ফরিদপুরের গেরদায় নবীর সা. কেশ ও বড় পীরের জুব্বা
ফরিদপুর থেকে ফিরে: হজরত শাহ আলী বাগদাদী (রহ.) ইরাক থেকে ভারতবর্ষ আসার সময় দুষ্প্রাপ্য কিছু সম্পদ সঙ্গে করে নিয়ে আসেন। এর মধ্যে রয়েছে, হজরত মুহাম্মদ (সা.)-এর পবিত্র কেশ, হজরত আলী (রা.)-এর গোঁফ, হজরত ইমাম হাসান (রা.) ও হজরত ইমাম হোসাইন (রা.)-এর জুলফ (কানের দু'পাশের দাড়ির ওপরের অংশের চুল) এবং বড়পীর হজরত আবদুল কাদের জিলানী (রহ.)-এর গায়ের জোব্বা।
এই বরকতময় জিনিসগুলো এখনও ফরিদপুরের গেরদার একটি মসজিদ সংলগ্ন বিশেষ রুমে সংরক্ষিত রয়েছে।
সুলতানি আমলে বাংলাদেশে যে কয়েকজন মুসলিম সুফি-সাধকের আগমন ঘটেছিল, তাদের অন্যতম হলেন হজরত শাহ আলী বাগদাদী রহমাতুল্লাহি আলাইহি।
ইসলাম প্রচারের উদ্দেশ্যে শাহ আলী (রহ.) ৮১৩-১৪ হিজরিতে (১৪১২ খ্রিস্টাব্দে) বাগদাদ থেকে ৪০ জন মতান্তরে শতাধিক আত্মীয়-স্বজন, ধর্মীয় সাধক ও শিষ্যসহ দিল্লি হয়ে ফরিদপুরের (ফতেহাবাদ) গেরদাতে আসেন। স্থানীয়দের কাছে ঢোলসমুদ্র বলে খ্যাত নদী তীরবর্তী জঙ্গলময় স্থান গেরদা। পরবর্তীতে ঢাকার মিরপুরে আস্তানা স্থাপন করেন। সেখানেই তিনি ইন্তেকাল করেন। মিরপুরে হজরত শাহ আলী বাগদাদী (রহ.)-এর মাজার অবস্থিত।
ঢোলসমুদ্র বলতে মূলত নদী সংলগ্ন বিল এলাকাকে বুঝানো হয়। স্থানীয়ভাবে এটাকে বাওর বলা হয়। আর গেরদা শব্দটি ফারসি। এর অর্থ- উপশহর বা শহরতলি। যেহেতু স্থানটি ফরিদপুর শহর থেকে দক্ষিণ পশ্চিমে কিছুটা (তিন মাইল) দূরে অবস্থিত, তাই এটাকে উপশহর বলা হয়।
উপশহর হলেও গেরদা এখনও অনেকটা নিভৃত পল্লীর মতো। ফরিদপুর শহর ঘেঁষে বেয়ে চলা কুমার নদের তীরবর্তী পিচঢালা পাকা রাস্তা সংযুক্ত করেছে গেরদাকে। হজরত শাহ আলী বাগদাদী (রহ.)-এর আগমনের কারণে গেরদা বিশেষ স্থানের মর্যাদায় আসীন। তার সম্মানে তৎকালীন দিল্লির সুলতান ফরিদপুর জেলার অন্তর্গত ঢোলসমুদ্র নামক স্থানের বার হাজার বিঘা ভূমিকে করমুক্ত বলে ঘোষণা করেছিলেন।
মসজিদটির বর্তমান নাম ‘ঐতিহ্যবাহী গেরদা দরগাহ বাড়ি জামে মসজিদ।’ জনশ্রুতি আছে, এখানে শাহ আলী বাগদাদী (রহ.) একটি মসজিদ নির্মাণ করেন। তার মৃত্যুর পর সেই মসজিদের ভগ্নাবশেষের ওপর আরেকটি মসজিদ নির্মাণ করা হয় হিজরি ১০১৩ সনের দিকে। কালের আবর্তনে সেই মসজিদটিও ধ্বংস হয়ে যায় নদীগর্ভে এবং স্থানটি ধীরে ধীরে জঙ্গলে ঢাকা পড়ে। দীর্ঘদিন পর নতুন মসজিদ নির্মাণের উদ্যোগ নেওয়া হয়।
এখনও পুরনো ওই মসজিদের অখণ্ড পাথরের তৈরি পিলারসহ অনেক নিদর্শন অক্ষত রয়েছে। নতুন মসজিদের দুই প্রবেশপথে অখণ্ড পাথরের চারটি পিলারের অংশবিশেষ শোভা পাচ্ছে। এ ছাড়া মসজিদের আশপাশে পুরনো মসজিদের ভাঙ্গা ইট-পাথরের টুকরা ছড়িয়ে-ছিটিয়ে রয়েছে। যা থেকে অনুমান করা চলে, এখানে একটি পুরনো মসজিদ ছিল। এ ছাড়া নতুন মসজিদের প্রদর্শনী কক্ষের সামনে একটি পাথর ফলক লাগানো রয়েছে। ওই ফলকে লেখা রয়েছে, ১০১৩ হিজরি। এর দ্বারা অনুমান করা যায়, শাহ আলী বাগদাদী রহ.-এর মৃ্ত্যুর পর এখানে একটি মসজিদ নির্মাণ করা হয়েছিল। কিংবা হতে পারে হজরত শাহ আলীর আমলের মসজিদটি তখন সংস্কার করা হয়েছিল। তবে ওই মসজিদটিতে জুমার নামাজ হতো। কারণ শিলালিপিতে সূরা জুমার যে আয়াতটি লেখা রয়েছে, ওই আয়াত দ্বারা মানুষকে জুমার নামাজে আসার আহবান জানানো হয়েছে।
আরবি ও ফার্সি ভাষায় লেখা পাথরের ফলকটি (১২ ইঞ্চি X ৩৬ ইঞ্চি) ১০১৩ হিজরি বা ১৬০৪ খ্রিস্টাব্দে লেখা। ফলকটি বর্তমানে নতুন নির্মিত মসজিদের (২২ মি X ১১ মি) পশ্চিম দেয়ালে লাগানো আছে।
মসজিদটির নির্মাণ কাজ ১৯৭৮ সালে শুরু হয়। মসজিদের সামনে থাকা ফলকে লেখা রয়েছে, হজরত শাহ আলী বাগদাদী (রহ.) কর্তৃক আনীত রাসূলে কারীম (সা.), হজরত আলী (রা.), হজরত ইমাম হাসান (রা.), হজরত ইমাম হোসাইন (রা.), হজরত শেখ আবদুল কাদের জিলানী (রহ.) এবং অন্যান্য পূণ্যাত্মাদের পবিত্র নিদর্শনাদি সংরক্ষণের উদ্দেশ্যে মসজিদটি নির্মাণ করা হয়েছে। এই মসজিদের ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন করেন জাতীয় অধ্যাপক প্রফেসর সৈয়দ আলী আহসান।
এই পবিত্র সম্পদগুলোর সঙ্গে যোগ হয়েছে হজরত শাহ আলী বাগদাদী (রহ.)-এর জায়নামাজ, পাগড়ি, মাছের দাতের তসবিহ, চন্দন কাঠের খাবার খাওয়ার পাত্র। রয়েছে হজরত শাহ মাদার (রহ.)-এর গায়ের ফতুয়া।
এগুলো বছরে ৫ বার সাধারণ মানুষের জন্য উন্মুক্ত করা হয়। দূর-দূরান্ত থেকে দর্শনার্থীরা এসব বরকতময় জিনিসগুলো দেখতে আসেন। যে পাঁচদিন জিনিসগুলো দেখানো হয়- ১২ রবিউল আউয়াল, শবে মেরাজ, ১১ রবিউস সানি ফাতেহা ইয়াজদাহম (গাউসুল আজম বড় পীর হজরত আবদুল কাদের জিলানি (রহ.)-এর মৃত্যু দিবস), ঈদুল ফিতর ও ঈদুল আজহার দিন।
এ ছাড়া বিশেষ কেউ আসলে কিংবা আগে থেকে মসজিদ কর্তৃপক্ষের অনুমতি সাপেক্ষে স্মৃতিবহ জিনিসপত্রগুলো দেখার সুযোগ মেলে।
মসজিদ কমিটির সেক্রেটারি সাইয়্যেদ সালিম রেজা। শাহ আলী (রহ.)-এর ১২তম অধস্তন পুরুষ। তার কাছে প্রশ্ন ছিলো এসব জিনিস সম্পর্কে। তিনি বলেন, হজরত শাহ আলী বাগদাদী (রহ.)-এসব জিনিস সঙ্গে করে নিয়ে এসেছিলেন। তিনি কতদিন গেরদা ছিলেন? এ প্রশ্নের জবাবে সালিম রেজা জানান, তিনি এখানেই থাকতেন। এখানে বিয়ে-শাদি করেছিলেন। দাওয়াতি কাজে মিরপুর যান এবং সেখানে ইন্তেকাল করেন। শাহ আলী বাগদাদী (রহ.)-এর দুই ছেলের কবরও রয়েছে গেরদাতে। মসজিদ সংলগ্ন দিঘীর পশ্চিম পাশে বড় ছেলে শাহ উসমান (রহ.)-এর কবর ও আরেক ছেলে হজরত শাহ হানিফ (রহ.)-এর কবর মসজিদের উত্তর পাশে রয়েছে।