ইতিবাচক কাজে বিবেক-বুদ্ধিকে কাজে লাগান
সুস্থভাবে জীবনযাপনের প্রথম পদক্ষেপ হচ্ছে চিন্তাভাবনা ও বিবেক-বুদ্ধিকে কাজে লাগানো। আর চিন্তার প্রধান বিষয় হওয়া উচিত সৃষ্টিকর্তা আল্লাহতায়ালা ও এই সৃষ্টিজগত। আমি মানুষ, আমাকে কে সৃষ্টি করেছেন? কেন সৃষ্টি করেছেন? আমি কি সৃষ্টিকর্তার সৃষ্টির উদ্দেশ্য বাস্তবায়নে কাজ করছি নাকি মন যা চাইছে সেভাবে চলছি? এসব বিষয় মানুষের চিন্তার প্রধান বিষয় হওয়া উচিত।
মানুষ যত বেশি চিন্তাভাবনা করে পথ চলবে, বিবেক-বুদ্ধিকে কাজে লাগাবে; ততবেশি তা শানিত হবে এবং উত্তম উপায়ে জীবনযাপনের ক্ষেত্রে সিদ্ধান্ত নিতে সুবিধা হবে। যাদের চিন্তা শক্তি ও বিবেক শানিত তারা তাদের মনের ওপর সহজেই নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা করতে পারেন এবং জীবনের সব পর্যায় সঠিকভাবে অতিক্রম করতে সক্ষম হন।
ভালোভাবে চিন্তাভাবনা না করে কোনো কাজে হাত দেওয়ার কারণে অনেক মানুষ ব্যর্থ হন। নবী মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামসহ সব নবী-রাসূল চিন্তাশক্তি এবং বিবেককে কাজে লাগানোর নির্দেশ দিয়েছেন। বিবেক হচ্ছে সেই শক্তি, যা দিয়ে মানুষ সত্য উপলব্ধি করতে পারে। এর বিপরীত শক্তি হচ্ছে প্রবৃত্তি। অনেকে এটাকে অনিয়ন্ত্রিত মন হিসেবেও উল্লেখ করে থাকেন।
জ্ঞানীরা বলেন, প্রবৃত্তি হচ্ছে লাগামহীন পশুর মতো। এই নফস মানুষকে যেদিকে ইচ্ছা সেদিকে টেনে নিয়ে যায় এবং জীবনকে সংকটময় করে তোলে। এ কারণে নফসকে বিবেকের মাধ্যমে নিয়ন্ত্রণ করতে হয়। নবী মুহাম্মদ (সা.) বিবেককে অজ্ঞতা থেকে দূরে থাকার সবচেয়ে বড় মাধ্যম হিসেবে উল্লেখ করে বলেছেন, বিবেক হলো- অজ্ঞতার পথ রূদ্ধ করা।
নফসে আম্মারা বা কুপ্রবৃত্তি হচ্ছে সবচেয়ে ঘৃণ্য পশুর মতো। কাজেই তার পায়ে যদি বেড়ি পড়ানো না হয় তাহলে তা দিশেহারার মতো ঘুড়ে বেড়ায়। আর এই নফসে আম্মারার পায়ে বেড়ি হলো এই বিবেক। বিবেকের মাধ্যমে নিজেকে কুপ্রবৃত্তি থেকে মুক্ত রাখতে হবে।
পবিত্র কোরআন ও হাদিসে বলা হয়েছে, বিবেক যদি কোনো কিছুকে সঠিক মনে না করে তাহলে সেটাকে সঠিক মনে করা কিংবা বিশ্বাস করার কোনো অধিকার মানুষের নেই। বিবেক যেসব বৈশিষ্ট্যকে অপছন্দনীয় বলে মনে করে, সেগুলোকে পছন্দনীয় হিসেবে তুলে ধরার এবং যেসব কাজকে মন্দ বলে মনে করে সেগুলো সম্পাদন করার অধিকার মানুষের নেই।
ইসলাম মানুষকে বিবেকবান হিসেবে গড়ে তুলতে চায়। এ কারণে সূরা ইউনুসের ১০০ নম্বর আয়াতে বলা হয়েছে, যারা চিন্তা করে না আল্লাহতায়ালা তাদের ওপর অপবিত্রতা আরোপ করেন। বিবেকের মাধ্যমে মানুষ তার জীবনকে আরও সুন্দর করে সাজাতে পারে। একজন মানুষের সঙ্গে অপর মানুষের পার্থক্য হচ্ছে তার চিন্তা-চেতনা ও বিশ্বাস। প্রতিটি মানুষ তার চিন্তা-চেতনা ও বোধবিশ্বাস অনুযায়ী নিজ নিজ জীবন পরিচালনা করে। সুতরাং তারাই সফল হয়- যারা ইতিবাচক, উন্নত ও সৃজনশীল চিন্তা করে। আর যারা নেতিবাচক চিন্তা করে ও অজ্ঞতার অন্ধকারে ডুবে থাকে তারা তার জীবনকে অন্ধকারের দিকে ঠেলে দেয়।
মানুষের জীবনটা কেমন হবে তার অনেকটাই নির্ভর করে তার নিজের ওপর। মানুষের জীবনে সমস্যা ও সংকট থাকবে। কিন্তু তারা বুদ্ধিমান ও বিবেকবান, যারা এই কঠিন সময় ও পরিস্থিতিতে সৃষ্টিকর্তা আল্লাহতায়ালার ওপর ভরসা রাখেন। আসলে মানুষের চিন্তা ও দৃষ্টিভঙ্গির ওপর অনেক কিছু নির্ভর করে। কোরআনে কারিমে ইরশাদ হয়েছে, ‘অবশ্যই সফলকাম হয়েছে সে ব্যক্তি, যে নিজের আত্মাকে পরিশুদ্ধ করেছে আর সেই বিফলকাম হয়েছে যে নিজেকে পাপাচারে কলুষিত করেছে।’ -সূরা আশ সামস: ৯-১০
ধর্মের মূল শিক্ষা হলো- আত্মার পরিশুদ্ধতা অর্জন। আত্মাকে পঁচা-দুর্গন্ধযুক্ত রেখে সুন্দর পোশাক পরে ইবাদতে দাঁড়িয়ে কোনো লাভ নেই। তাই সবার আগে চাই পরিশুদ্ধ অন্তর। ইসলাম পরিশুদ্ধ অন্তরের পাশাপাশি মানুষকে ইতিবাচক মনোভাবে উৎসাহিত করেছে। সেই সঙ্গে ইসলাম যুক্তি, বুদ্ধি-বিবেচনার প্রতি বিশেষভাবে গুরুত্বারোপ করেছে, দিয়েছে যথাযথ মর্যাদা। কোরআনে কারিমে বর্ণিত বিভিন্ন আয়াত দ্বারা বিষয়টি সহজেই অনুমান করা যায়। পবিত্র কোরআনে বিবেকের কথা বারবার উল্লেখ করা হয়েছে। এ থেকেও বিবেকের গুরুত্বের কথা অনুধাবন করা যায়। শুধু বিবেক শব্দ থেকে ব্যুৎপন্ন শব্দাবলির ব্যবহার কোরআনে কারিমে প্রায় সত্তরের কাছাকাছি। আর আল্লাহতায়ালার নিদর্শনসহ সম্পূরক বিষয়ে চিন্তা-গবেষণার প্রতি উদ্বুদ্ধ করা হয়েছে এমন আয়াতের সংখ্যা অগণিত। কোরআনে বিবেকের যথাযথ ব্যবহার করার পাশাপাশি বিবেকের প্রতি জিজ্ঞাসাসূচক বহুবাক্য ব্যবহার করা হয়েছে।
শুধু পরোক্ষ ইঙ্গিতে নয়, বরং সবক্ষেত্রে চিন্তা ও বিবেকের কথা সুস্পষ্টভাবেই উল্লেখ করা হয়েছে। বিবেকআশ্রিত হয়ে ভালো কাজের প্রতি মুমিনদের উদ্বুদ্ধ করা হয়েছে। মন্দ কাজের প্রতি ভর্ৎসনা ও তিরস্কার করা হয়েছে। ইসলাম যে মানবিক চিন্তা ও বিবেককে মূল্যায়ন করেছে, তার জন্য তো এতটুকুই যথেষ্ট যে কোনো দায়িত্ব অর্পণের ক্ষেত্রে ইসলাম বিবেককে প্রধান শর্ত করেছে। তাই ইসলাম কেবল বিবেকবান লোকদের তার বিধিনিষেধ পালনের নির্দেশ দিয়েছে। হজরত রাসূলুল্লাহ (সা.) ইরশাদ করেন, ‘তিন ব্যক্তি হিসাবনিকাশ থেকে মুক্ত থাকে। প্রথমত, ঘুমন্ত ব্যক্তি, যতক্ষণ না সে জাগ্রত হয়। দ্বিতীয়ত, অপ্রাপ্ত বয়স্ক, যতক্ষণ না সে পরিণত বয়সে উপনীত হয়। তৃতীয়ত, পাগল, যতক্ষণ না সে জ্ঞান ফিরে পায়।’