শিক্ষা ব্যবস্থায় ধর্মীয় বিষয় অন্তর্ভুক্ত প্রসঙ্গে
গ্রামের স্বল্পশিক্ষিত এমনকি অক্ষরজ্ঞানসম্পন্ন মানুষ থেকে শুরু করে শহুরে মধ্যবিত্ত-উচ্চবিত্ত পর্যন্ত সবস্তরের মানুষের মুখে একটি আক্ষেপ হরহামেশা শোনা যায়- সমাজ নীতিহীনতার পাতালে তলিয়ে যাচ্ছে; দুর্নীতিতে দেশ আকণ্ঠ ডুবে আছে। যেখানে চোখ বুলাবেন মিথ্যা, প্রতারণা, প্রবঞ্চনা, জুলুম, নিপীড়িন, অনাচার, ব্যভিচার, ধর্ষণ, পশ্বাচার এবং অধিকার হরণের প্রতিযোগিতা চলছে। গুনে গুনে কয়টি অপরাধের কথা বলবেন? অবস্থার এতই অবনতি ঘটেছে যে, কেবল সচেতন নয়- অচেতন-অর্ধচেতনরাও হাড়েহাড়ে টের পাচ্ছে মানুষের মনুষ্যত্ব কীভাবে বিলুপ্ত হতে চলেছে। মোটকথা, সমস্যা সর্বব্যাপী মহামারীর আকার ধারণ করায় পরিস্থিতির ভয়াবহতা বুঝতে সূক্ষ্মজ্ঞান ও অনুসন্ধানের দরকার নাই।
বহুবিধ মোটিভেশন, উপদেশ, ওয়াজ-নসিহত, শাস্তি-দণ্ড, চোখরাঙানি, কড়া হুঁশিয়ারি কোনো কিছুই যেন এই অবক্ষয়ের তুফানকে ঠেকাতে পারছে না। তাহলে কোন্ পথের দিকে আমাদের এগুতে হবে? আমাদের গলদটা কোথায়? এমন প্রশ্ন আর ভাবনা কমবেশি সবাইকে তাড়া করছে। প্রতিকারের প্রত্যেক উপায়-অবলম্বন স্ব স্ব জায়গায় গুরুত্বপূর্ণ। এমন ঘণঘোর অন্ধকারে আলো জ্বালাতে একাধিক পদক্ষেপ গ্রহণ করতে হবে। একেবারে ব্যক্তি, পরিবার ও সমাজের তৃণমূল থেকে কাজ শুরু করতে হবে। তবে চিন্তাবিদ ও বিশেষজ্ঞদের পর্যবেক্ষণে এই সময়ের সবচেয়ে বড় ফাঁকটি শিক্ষাব্যবস্থায়।
শৈশব-কৈশোর থেকে আমার-আপনার সন্তান-সন্ততি সুন্দর জীবন ও পরিপূর্ণ নৈতিকতার সবক থেকে বঞ্চিত অবস্থায় বেড়ে উঠছে। পাঠ্যপুস্তকে কেবল বৈষয়িক উন্নতি, ক্যারিয়ার, চাকুরি জীবনের সফলতা প্রভৃতির পাঠগ্রহণ করে একেকজন বাণিজ্যিক প্রাণী হিসেবে বড় হচ্ছে। যদি প্রতিটি বিদ্যালয়ে বস্তুগত বিদ্যার পাশাপাশি ধর্মীয় শিক্ষা এবং প্রতিষ্ঠানে ও সমাজে নৈতিকতা চর্চার পরিবেশ তৈরি হতো তাহলে কিশোর অপরাধের মতো অনাকাঙ্খিত পরিস্থিতির মুখে আমাদের পড়তে হতো না।
বিশ্বখ্যাত ইসলামি স্কলার মুফতি মুহাম্মদ তকী ওসমানী গুরুত্বপূর্ণ সামাজিক এ অবক্ষয় বিষয়ে এক ভাষণে বলেন, ‘আমার শ্রদ্ধেয় পিতা যে কথা বলেছিলেন, তা অত্যন্ত গভীর ও সূক্ষ্মদর্শী কথা। তা না বুঝার কারণে আমাদের অনেকে ভুল বুঝাবুঝির শিকার হয়েছেন। এ তিনটি শিক্ষাব্যবস্থা যা ভারতবর্ষে প্রচলিত ছিলো সেগুলো মূলত ইংরেজদের প্রবর্তিত শিক্ষাব্যবস্থার ফলাফল ছিলো। ইংরেজদের ষড়যন্ত্রমূলক ব্যবস্থার পাল্টা ব্যবস্থা ছিল। নতুবা আপনি যদি এর পূর্বের মুসলিম বিশ্বের হাজার বছরের শিক্ষাব্যবস্থা নিয়ে পড়াশোনা ও চিন্তাভাবনা করেন তাহলে তাতে মাদরাসা ও স্কুলের পার্থক্য দেখতে পাবেন না, সেখানে ইসলামের শুরু থেকে নিয়ে আধুনিককাল পর্যন্ত অব্যাহতভাবে মাদরাসা ও জামেয়াসমূহে একই সময়ে ধর্মীয় শিক্ষাও দেওয়া হতো এবং সেই সঙ্গে যুগোপযোগী দুনিয়াবি শিক্ষাও দেওয়া হতো।
ধর্মীয় জ্ঞানে পরিপূর্ণ আলেম হওয়াতো প্রত্যেক ব্যক্তির জন্য ফরজ আইন নয়, বরং ফরজে কেফায়া। কোনো এলাকা বা দেশে যদি প্রয়োজন পরিমাণ আলেম হয়ে যায় তাহলে সংশ্লিষ্ট এলাকার সবার পক্ষ থেকে এ ফরজ দায়িত্ব আদায় হয়ে যায়। তবে দীনের মৌলিক জ্ঞান অর্জন করা প্রত্যেক মুসলমানের জন্য ফরজে আইন। পূর্বকালে প্রতিষ্ঠিত সব মাদরাসায় ফরজে আইন পরিমাণ ইলমের শিক্ষা প্রত্যেককেই দেওয়া হতো। তবে যে ইলমে দীনের বিশেষজ্ঞ হতে চাইতো তার জন্য সে সুযোগ ছিলো, আর যে যুগোপযোগী আধুনিক জ্ঞানে বিশেষজ্ঞতা অর্জন করতে চাইতো তার জন্য তা অর্জন করারও ব্যবস্থা ছিল।’ –অনুবাদ: কাজী হানিফ
আমাদের আলোচনার প্রাসঙ্গিক দিকটি হলো, ধর্মীয় শিক্ষা কেবল মাদরাসায় কেন, প্রত্যেক স্কুলে পরিমিত ধর্মীয় শিক্ষার পাঠ্য থাকবে। মুসলমান হিসেবে ধর্মের মৌলিক জ্ঞান অর্জনের জন্য এটা জরুরি।
মুফতি তকী আরও বলেন, ‘ইংরেজদের প্রবর্তিত এ শিক্ষা ব্যবস্থার ফলে যে ক্ষতির সম্মুখীন আমরা হয়েছি তা হলো, মুসলমানদের ইতিহাস এবং জ্ঞান-বিজ্ঞানের উত্তরাধিকার ধ্বংস করে দেওয়া হয়েছে। এ নতুন শিক্ষা ব্যবস্থা চালু করার ফলে দীনি ও দুনিয়াবী জ্ঞান বিভক্ত হয়ে পড়েছে। মুসলমান সমাজ মোল্লা ও মিস্টারে ভাগ হয়ে গেছে। শুধু তাই নয়, যে ছাত্র এ শিক্ষা ব্যবস্থায় গড়ে উঠেছে সে দীনের মৌলিক ফরজ সম্পর্কেও জানে না। দ্বিতীয়ত, তাদের মন-মস্তিষ্কে এ চিন্তা চেতনা ঢুকিয়ে দেওয়া হয়েছে যে, যদি উন্নতি অগ্রগতি চাও তাহলে শুধু পশ্চিমাদের অন্ধ অনুসরণ করো। তৃতীয়ত মুসলমানদের তাহজিব-তামাদ্দুন ও কৃষ্টিকালচার পাল্টে দেওয়া হয়েছে। সবার মস্তিষ্কে একথা বসিয়ে দেওয়া হয়েছে যে, যদি উন্নতি ও সমৃদ্ধি চাও তাহলে তা শুধু পশ্চিমাদের চিন্তা-চেতনা ও তাদের ধ্যান-ধারনার মধ্যেই পাবে। তাদের জীবনযাপন পদ্ধতির মধ্যেই রয়েছে কাঙ্খিত সুখ-শান্তি, উন্নতি ও অগ্রগতি।‘
ফরজ পরিমাণ শিক্ষার ধারণা
ফরজে আইন ইলমের প্রথম বিষয় হলো আকিদাতুল ইসলাম। দ্বিতীয় কথা ফারায়েজুল ইসলাম। কোরআন-হাদিসে আল্লাহ আমার ওপর কী কী জিনিস ফরজ করেছেন, একজন মুসলিমের ওপর কী কী জিনিস ফরজ এগুলো জানতে হবে। তৃতীয়ত, ইসলাম তার অনুসারীদের ওপর কী কী জিনিস হারাম করেছে? সগিরা গোনাহ, কবিরা গোনাহ সবই তো গোনাহ। হারাম, মাকরূহে তাহরিমি, মাকরূহে তানযিহি সবই তো বর্জনীয়। কিন্তু বর্জনীয়ের মধ্যে সবচেয়ে ভয়াবহ কী? হারাম এবং মাকরূহে তাহরিমি। এগুলোর তালিকা আমার জানা থাকতে হবে না? তা হলো- আকিদাতুল ইসলাম, ফারায়েজুল ইসলাম, মাহারিমুল ইসলাম এই বিষয়গুলো।
সাধারণ স্কুলে ধর্মীয় সিলেবাসের সুপারিশ ও ধারণায়ন
সরকারি স্কুলের পাঠ্যক্রম প্রণয়ন ও পরিবর্তন সরকার নিয়ন্ত্রিত প্রতিষ্ঠান জাতীয় শিক্ষাক্রম ও পাঠ্যপুস্তক কর্তৃক হয়ে থাকে। কাজেই সরকারের নীতি-নির্ধারকরা প্রয়োজনবোধ করলে কেবল সরকারি স্কুলের যেকোনো পুস্তক বা বিষয় সিলেবাস সংযোজিত হতে পারে; অন্যথায় নয়। ফলে বেসরকারি কর্তৃপক্ষ, ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠান চাইলেও সরকারি স্কুলে প্রয়োজনীয় ধর্মীয় সিলেবাস সংযোজনে তেমন কোনো ভূমিকা রাখতে পারবেন না। কারও প্রশ্ন থাকতে পারে বর্তমানে জাতীয় শিক্ষাক্রমে তো ধর্মীয় সিলেবাস আছে; তাহলে নতুন করে আবার সংযোজনের কথা আসছে কেন? এই নিবন্ধে আমরা ইঙ্গিত দেওয়ার চেষ্টা করেছি, বর্তমানে নামকাওয়াস্তে যে সিলেবাস আছে তা মান ও পরিমাণ উভয়দিক থেকে অপ্রতুল ও অসন্তোষজনক।
তাই আমাদের সুপারিশ বেসরকারি প্রতিষ্ঠান ও শিক্ষা-উদ্যোক্তাদের জন্য।
এক. বেসরকারি বিদ্যালয়গুলোর প্রাথমিক, মাধ্যমিক পর্যায়ে অর্থাৎ (শিশু শ্রেণি) প্রথম শ্রেণি থেকে দশম শ্রেণি পর্যন্ত কোরআন, হাদিস, আকাইদ, ফিক্হ, সিরাতের মতো বিষয়গুলো পরিমিত ও নির্বাচিত অংশ সিলেবাসভুক্ত করা। এক্ষেত্রে সংশ্লিষ্ট বিষয়ের শিক্ষক নিয়োগ দিতে হবে।
দুই. বর্তমানে প্রাথমিক ও মাধ্যমিক স্তরে শিক্ষার্থীদের ওপর বিষয়াধিক্যের চাপ কমানোর জন্য সুচিন্তিত পদক্ষেপ নেওয়া।
তিন. প্রতিটি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে মুসলমান শিক্ষার্থীদের জন্য জামাতে নামাজ আদায়ের প্রাতিষ্ঠানিক উদ্যোগ নেওয়া।