বিধবা বিয়ের ব্যবস্থা অশেষ সওয়াবের কাজ
যে নারীর স্বামী মারা গেছেন তাকে বিধবা বলা হয়। জাতিসংঘের এক সমীক্ষায় পৃথিবীতে ২৮ কোটি বিধবা রয়েছে বলে জানা গেছে। যাদের দশজনে একজন চরম দারিদ্র সীমার নিচে বাস করেন। যেকোনো নারীর জন্য স্বামীর মৃত্যু খুবই বেদনাদায়ক বিষয়। প্রিয়তম স্বামী হারিয়ে একজন বিধবা যখন অসহায়, তখন সামাজিক কিছু বাধ্যবাধকতা ওই বিধবার জন্য বাড়তি চাপ তৈরি করে।
অনেক বিধবার স্থান স্বামীর বাড়িতে হয় না। তাকে স্বামীর উত্তরাধিকার থেকে বঞ্চিত করা হয়। ফলে তাকে বাধ্য হয়ে বাপ-ভাই কিংবা অন্য আত্মীয়-স্বজনের আশ্রয়ে থাকতে। ইদানিং অবশ্য অনেকে একা থাকেন, কেউ আবার বৃদ্ধাশ্রমে চলে যান। তবে এ সংখ্যা খুবই কম। স্বামীর বাড়ি হোক আর যেখানেই হোক ও্ বিধবা নারীকে অনেক সময়ই খাওয়ার সময় ডাকা হয় না, নিষিদ্ধ করা হয় পুষ্টিকর খাবার। কাপড় পরিধান থেকে শুরু সাজ-গোজ, খাবার-দাবার ও চলাফেরায় নেমে আসে নানারকম বিধিনিষেধ। যদিও এখন অনেক বিধবা আর এসব রীতি মানেন না। তবে যারা দরিদ্র তারা সে সাহস দেখাতে পারেন না, বাধ্য হয়ে এখনও তাদের সেসব মানতে হয়।
এক কথায়, বিধবাদের সঙ্গে যেসব অমানবিক আচরণ করা হয়, তা মানবাধিকার লঙ্ঘনের সমান। তবে দেরিতে হলে বিভিন্ন দেশে বিধবাদের অধিকার ফিরিয়ে দিতে কিংবা সমাজে তাদের পুনর্বাসন করতে নানা পদক্ষেপ নেওয়া হচ্ছে। কোনো কোনো দেশে তো বিধবা বিবাহে উৎসাহিত করার লক্ষ্যে সরকার নানা সুবিধা দেওয়ার কথা ঘোষণা করেছে। যদিও ১৮৫৬ সালে ঈশ্বর চন্দ্র বিদ্যাসাগরের প্রচেষ্টায় ব্রিটিশ আমলে তৈরি হয় বিধবা বিবাহ আইন। স্বামীহারা অগণিত নারীদের ভবিষ্যতের কথা ভেবে বিধবা বিবাহ চালু করতে উদ্যোগী হয়েছিলেন বিদ্যাসাগর। এই প্রথায় তৎকালীন সমাজকে উৎসাহিত করতে নিজের ছেলের সঙ্গেও একজন বিধবা নারীর বিয়ে দিয়েছিলেন তিনি।
বিদ্যাসাগরের এই উদ্যোগের অনেক আগে থেকেই ইসলাম বিধবা নারীদের কল্যাণে কাজ করে যাচ্ছে। জীবনসঙ্গী হারানোর পর একজন মানুষ যখন প্রবলভাবে নিঃসঙ্গ হয়ে যান, সেখানে সামাজিকতা কিংবা প্রথা মানার দোহাই দিয়ে নারীকে এভাবে কষ্ট দেওয়া ইসলাম সমর্থন করে না। ইসলামের দৃষ্টিতে বিধবার রয়েছে, সব ধরনের অধিকার। স্বামীর সম্পদে তার বৈধ অধিকার রয়েছে, সমাজে তার গুরুত্ব আছে। ইচ্ছে করলে তিনি পুনরায় বিয়ে করার অধিকার রাখেন।
এতিম, মিসকিন ও বিধবাদের প্রয়োজন পূরণে সহযোগিতা করা হাদিসের ভাষায় জিহাদ ফি সাবিলিল্লাহ এবং দিনের বেলায় রোজা রাখা ও রাতেরবেলায় নফল নামাজ আদায়ের সমতুল্য। এ প্রসঙ্গে এক হাদিসে আছে, হজরত আবু হুরায়রা (রা.) থেকে বর্ণিত, হজরত রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেছেন, যে ব্যক্তি স্বামীহীন নারী ও মিসকিনদের সহযোগিতার জন্য পরিশ্রম করে সে আল্লাহর রাস্তায় জিহাদকারীর মতো এবং ওই ব্যক্তির সমতুল্য যে দিনের বেলায় রোজা রাখে এবং রাতেরবেলায় নফল নামাজ আদায় করে। -সহিহ বোখারি: ৫৩৫৩, ৬০০৬-৭
অন্য আরেক হাদিসে নবী করিম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেছেন, ‘স্বপ্নে আমি জান্নাতে প্রবেশ করলাম, সেখানে নুয়াইমের কাশির শব্দ শুনতে পেলাম।’ -জামেউল মাসানিদ: ৯৫৭৫
হাদিসের ব্যাখ্যাকাররা বলেছেন, হজরত নুয়াইম ইবনে আবদুল্লাহ (রা.) ইচ্ছা ও প্রস্তুতি সত্ত্বেও হিজরতের মতো অতি গুরুত্বপূর্ণ আমল পরিত্যাগ করেছেন এতিম ও বিধবাদের সাহায্য-সহযোগিতার জন্য। ইসলামের দৃষ্টিতে এটি অত্যন্ত মাহাত্ম্যপূর্ণ ও ফজিলতপূর্ণ কাজ। কোরআন-হাদিসে এতিম, মিসকিন ও বিধবাদের সাহায্য-সহযোগিতা, দান-সদকা ও তাদের প্রতি সদয় আচরণের খুব তাগিদ দেওয়া হয়েছে এবং অসীম পূণ্য ও উত্তম প্রতিদানের প্রতিশ্রুতি দেওয়া হয়েছে। ওই সাহাবির আমল এবং তার জান্নাত লাভের সুসংবাদ তার একটি প্রকৃষ্ট উদাহরণ।
নবী করিম (সা.)-এর স্ত্রীদের মধ্যে হজরত আয়েশা (রা.) ছাড়া অন্য সব স্ত্রী ছিলেন বিধবা কিংবা তালাকপ্রাপ্ত। কোরআনে কারিমে বিধবা নারীদের বিয়ে সম্পর্কে বলা হয়েছে, ‘আর তোমাদের মধ্যে যারা মৃত্যুবরণ করবে এবং তাদের নিজেদের স্ত্রীদের রেখে যাবে, সে স্ত্রীদের কর্তব্য হলো- নিজেরা চার মাস দশ দিন পর্যন্ত অপেক্ষা (ইদ্দত পালন) করবে। তারপর যখন ইদ্দত পূর্ণ করে নেবে, তখন নিজের ব্যাপারে নীতি সঙ্গত ব্যবস্থা নিলে কোনো পাপ নেই। আর তোমাদের যাবতীয় কাজের ব্যাপারেই আল্লাহর অবগতি রয়েছে।’ -সূরা বাকারা: ২৩৪
বিধবার অধিকারের বিষয়ে কোরআনে কারিমে ইরশাদ হচ্ছে, ‘হে ঈমানদারগণ! নারীদের জোরপূর্বক উত্তরাধিকারের পণ্য হিসেবে গ্রহণ করা তোমাদের জন্য বৈধ নয় এবং তোমরা তাদের যা প্রদান করেছ তার কোনো অংশ তাদের কাছ থেকে নিয়ে নেওয়ার জন্য তাদের আটকে রেখো না; যতক্ষণ পর্যন্ত না তারা ব্যভিচারে লিপ্ত হয় তাদের সঙ্গে সদ্ভাবে জীবনযাপন করো, এমনকি তোমরা যদি তাদের পছন্দ নাও করো, এমনও তো হতে পারে যা তোমরা অপছন্দ করো, তাতেই আল্লাহ অনেক কল্যাণ রেখেছেন।’ -সূরা নিসা: ১৯
বিধবা নারীদের মর্যাদা সম্পর্কে অনেক হাদিস বর্ণিত হয়েছে। হজরত আবু হুরায়রা (রা.) থেকে বর্ণিত, হজরত রাসূলুল্লাহ (সা.) বলেছেন, আমিই ওই ব্যক্তি যার জন্য সর্ব প্রথম জান্নাতের দরজা খোলা হবে। কিন্তু এক মহিলা এসে আমার আগে জান্নাতে যেতে চাইবে। আমি তাকে জিজ্ঞাসা করবো যে, তোমার কি হলো, তুমি কে? তখন সে বলবে, আমি ওই মহিলা যে স্বীয় এতিম বাচ্চার লালন-পালনের জন্য নিজেকে আটকে রেখেছে (বিয়ে করা থেকে)। -মুসনাদে আবি ইয়ালা: ৬৬৫১
যেসব বিধবা বয়সের কারণে বিয়ের যোগ্য নয়, আবার তাদের কোনো সন্তান নেই, সেসব বিধবাদের প্রতি সহযোগিতার হাত বাড়িয়ে দেওয়াকে সওয়াবের কাজ বলে ঘোষণা দিয়েছেন নবী করিম (সা.)।
স্বামীর মৃত্যুর স্বামী ও বাবার উত্তরাধিকার সম্পদ থেকে বঞ্চিত করা কবিরা গোনাহ। আর স্বামীর মৃত্যুর পর পরিবার কর্তৃক তাদের সঙ্গে খারাপ আচরণ করা মোটেই উচিত নয়। কোনো বিধবাকে সারাজীবন বিয়ে ছাড়া একাকী জীবন কাটানোর কোনোরূপ বাধ্যবাধকতা ইসলামে নেই। নবী করিম (সা.) সামাজিক ভ্রাতৃত্ববোধ প্রতিষ্ঠা, মানবিক কারণ, ধর্মীয় শিক্ষার প্রচার-প্রসার ও বিভিন্ন রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটে- বিশেষ করে তৎকালীন আরবের কুসংস্কার উচ্ছেদ করার জন্য এসব বিয়ে করেছিলেন।
বিধবা বিয়ে সম্পর্কে কোরআনে কারিমে নানাভাবে উপদেশ ও উৎসাহ প্রদান করা হয়েছে। ইসলাম বলে বিধবা নারী যাকে খুশি তাকে বিয়ে করতে পারবে। ইসলাম কোনো বিধবাকে ঘৃণা বা অবজ্ঞার চোখে দেখে না। আর বিধবার অন্যত্র বিয়ে হলেও সে আগের স্বামীর উত্তরাধিকার থেকে বঞ্চিত হবে না।
আমাদের দেশে স্বামীর মৃত্যুর পর বিধবাদের বিয়ের ব্যবস্থা না করা একটি অন্যায় চিন্তা। মনে রাখবেন, যাদের তত্ত্বাবধানে কোনো বিধবা রয়েছে তাদের জন্য সর্বাধিক গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব হলো- বাস্তবিক কোনো সমস্যা না থাকলে (সামাজিক প্রতিবন্ধকতা কখনোই কোনো সমস্যা নয়) তার বিয়ের ব্যবস্থা করা। এতে বিভিন্ন উপকারিতার পাশাপাশি রাসূলের সুন্নত পরিপালনের সওয়াবও অর্জিত হবে।