ইতিকাফ বিষয়ে ১৫টি মাসয়ালা
ইসলামি শরিয়তের পরিভাষায় যে মসজিদে পাঁচ ওয়াক্ত নামাজ জামাতসহকারে নিয়মিত আদায় করা হয়- এমন মসজিদে মহান আল্লাহর ইবাদতের উদ্দেশ্যে নিয়তসহকারে অবস্থান করাকে ইতিকাফ বলে। ইতিকাফ সহিহ-শুদ্ধভাবে পালনের জন্য মাসয়ালা জানা জরুরি। আজ থাকছে এমন জরুরি ১৫টি মাসয়ালা।
খাবার পৌঁছে দেওয়ার মতো কেউ না থাকলে নিজের খাবার নিজে আনতে পারবেন
ইতিকাফকারীকে মসজিদে খাবার পৌঁছে দেওয়ার মতো কেউ না থাকলে খাবার আনার জন্য তিনি বাসায় যেতে পারবেন। এ কারণে ইতিকাফ ভাঙবে না। তবে খাবার আনার জন্য মসজিদ থেকে বের হয়ে অন্য কোনো কাজে বিলম্ব করা যাবে না। অন্য কাজে অল্প সময় ব্যয় করলেও ইতিকাফ ভেঙ্গে যাবে। অবশ্য ঘটনাক্রমে খাবার প্রস্তুত না হলে সেজন্য অপেক্ষা করতে পারবেন। -আল বাহরুর রায়েক: ২/৩০৩
কোনো মসজিদে একজনও ইতিকাফ না করলে পুরো মহল্লাবসাী গোনাহগার হবেন
রমজান মাসের শেষ দশ দিন ইতিকাফ করা সুন্নতে মুয়াক্কাদা আলাল কিফায়া। যদি কোনো মসজিদে এক জনও ইতিকাফে বসেন তাহলে এলাকাবাসী সুন্নত ছেড়ে দেওয়ার গোনাহ থেকে বেঁচে যাবেন। আর যদি একজনও ইতিকাফ না করে তাহলে ওই এলাকার সবাই গোনাহগার হবেন। -খুলাসাতুল ফাতাওয়া: ১/২৬৭
ইতিকাফ বিনিময়যোগ্য ইবাদত নয়
ইতিকাফ একটি ইবাদত, যা বিনিময়যোগ্য নয়। তাই ইতিকাফের জন্য পারিশ্রমিক নেওয়া জায়েয নয়। কাউকে পারিশ্রমিকের বিনিময়ে ইতিকাফ করালে সে ইতিকাফ সহিহ হবে না। অতএব এ জাতীয় ইতিকাফ দ্বারা এলাকাবাসী দায়িত্বমুক্ত হতে পারবেন না। -ফাতহুল কাদির: ২/৩০৪
ইতিকাফরত ব্যক্তি প্রাকৃতিক প্রয়োজন পূরণে বাইরে গেলে কুশল বিনিময় করতে পারবেন
ইতিকাফরত ব্যক্তি পেশাব-পায়খানার জন্য মসজিদের বাইরে গেলে আসা-যাওয়ার পথে পথ চলতে চলতে সালাম আদান-প্রদান করতে পারবেন। তদ্রূপ এ সময় পথ চলতে চলতে কারও সঙ্গে অল্পস্বল্প কথাও বলতে পারবেন। এতে ইতিকাফের কোনো ক্ষতি হবে না। উম্মুল মুমিনিন হজরত আয়েশা (রা.) থেকে বর্ণিত আছে, তিনি বলেন, হজরত রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইতিকাফ অবস্থায় চলতে চলতে রোগীর কুশলাদি জিজ্ঞেস করতেন। কিন্তু এর জন্য রাস্তায় দাঁড়াতেন না। -সুনানে আবু দাউদ: ২৪৭২
তবে কারও সঙ্গে কথা বলা বা কুশলাদি জিজ্ঞাসার জন্য মসজিদের বাইরে অল্প সময়ও দাঁড়ানো জায়েজ হবে না।
মসজিদের বাথরুম না থাকলে বাসায় যেয়ে প্রয়োজন পূরণ করার সুযোগ আছে
প্রস্রাব-পায়খানার প্রয়োজন মেটাতে ইতিকাফকারীর জন্য মসজিদের বাইরে যাওয়া জায়েজ। প্রয়োজনে এ জন্য বাসা-বাড়িতেও যাওয়া যাবে। উম্মুল মুমিনিন হজরত আয়েশা (রা.) বলেন, হজরত রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইতিকাফরত অবস্থায় ইস্তিঞ্জার প্রয়োজন ব্যতীত ঘরে প্রবেশ করতেন না। -সহিহ বোখারি: ১/২৭২
বিনিময় নিয়ে ইতিকাফ করা ও করানো নাজায়েজ
বিনিময় নিয়ে ইতিকাফ করা বা করানো সম্পূর্ণ নাজায়েজ। কারণ ইতিকাফ একটি ইবাদত। আর ইবাদতের বিনিময় দেওয়া-নেওয়া নাজায়েজ। এমন লোকের ইতিকাফ দ্বারা সুন্নতে মুয়াক্কাদা (কেফায়া) এর দায়িত্ব আদায় হবে না। -সুনানে জামে তিরমিজি: ১/৫১
বুঝমান নাবালেগের ইতিকাফ সহিহ
বুঝমান নাবালেগের ইতিকাফ সহিহ। তবে প্রাপ্তবয়স্কদের মধ্য থেকেই ইতিকাফে বসা উচিত। কেননা রমজানের শেষ দশকের ইতিকাফ অত্যন্ত ফজিলতপূর্ণ ইবাদত। হজরত রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তা গুরুত্ব সহকারে আদায় করতেন। তাই এ ব্যাপারে উদাসীনতা মোটেই ভালো নয়। -বাদায়েউস সানায়ে: ২/২৭৪
পুরুষের ইতিকাফ শুদ্ধ হওয়ার জন্য মসজিদ হওয়া জরুরি
পুরুষের ইতিকাফ সহিহ হওয়ার জন্য শরঈ মসজিদ হওয়া জরুরি। নামাজঘরে ইতিকাফ সহিহ হবে না। তাই ইতিকাফে বসতে চাইলে মসজিদেই বসতে হবে। খানা আনা-নেওয়ার জন্য কেউ না থাকলে ইতিকাফ অবস্থায় খানা-নেওয়ার জন্য বাড়ি যেতে পারবেন। তবে খানা নিয়ে দ্রুত মসজিদে ফিরে যেতে হবে। বাইরে বিলম্ব করা যাবে না। -ফাতাওয়া হিন্দিয়া: ১/২১১
নারীর ইতিকাফের জন্য জায়গা নির্দিষ্ট করা জরুরি
নারীর ইতিকাফ করার জন্য বাসার একটি কক্ষকে নামাজঘর হিসেবে নির্দিষ্ট করে নিতে হবে এবং ইতিকাফের পূর্ণ সময় এ ঘরেই অবস্থান করতে হবে। -ফাতাওয়া হিন্দিয়া: ১/২১১
কোনো অস্থায়ী মসজিদে ইতিকাফ শুদ্ধ হবে না
কোনো অস্থায়ী নামাজের ঘর যেহেতু ‘শরঈ মসজিদ’ নয় তাই তাতে ইতিকাফ সহিহ হবে না। ইতিকাফ সহিহ হওয়ার জন্য ‘শরঈ মসজিদ’ হওয়া জরুরি। কোরআনে কারিমে ইরশাদ হয়েছে, ‘তোমরা মসজিদে ইতিকাফরত অবস্থায় তাদের (স্ত্রীদের) সঙ্গে মিলিত হয়ো না। -সূরা বাকারা: ১৮৭
ইমাম কুরতুবি (রহ.) এ আয়াতের ব্যাখ্যায় বলেন, মসজিদ ছাড়া অন্যস্থানে ইতিকাফ সহিহ হবে না। -ফাতাওয়া তাতারখানিয়া: ৩/৪৪২
ইতিকাফের কাজা আদায়ের পদ্ধতি
কেউ রমজানের শেষ দশকের ইতিকাফে বসে অসুস্থতার দরুণ শেষ পর্যন্ত পূরণ করতে পারেনি। এক্ষেত্রে তাকে একদিনের ইতিকাফ কাজা করতে হবে। আর তা রমজানেও হতে পারে। এজন্য সে কোনো একদিন সূর্যাস্তের পর থেকে পরের দিন সূর্যাস্ত পর্যন্ত মসজিদে ইতিকাফ করবে। অবশ্য রমজানের বাইরে ইতিকাফটি কাজা করতে চাইলে দিনের বেলা নফল রোজা রাখতে হবে। -রদ্দুল মুহতার: ২/৪৪৪-৪৪৫
ইতিকাফরত ব্যক্তি সাধারণ গোসলের জন্য বের হতে পারবে না
রমজান মাসের শেষ দশকের ইতিকাফরত ব্যক্তি সাধারণ গোসলের জন্য মসজিদ থেকে বের হতে পারবেন না। বের হলে ইতিকাফ নষ্ট হয়ে যাবে। তবে ফরজ গোসলের জন্য বের হতে পারবেন। -ফাতাওয়া হিন্দিয়া: ১/২১২
এক কথায়, অভ্যাসবশত দৈনিকের গোসলে জন্য মসজিদের বাইরে যাওয়া যাবে না। তবে হ্যাঁ, একান্তই যদি বেশি সমস্যা হয় তাহলে মলমূত্র ত্যাগ করে আসার সময় সুন্দরভাবে অজু করতে যে সময় লাগে ঠিক ওই সময়ের মধ্যে যদি তাড়াহুড়ো করে গোসল করা সম্ভব হয় তবে অজু না করে সময়ের এ শর্ত মেনে গোসল করা যেতে পারে। বিষয়টি খুবই ঝুঁকিপূর্ণ বটে। যা অত্যন্ত সতর্কতার দাবি রাখে।
আবার এর জন্য সহযোগীও দরকার যে আগে থেকেই পানির ব্যবস্থা করে রাখবে, গোসলের পরে কাপড় ধোঁয়ে দেবে। অজুখানায় শাওয়ার থাকলে বিষয়টি কিছুটা সহজ হয়।
ইতিকাফকারী জানাজার নামাজে শরিক হতে পারবেন না
জানাজার উদ্দেশ্যে মসজিদ থেকে বের হলেও ইতিকাফ থাকে না। তাই ইতিকাফ অবস্থায় মসজিদের বাইরের জানাজার নামাজে শরিক হওয়া যাবে না। বের হলে সুন্নত ইতিকাফ নষ্ট হয়ে যাবে। -সুনানে আবু দাউদ: ২৪৬৫
নারী ইতিকাফ শুরুর পর তার স্রাব শুরু হলে করণীয়
কোনো নারী নিজ ঘরে সুন্নত ইতিকাফ শুরুর তিন দিন পর তার মাসিক শুরু হলে ইতিকাফ ভেঙ্গে যাবে। যে দিন মাসিক শুরু হয়েছে শুধু সেই একদিনের ইতিকাফ কাজা করে নেওয়া জরুরি। এই এক দিন কাজা করার নিয়ম হলো- একদিন সূর্যাস্তের আগে ইতিকাফ শুরু করতে হবে। পরবর্তী দিন রোজা থাকতে হবে। সূর্যাস্তের পর ইতিকাফ শেষ হবে। এভাবে একদিন রোজাসহ ইতিকাফ করলেই কাজা আদায় হয়ে যাবে। পুরো দশ দিনের ইতিকাফ কাজা করতে হবে না। -ফাতাওয়া হিন্দিয়া: ১/২০৭
সুন্নত ইতিকাফের জন্য রোজা রাখা শর্ত। উম্মুল মুমিনিন হজরত আয়েশা (রা.) থেকে বর্ণিত আছে, নবী করিম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন, রোজা ছাড়া ইতিকাফ হয় না। -সুনানে বায়হাকি: ৪/৩১৭
অন্য বর্ণনায় আছে, সাহাবি আবদুল্লাহ ইবনে আব্বাস (রা.) বলেন, ইতিকাফকারীর জন্য রোজা রাখা আবশ্যক। -মুসান্নাফ ইবনে আবি শাইবা: ৬/৩০০
ইতিকাফের ফজিলতে অতিরঞ্জিত কথা কাম্য নয়
ইতিকাফের ফজিলত বলতে যেয়ে অনেকে অতিরঞ্জিত করে ফেলেন। কেউ কেউ বলেন, যে ব্যক্তি রমজানের দশদিন ইতিকাফ করল সে যেন দুই হজ ও দুই উমরা করলো। ইতিকাফের ফজিলত বলতে যেয়ে এসব বর্ণনা গ্রহণযোগ্য নয়। তাই এগুলো মানুষের মাঝে বর্ণনা করা থেকে বিরত থাকতে হবে।
তবে রমজানের শেষ দশকের ইতিকাফ অত্যন্ত ফজিলতপূর্ণ সুন্নত আমল। হজরত রাসূলুল্লাহ সালালাহু আলাইহি ওয়াসালাম অত্যন্ত গুরুত্বসহকারে শেষ দশকে ইতিকাফ করতেন। বিশুদ্ধ হাদিস দ্বারা তা প্রমাণিত। এক রমজানে কোনো কারণে তিনি ইতিকাফ করতে পারেননি। তাই পরবর্তী বছর তিনি বিশদিন ইতিকাফ করেছেন। -সুনানে আবু দাউদ: ২৪৬৮