ইফা ডিজির ঘনিষ্ঠ ৯ কর্মকর্তার সম্পদ অনুসন্ধানে দুদক
ইসলামিক ফাউন্ডেশনের সদ্য সাবেক মহাপরিচালক (ডিজি) সামীম মোহাম্মদ আফজালের ব্যাপক দুর্নীতি ও অনিয়মের তথ্য প্রকাশের পর এবার দুদকের নজর পড়েছে ডিজির ঘনিষ্ঠ ৯ কর্মকর্তার ওপর। তাদের সম্পদ অনুসদ্ধানে নেমেছে দুদক।
১৭ ডিসেম্বর দুদকের সহকারী পরিচালক ও অনুসন্ধকারী কর্মকর্তা মো. আমির হোসেন ইসলামিক ফাউন্ডেশনের মহাপরিচালক বরাবর একটি চিঠি ইস্যু করেছেন। ওই চিঠিতে সাবেক পরিচালক মো. তাহের হোসেন, সাবেক পরিচালক মো. হারুনুর রশীদ, ইমাম প্রশিক্ষণ একাডেমির পরিচালক জালাল আহমদ, সমন্বয় বিভাগের পরিচালক এবিএম শফিকুল ইসলাম, মো. আজাদ আলী সিএ, সহকারী পরিচালক মুহাম্মদ মুজিব উল্লাহ ফরহাদ, রিজাউল করিম, মো. জাকির হোসেন ও মো. মোস্তাফিজুর রহমান সম্পর্কে নির্দিষ্ট তথ্য চাওয়া হয়েছে।
ইসলামিক ফাউন্ডেশনের মহাপরিচালক বরাবর পাঠানো চিঠিতে সুষ্ঠু অনুসন্ধানের স্বার্থে ওই কর্মকর্তাদের চাকরিতে যোগদানের তারিখ থেকে ৩০ ডিসেম্বর পর্যন্ত বেতনভাতার তালিকা চাওয়া হয়েছে।
ইফা সূত্রে জানা গেছে, তাদের তথ্য ইতোমধ্যে দুদকের অনুসন্ধানকারী কর্মকর্তাকে সরবরাহ করা হয়েছে।
ইসলামিক ফাউন্ডেশনে কর্মরত নাম প্রকাশে অনচ্ছিুক একাধিক কর্মকর্তা বার্তা২৪.কমকে বলেন, এই কর্মকর্তারা বিগত দিনে ইসলামিক ফাউন্ডেশনের নিয়োগ, বদলি, পদোন্নতি ও টেন্ডার বাণিজ্য নিয়ন্ত্রণ করেছেন। তারা একটি সিন্ডিকেট গড়ে তোলেন, তাদের ইচ্ছা-অনিচ্ছাই ছিলো সবকিছু।
অবশ্য ইমাম প্রশিক্ষণ একাডেমির পরিচালক জালাল আহমদসহ বেশ কয়েকজন কর্মকর্তা বার্তা২৪.কমকে বলেছেন, তাদের বিরুদ্ধে ওঠা দুর্নীতির অভিযোগ মিথ্যা। তারা অপরাজনীতির শিকার। দুদক তাদের বিরুদ্ধে অনুসন্ধান করে কিছুই পাবে না।
নয় কর্মকর্তার বিরুদ্ধে ওঠা অভিযোগগুলো হলো—
মো. তাহের হোসেন
সাবেক পরিচালক মো. তাহের হোসেনের বিরুদ্ধে অবৈধভাবে দৈনিক ভিত্তিতে কর্মচারী নিয়োগ, বিভিন্ন অনুষ্ঠানের নামে ভুয়া ভাউচার বানিয়ে টাকা আত্মসাৎ, টাকার বিনিময়ে নিয়োগ, বদলি, পদোন্নতি ও টেন্ডার বাণিজ্যের অভিযোগ উঠেছে। নামে-বেনামে প্রচুর জমি, ফ্ল্যাট, বাড়ি ও গাড়ি রয়েছে তার। তার স্ত্রী একজন নার্স। কিন্তু তিনি ব্যবহার করতেন ইসলামিক ফাউন্ডেশনের পাজেরো গাড়ি। অফিস সহকারী পদে যোগ দিয়ে শেষ পর্যন্ত পরিচালক হিসেবে পদোন্নতি পান তাহের হোসেন।
মো. হারুনুর রশীদ
সাবেক পরিচালক মো. হারুনুর রশীদের বিরুদ্ধে অভিযোগ রয়েছে, তিনি চাকরিরত অবস্থায় মক্তব ফাউন্ডেশন নামে একটি প্রতিষ্ঠান খুলে ইসলামিক ফাউন্ডেশনের মসজিদভিত্তিক গণশিক্ষার শিক্ষক ও ইমামদের সেই প্রতিষ্ঠানের সদস্য হতে বাধ্য করেন। ইমামদের কাছ থেকে চাঁদা তুলে প্রায় ১২ কোটি টাকা আত্মসাৎ করেছেন। টাকার বিনিময়ে মুক্তিযোদ্ধার জাল সার্টিফিকেট সংগ্রহেরও অভিযোগ রয়েছে তার বিরুদ্ধে, বিষয়টি এখনও তদন্তাধীন। ভুয়া সার্টিফিকেট দেখিয়ে মুক্তিযোদ্ধা কোটায় তার ছেলেকে ইসলামিক ফাউন্ডেশনে চাকরি দিয়েছেন তিনি। রাজধানীর শ্যামপুর, যাত্রাবাড়ী জোনে প্রতি মাসে নামে-বেনামে ৫০টি গণশিক্ষা ও কোরআন শিক্ষার কেন্দ্রের শিক্ষকদের তথা ইমামদের টাকা আত্মসাতের অভিযোগ রয়েছে তার বিরুদ্ধে। নামে-বেনামে সম্পদ গড়ারও অভিযোগ তার বিরুদ্ধে।
জালাল আহমেদ
ইমাম প্রশিক্ষণ একাডেমির পরিচালক জালাল আহমদ বিধি বহির্ভূতভাবে ফাউন্ডেশনের ২টি গুরুত্বপূর্ণ পদে আসীন (উপসচিব ও পরিচালক)। তার স্ত্রী মাহমুদা বেগমের চাকরি ও সিনিয়রদের ডিঙিয়ে পদোন্নতি নিয়ে অসন্তোষ রয়েছে ইফায়। প্রশিক্ষণের টাকা নয়-ছয় থেকে শুরু করে নিয়োগ, বদলি, পদোন্নতি ও টেন্ডার থেকে কমিশন নিতেন তিনি। এসব করে তিনি এখন টাকার কুমির। তার বিরুদ্ধে অফিসের একাধিক গাড়ি ব্যবহারের অভিযোগ রয়েছে। এমনকি তার স্ত্রীর প্রাপ্যতা না থাকা সত্ত্বেও সার্বক্ষণিকভাবে তার স্ত্রী একটি গাড়ি ব্যবহার করছেন।
শফিকুল ইসলাম
শফিকুল ইসলাম, পরিচালক সমন্বয় বিভাগ। সারাদেশের দারুল আরকাম মাদরাসার শিক্ষক ও গণশিক্ষার সুপারভাইজার নিয়োগে তার বিরুদ্ধে ব্যাপক অনিয়ম ও দুর্নীতির অভিযোগ রয়েছে। অবৈধভাবে নিয়োগের মাধ্যমে তিনি কোটি টাকার দুর্নীতি করেছেন। এ ছাড়া সেকশন অফিসার ও পরিবহনের দায়িত্বে থাকাকালে দুর্নীতির মাধ্যমে লোক নিয়োগ ও গাড়ির জ্বালানির তেল ও মেরামতে ভুয়া বিল দিয়ে লাখ লাখ টাকা আত্মসাৎ করেছেন। এখনও তিনি সমন্বয় বিভাগের পরিচালক হিসেবে কর্মরত।
মো. আজাদ আলী
মো. আজাদ আলী, উপ-পরিচালক। তার বিরুদ্ধে তৃতীয় শ্রেণির হিসাব রক্ষক পদে দৈনিকভিত্তিতে যোগদান করে নিয়ম ও বিধি বহির্ভূতভাবে প্রথমে হিসাব রক্ষণ কর্মকর্তা ও পরে হিসাব নিয়ন্ত্রক পদে পদোন্নতি বাগিয়ে নেওয়ার অভিযোগ রয়েছে। বিভিন্ন নিয়োগ পরীক্ষার খাতা জালিয়াতি, নম্বর টেম্পারিংয়ের অভিযোগ রয়েছে তার বিরুদ্ধে। এভাবে তিনি প্রচুর সম্পদ অর্জন করেছেন বলে গুঞ্জন রয়েছে।
মুহাম্মদ মুজিব উল্লাহ ফরহাদ
সহকারী পরিচালক মুহাম্মদ মুজিব উল্লাহ ফরহাদের বিরুদ্ধে অভিযোগ রয়েছে নিয়োগ পরীক্ষায় জালিয়াতি করে সহকারী পরিচালক পদে নিয়োগ পেয়েছেন তিনি। পরে নিজের পিতাকে চাঁদপুর ফরিদগঞ্জের ইসলামিক ফাউন্ডেশনের মডেল কেয়ারটেকার, এক ভাইকে পিয়ন ও অন্য ভাইকে দারুল আরকাম মাদরাসার শিক্ষক হিসেবে নিয়োগ দিয়েছেন। গণশিক্ষা প্রকল্পের কেনাকাটা, ৫শ’ সুপারভাইজার নিয়োগ, গণশিক্ষার সাধারণ শিক্ষক নিয়োগ, গণশিক্ষার নতুন নতুন শিক্ষাকেন্দ্র স্থাপন, দারুল আরকাম মাদরাসার শিক্ষক নিয়োগে দুর্নীতি করে তিনি প্রচুর টাকা কামিয়েছেন। নানা উপলক্ষে সারাদেশের ইমামদের থেকে বিকাশের মাধ্যমে ঘুষ নেওয়ায় সবাই তাকে ‘বিকাশ ফরহাদ’ হিসেবে চেনে।
মো. মোস্তাফিজুর রহমান
সহকারী পরিচালক মো. মোস্তাফিজুর রহমান সাবেক ডিজি সামীম মোহাম্মদ আফজালের আত্মীয়। তাকে দুর্নীতি ও জালিয়াতির মাধ্যমে নিয়োগ দেওয়া হয়। নিয়োগের পর সিলেবাস, কারিকুলাম প্রণয়নের নামে প্রতি মাসে লাখ লাখ টাকা হাতিয়ে নিয়েছেন। ইসলামিক ফাউন্ডেশনের জেলা অফিস সফর করে নানা অজুহাতে ডিজির নাম ভাঙিয়ে কর্মকর্তা-কর্মচারীদের কাছ থেকে আদায় করেছেন প্রচুর টাকা।
মো. রিজাউল করিম
সহকারী পরিচালক হয়েও মো. রিজাউল করিম উপ-পরিচালকের সমমান সিএ-এর দায়িত্ব পালন এবং অর্থ বিভাগে ভুয়া বিল-ভাউচারের মাধ্যমে লাখ লাখ টাকা হাতিয়ে নেওয়ার অভিযোগ রয়েছে তার বিরুদ্ধে। এক পর্যায়ে তাকে যানবাহন এবং টেন্ডারের দায়িত্ব দেওয়া হয়। যানবাহন মেরামতের নামে ভূয়া বিল-ভাউচার দিয়ে প্রতি মাসে লাখ লাখ টাকা আত্মসাতের অভিযোগ রয়েছে তার বিরুদ্ধে। এ ছাড়া টেন্ডারে বিভিন্ন ঠিকাদারের যোগসাজসের মাধ্যমে প্রচুর দুর্নীতি করেছেন।
মো. জাকির হোসেন
সাবেক ডিজি সামীম আফজালের ব্যক্তিগত কর্মকর্তা মো. জাকির হোসেন দৈনিকভিত্তিক তৃতীয় শ্রেণির পদ এলডিএ হিসেবে যোগদান করেন। তার বিরুদ্ধে অবৈধ সম্পদ অর্জনের অভিযোগ রয়েছে। তিনি ইসলামিক ফাউন্ডেশনের বিভিন্ন জেলা ও বিভাগীয় অফিস থেকে ডিজির খরচের নামে প্রতিমাসে লাখ লাখ টাকা আদায় করতেন। এছাড়া নিয়োগ, বদলি, পদোন্নতি ও টেন্ডারে তিনি ভাগ বসাতেন। পিয়ন পদে যোগ দিয়ে তিনি এখন ইসলামি ফাউন্ডেশনের ডিজির পি.এ।