চিন্তামুক্ত জীবনের সন্ধানে
আধুনিক মনোবিজ্ঞানে ভয়-ভীতির মাত্রা ও অনুভূতি আলাদাভাবে চিহ্নিত থাকলেও এর সঙ্গে সম্পৃক্ত বিষন্নতা, ভয় ও হিংসা স্বতন্ত্র রোগ হিসেবে নিরূপিত হয়নি। আধুনিক মনোবিদরা হিংসাকে আলাদা মানসিক রোগ হিসেবে স্বীকার করেন না। এক্ষেত্রে তাদের দাবি হলো, এটি অন্য রোগের উপসর্গ মাত্র। কিন্তু ইসলাম নবী করিম (সা.)-এর মনোবিজ্ঞানবিষয়ক নির্দেশনার আলোকে মনে করে, ভয়-ভীতি, উদ্বেগ-দুশ্চিন্তা এসব ক্রুব্ধতার মধ্যে শামিল থাকা উচিত। এগুলো প্রত্যেকটাই ক্রুব্ধতার একেক প্রকার।
আল্লাহর রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম মানসিক অস্থিরতার প্রতিটি প্রকার ও ধরনের আলাদাভাবে আলোকপাত করেছেন। পৃথক পৃথকভাবে মনোনিবেশ করেছেন। এসবের চিকিৎসা সম্পর্কে নির্দেশনা দিতে গিয়ে প্রথমেই মূলনীতি বাতলে দিয়েছেন যে, সবকিছুর আগে তাকে আশ্বস্ত করো, সাহস জোগাও এবং এরপর পূর্ণ মনোযোগ সহকারে তার কথা শোনো। যাতে তার মনে যত রকমের কষ্ট আছে তা উগড়ে দিয়ে মনকে হালকা করতে পারে। এরপর পরামর্শ দিয়েছেন, আল্লাহর কাছে দোয়া করো। অধিকন্তু যে কোনো চিকিৎসার ক্ষেত্রে ইতিবাচক চিন্তা একটি স্বীকার্য বাস্তবতা।
খন্দকের যুদ্ধ চলছে। শত্রুরা মদিনাকে চারপাশ থেকে ঘিরে ফেলেছে। দু’একজন সৈন্য সাঁকো বসিয়ে পরিখা পেরিয়ে ভেতরেও ঢুকে পড়েছে। রসদ ঘাটতি, জনবল সংকট, অব্যাহত আগ্রাসনে মদিনাবাসী মানসিকভাবে পর্যুদস্ত। হজরত আবু সাঈদ খুদরি (রা.) বলেন, এমন ভীতিকর পরিস্থিতিতে হজরত রাসূলুল্লাহ (সা.)-এর কাছে আরজ করা হলো: সকলেই সন্ত্রস্ত, ভীতির কারণে সবার কলিজা বেরিয়ে আসতে চাইছে, আমাদের সাহস বাড়ানোর জন্য কিছু বলুন। তখন আল্লাহর রাসূল (সা.) একটি দোয়া শিখিয়ে দিলেন এবং বললেন, তোমরা বারবার এটা পড়তে থাকো।
এ দোয়ার ফলে মদিনাবাসীর মনোবল বেড়ে যায়, শত্রুরাও পালিয়ে যায়। সর্বোপরি হজরত রাসূলুল্লাহ (সা.)-কে সুসংবাদ দেওয়া হয়; অচিরেই মুসলমানরা রোম-পারস্যও জয় করবে।
আধুনিক মনোবিজ্ঞানের প্রেসক্রিপশন মেনে যদি আমরা সমস্যাগুলোর সমাধান করতে চাই, সেক্ষেত্রেও আমাদের মানসিক সমাধানের পথেই হাঁটতে হবে। এখনতো প্রায়ই দেখা যায়, চিকিৎসকরা রোগীকে ভীতি ও চিন্তামুক্ত রাখার জন্য সাময়িকভাবে স্বস্তিদায়ক মেডিসিন কিংবা ঘুমের ঔষধ দিয়ে থাকেন। রোগী কিছুটা স্থিরতায় ফিরলে, কথাবার্তা বলার উপযুক্ত হলে তাকে বসিয়ে রোগের বিস্তারিত বর্ণনা জিজ্ঞাসা ও উৎস উদ্ঘাটনের চেষ্টা করা হয়।
এখানে জরুরি বিষয় হলো, চিকিৎসকের ওপর রোগীর পূর্ণ আস্থা থাকা। তার কোনো পরামর্শের ব্যাপারে রোগীর আপত্তি না থাকা বরং তার প্রতিটি কথা রোগীর জন্য অক্ষরে অক্ষরে পালনীয়; মনেপ্রাণে এটা বিশ্বাস করা। তবেই কেবল যথাযথ চিকিৎসা সম্ভব। এভাবে চিকিৎসা করেও পূর্ণ আরোগ্য লাভ করতে দুই-তিন বছর অতিবাহিত হওয়া স্বাভাবিক।
এ প্রসঙ্গে হজরত আয়েশা (রা.)-এর বর্ণিত একটি চমৎকার ঘটনা উল্লেখ করা যেতে পারে, তাদের গোত্রে কেউ মৃত্যুবরণ করলে সান্তনা দেওয়ার জন্য আসা পাড়া-প্রতিবেশি মহিলারা চলে যাওয়ার পর সারাদিনের ধকল কাটিয়ে উঠা এবং মানসিক বিধ্বস্ত অবস্থা থেকে চাঙা হওয়ার জন্য তালবিনা (যব, ছোলা ও চালের ছাতু দিয়ে বানানো খাবার বিশেষ) ও স্যুপ রান্না করা হতো। স্যুপে রুটি ভিজিয়ে তালবিনার সঙ্গে ঘরের লোকদের খাওয়ানোর ব্যবস্থা করার হতো। হজরত আয়েশা (রা.) বলেন, এই খাবারের ফর্মূলাটি আমি হজরত রাসূলুল্লাহ (সা.)-এর কাছ থেকে শুনেছি। হাদিসে বলা হয়েছে, ‘তালবিনা অসুস্থ মানুষের হৃদপিণ্ডে শক্তি যোগায় এবং বিষন্নতা দূর করে।’ –সহিহ বোখারি: ৫১০১
দেখুন, মনের ভার হালকা করার জন্য রীতিমতো একটি খাবার-পথ্য ব্যবহারের নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে। যে খাবারে পুষ্টি যোগানোর পাশাপাশি মনকে প্রশান্ত করার উপকরণ রয়েছে। হৃদয় ভারাক্রান্ত অবস্থায় কোরআন মাজিদ একটি মনস্তাত্ত্বিক নীতি উপস্থাপন করেছে। বলা হয়েছে, ‘এভাবে তোমার প্রভুর ইবাদত করো, যেন কাঙ্খিত বস্তু প্রাপ্তির ব্যাপারে সন্দেহাতীত বিশ্বাস অর্জিত হয়।’ -সূরা হিজর: ৯৯
কোরআনে কারিমের বিভিন্ন অনুবাদ ও তাফসিরগ্রন্থে উপর্যুক্ত আয়াতের দুই রকমের তরজমা দেখা যায়। দ্বিতীয় অনুবাদ হলো: ‘এবং মৃত্যু হাজির হওয়া পর্যন্ত আপনি আপন পালনকর্তার ইবাদত করুন।’
ভয়ের বয়ানে কোরআনের স্বাতন্ত্র্য
যে কষ্ট ও বিপদের ভয়ে মানুষ আতঙ্কিত ছিলো তা হাজির হওয়া পর্যন্ত ভয়-ভীতি ও আশঙ্কাটি অস্তিত্বমান থাকে। এই অবস্থার পরিষ্কার বয়ান পেশ করা বিষয়ে কোরআনে কারিম কেবল বিশ্বাসী মানুষদের দৃষ্টি আকর্ষণ করেই থেমে যায়নি; বরং সুদৃঢ়ভাবে প্রতিশ্রুতি দিয়েছে তোমাকে এই ভয় আর বিপদ থেকে রক্ষার জন্য সম্পূর্ণ দায়িত্ব নিচ্ছি। ইরশাদ হচ্ছে, ‘যারা বলে যে, আল্লাহ আমাদের প্রভু, এরপর তার একথার ওপর অবিচল থাকে তাদের কোনো ধরনের দুর্ভাবনা নাই; কোনো রকম আশঙ্কাও করতে হবে না।’
এই কথাটি অন্যত্র এভাবে বলা হয়েছে, ‘সেসব লোকজনকে আল্লাহ নিজেই সুরক্ষা দেবেন যারা তাকওয়া অবলম্বন করেছে (আল্লাহর অসন্তুষ্টির ভয় করেছে) তাদের জন্য ক্ষতির আশঙ্কা নাই তাদেরকে উদ্বিগ্নও হতে হবে না।’
কোরআনে কারিমের অন্যত্র তাদের ভয় গ্রাস করতে না পারার গ্যারান্টি দিয়ে বলা হয়েছে, ‘তোমরা মনোযোগ দিয়ে শুনে রাখো, তারা আমার বন্ধু। তাদের কোনোকিছুর ভয় ও অনিষ্টের উদ্বেগ-উৎকণ্ঠা নাই।’ ভালো লোকদেরকে উপমা দিয়ে বুঝানো হয়েছে যে, ‘ওরা আমার বন্ধু’ আর নিজের বন্ধুদেরকে ভয় ও আশঙ্কা থেকে মুক্ত রাখা সে তো আমার দায়িত্বে।
কথাটি এভাবেও বুঝতে পারেন- তোমরা আমাদের বন্ধু হয়ে যাও; তখন তোমাদের সকল ভীতি ও আশঙ্কা থেকে বাঁচানো আমার জিম্মায় থাকবে। আল্লাহর বন্ধু হয়ে যাওয়ার উপায় কী? এর পথ বাতলে দেওয়া হয়েছে এভাবে, আল্লাহর প্রিয়ভাজন হয়ে ভয় ও শঙ্কামুক্ত অনন্ত জীবন গ্যারান্টি পাওয়ার শর্ত কোরআনে কারিমের প্রথম দিকের সূরাগুলোতে স্পষ্টভাবে বলা হয়েছে।
সূরা বাকারার ২৭৭ নম্বর আয়াতে বলা হয়েছে, ‘নিশ্চয়ই যারা ঈমান এনেছে, সৎকাজ করেছে, নামাজ প্রতিষ্ঠা করেছে এবং জাকাত দিয়েছে, তাদের প্রতিদান রয়েছে তাদের রবের নিকট। আর তাদের কোনো ভয় নেই এবং তারা চিন্তিতও হবে না।