষকের অভাবে সেখানে অমুসলিম শিক্ষকও নিয়োগ দিতে হয়েছে। সবচেয়ে দুঃখের বিষয় হলো, সেখানে আরবি ভাষা এবং ইসলামের ইতিহাস ও সংস্কৃতি শিক্ষা দেওয়ার মতো পর্যাপ্ত লোক নেই।
ইসলামিক ওয়েলফেয়ার অ্যাসোসিয়েশন নামক ইসলামি সেবা সংস্থার সদর দপ্তর মাইকাও শহরেই অবস্থিত। সংস্থাটি ১৪১০ হিজরি থেকে রমজানে একটি টেলিভিশন অনুষ্ঠান পরিচালনা করে আসছে। শহরে একটি মুসলিম কবরস্থানও আছে। মাইকাওয়ে অবস্থিত ওমর বিন খাত্তাব (রা.) মসজিদ লাতিন আমেরিকার তৃতীয় বৃহত্তম মসজিদ।
কলম্বিয়ায় মুসলিমরা স্বাধীনভাবে ধর্মচর্চা করে থাকে। রাজধানীর বাইরেও শহরে মসজিদ ও পৃথক মুসলিম শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান রয়েছে।