দুই মসজিদের দেশ লাওস
দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার সবুজে ঘেরা আর পাহাড়-পর্বতবেষ্টিত দেশ লাওস। লাওসের নাগরিকদের সংক্ষেপে লাও বলা হয়। দেশটির ৮৫% মানুষ বৌদ্ধ ধর্মে বিশ্বাসী। বাকিরা ভিন্ন ভিন্ন ধর্মের। এশিয়ার মধ্যে লাওস একমাত্র দেশ, যেখানে মুসলিম জনগোষ্ঠীর বসবাস সবচে কম এবং তাদের সংখ্যা ৮০০ জনের মতো।
পুরো লাওসে মাত্র দু’টি মসজিদ আছে। দু’টোই রাজধানী ভিয়েনতিয়েনে। একটির নাম ভিয়েনতিয়েন জামে মসজিদ, অপরটির নাম আল আজহার মসজিদ, যেটাকে স্থানীয়ভাবে ‘মসজিদ অব কম্বোডিয়া’ বলে ডাকা হয়।
রাজধানী ভিয়েনতিয়েনের বুক চিড়ে বয়ে চলেছে মেকং নদী। এই নদীর তীর থেকে কিছুটা দূরে ভিয়েনতিয়েন জামে মসজিদের অবস্থান। এর পাশে ব্রুনেই দূতাবাসের অফিস। এলাকার নাম বান সিং ওয়ান। জমি কিনে পাকিস্তান ও ভারতের মুসলমানরা মসিজদটি নির্মাণ করেন ১৯৭০ সালে। মসজিদ পরিচালনার জন্য রয়েছে একটি কমিটি, এই কমিটি মসজিদ পরিচালনার যাবতীয় ব্যয়, ইমাম-মুয়াজ্জিনের বেতন ইত্যাদি নির্বাহ করেন। ভিয়েততিয়েন জামে মসজিদের মুয়াজ্জিন বাংলাদেশি। নাম হাফেজ হাসান মাহমুদ। তিনি কিশোরগঞ্জের লোক।
৪৮০ মিটারের দোতলা ভিয়েনতিয়েন জামে মসজিদে একত্রে দেড়শ’ মুসল্লি নামাজ আদায় করতে পারেন। মসজিদের ভেতরে নারীদের নামাজের ব্যবস্থা রয়েছে। তা পর্দা দিয়ে আলাদা করা। প্রতি রমজানে শতাধিক রোজাদারকে ভিয়েনতিয়েন মসজিদে ইফতার করানো হয়। ঈদের নামাজের সময় মসজিদে জায়গা হয় না, তখন মসজিদসংলগ্ন রাস্তায় নামাজ আদায় করেন মুসলমানরা। তাতে স্থানীয় বৌদ্ধরা কোনো সমস্যা করে না।
আল আজহার মসজিদটি চার মাইল দূরে পোন সা বাথ থাইয়ে অবস্থিত। মসজিদটি মালয়েশিয়া, কম্বোডিয়া, ইন্দোনেশিয়া এবং ব্রুনেইয়ের মুসলমানরা নির্মাণ করেন ১৯৮৬ সালে। এখানে বাচ্চাদের জন্যে বৈকালিক ইসলামি শিক্ষার ব্যবস্থা রয়েছে।
এই দুই মসজিদ ছাড়া কয়েকটি নামাজের জায়গা রয়েছে। সেখানে শুধু অফিস টাইমে নামাজ আদায় করা হয়। পৃথিবীর অনেক দেশে মসজিদে উচ্চস্বরে আজান নিষিদ্ধ হলেও লাওসের দুই মসজিদেই মাইকে উচ্চস্বরে আজান দেওয়া হয়।
বিশ শতকের প্রথম দিকে দক্ষিণ ভারতের তামিলনাড়ু থেকে মুসলমানরা ফ্রান্সের কলোনী থাকা অবস্থায় লাওসের ভিয়েনতিয়েনে শ্রমিক হিসেবে যান। এখন তাদের উত্তরাধিকাররা ব্যবসায় জড়িত। অন্যদিকে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় পাকিস্তানের পাখতুন প্রদেশের অনেক মুসলমান ব্রিটিশ সেনাবাহিনীর হয়ে বার্মায় যুদ্ধ করেন। বার্মা থেকে তাদের অনেকে লাওসে যান এবং সেখানেই স্থায়ী বসবাস শুরু করেন। পাখতুনদের অনেকেই লাও নারীদের বিয়ে করেন যারা পরবর্তীতে ইসলাম গ্রহণ করেন।
১৯৫৩ সালে লাওস ফ্রান্সের কাছ থেকে স্বাধীনতা লাভ করে। এর কিছুদিন পর আমেরিকার সঙ্গে যুদ্ধে জড়িয়ে পড়ে। চীন ও ভিয়েতনামের সহযোগিতায় কমিউনিস্ট নেতা পেথেট লাও দীর্ঘ যুদ্ধে আমেরিকাকে ফিরে যেতে বাধ্য করে এবং গণপ্রজাতন্ত্রী লাওস ঘোষণা করে।
১৯৬০ সালের দিকে লাওসে এখনকার চেয়ে অনেক বেশি মুসলমানের বসবাস ছিল। কিন্তু যুদ্ধে মুসলমানেরা ব্যাপকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হন এবং অনেকে দেশ ছেড়ে অন্য দেশে আশ্রয় গ্রহণ করেন।
সম্প্রতি তামিল, পাখতুন ও কম্বোডিয়ান বংশোদ্ভূত মুসলমানদের সমন্বয়ে অ্যাসোসিয়েশন অব লাওস টু ওভারসিজ মুসলিম কমিউনিটি নামে একটি সংগঠন প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। যার প্রধান হলেন হাজি মুহাম্মদ রফিক। এ সংগঠন ধর্মীয় নানা বিষয়ে মুসলমানদের পরামর্শ ও সাহায্য-সহযোগিতা করে থাকেন।
লাওসের মুসলমানরা ধর্ম-কর্ম পালনসহ সবকিছুতে সরকারের পূর্ণ সহযোগিতা ও সমর্থন পান। অন্য ধর্মাবলম্বীদের সঙ্গেও তাদের চমত্কার সম্পর্ক বিদ্যমান।
লাওসে কোনো ধর্মীয় সহিংসতা কিংবা উত্তেজনা নেই। দারুণ নিয়মশৃঙ্খলার দেশ লাওস। রাস্তায় কোনো ট্রাফিক নেই। একটু পরপর জ্বলে উঠা লাল-হলুদ-সবুজ বাতি দেখে গাড়ি চলে। চুরিচামারির কোনো ঘটনা নেই দেশটিতে।