চন্দ্রগ্রহণ: আল্লাহর কুদরতের খেলা
পৃথিবী যখন পরিভ্রমণরত অবস্থায় কিছু সময়ের জন্য চাঁদ ও সূর্যের মাঝখানে এসে পড়ে, তখন পৃথিবী, চাঁদ ও সূর্য একই সরল রেখায় অবস্থান করে। পৃথিবীপৃষ্ঠের কোনো দর্শকের কাছে চাঁদ আংশিক বা সম্পূর্ণরূপে কিছু সময়ের জন্য অদৃশ্য হয়ে যায়। এই ঘটনাকে চন্দ্রগ্রহণ বলা হয়।
শতাব্দীর দীর্ঘতম চন্দ্রগ্রহণ দেখা যাবে শুক্রবার (২৭ জুলাই) মধ্যরাতে। এদিন প্রায় পাঁচ ঘণ্টা ধরে ছায়াচ্ছন্ন থাকবে চাঁদ। প্রায় পৌনে দুই ঘণ্টা (১ ঘণ্টা ৪৩ মিনিট) ধরে চাঁদ পুরোপুরি ঢেকে যাবে পৃথিবীর ছায়ায়। পূর্ণ চন্দ্রগ্রহণের আগে ও পরে আরও দুইবার হবে আংশিক চন্দ্রগ্রহণ।
পূর্ণ চন্দ্রগ্রহণ আর আগে-পরের দু’টি আংশিক চন্দ্রগ্রহণ মিলিয়ে প্রায় পাঁচ ঘণ্টা আলো-আঁধারিতে ঢাকা থাকবে চাঁদ। বাংলাদেশ সময় রাত ১১টা ১৩ মিনিট ৬ সেকেন্ডে শুরু হওয়া চন্দ্রগ্রহণ শেষ হবে ভোর ৫টা ৩০ মিনিট ২৪ সেকেন্ডে।
কেন্দ্রীয় গ্রহণ হবে বাংলাদেশ সময় রাত ২টা ২১ মিনিট ৪৮ সেকেন্ডে। তা শেষ হবে রাত ৩টা ১৩ মিনিটে। এরপর আবার ৩টা ১৩ মিনিটে ফের শুরু হবে আংশিক গ্রাস, যা শেষ হবে রাত ৪টা ১৯ মিনিটে। আকাশ মেঘমুক্ত থাকলে ঢাকাসহ বাংলাদেশ থেকে গ্রহণটি সম্পূর্ণভাবে দেখা যাবে।
অধিকাংশ সময়েই বাংলাদেশসহ বিশ্বের বিভিন্ন দেশের মানুষ আনন্দ-উৎসব, অনুষ্ঠান আর কৌতুহল নিয়ে সূর্যগ্রহণ ও চন্দ্রগ্রহণ প্রত্যক্ষ করে। কিন্তু বিষয়টি মোটেই আনন্দ-উৎসবের নয়।
গ্রহণ প্রসঙ্গে ইসলামের দৃষ্টিভঙ্গি হলো- চন্দ্র বা সূর্যের আলো নিষ্প্রভ হওয়া আল্লাহতায়ালার অসীম কুদরতের খেলা, যা তিনি মানুষকে সতর্ক করার উদ্দেশ্যে করে থাকেন। যাতে তারা আল্লাহর দরবারে যাবতীয় পাপরাশি থেকে তওবা করে ফিরে আসে।
সূর্য-চন্দ্র গ্রহণের সময় হজরত রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের চেহারা ভয়ে বিবর্ণ হয়ে যেত। এ সময় তিনি সাহাবিদের নিয়ে জামাতে নামাজ পড়তেন, কান্নাকাটি করতেন; আল্লাহতায়ালার কাছে ক্ষমা প্রার্থনা করতেন। এ বিষয়ে হজরত রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেন, ‘চন্দ্র-সূর্য আল্লাহতায়ালার দু’টি বিরাট নিদর্শন। কারও জন্ম বা মৃত্যুতে তার আলো নিষ্প্রভ হয় না। বরং আল্লাহতায়ালা এর মাধ্যমে মানুষকে ভীতি প্রদর্শন ও সতর্ক করেন। সুতরাং চন্দ্র-সূর্য আলোহীন হয়ে পড়লে তোমরা নামাজে দাঁড়িয়ে যাও এবং দয়াময় আল্লাহকে কায়মনোবাক্যে ডাকো, যতক্ষণ না সে অবস্থার পরিবর্তন হয়।’ -সহিহ বোখারি
আমরা জানি, কিয়ামতের পূর্বমুহূর্তে চন্দ্র-সূর্য আলোহীন হয়ে যাবে এবং দু’টিকে একত্রিত করা হবে। তাই চন্দ্র ও সূর্যগ্রহণ কোনো আনন্দদায়ক বিষয় নয় বরং এর মাধ্যমে মানব সম্প্রদায়কে ভয়াবহ কিয়ামতের কথা স্মরণ করানো হয়। যাতে তারা গাফিলতি ত্যাগ করে আখেরাতের প্রস্তুতি গ্রহণ করে।
নবী করিম (সা.)-এর জামানায় একবার চন্দ্র ও সূর্যগ্রহণ হয়েছিল। তখন নবী করিম (সা.) লোকদের মসজিদে সমবেত হতে বলেন এবং অতঃপর সবাইকে নিয়ে সূর্যের আলো পরিষ্কার না হওয়া পর্যন্ত দীর্ঘ নামাজ আদায় করেন। ওই নামাজের কিয়াম, রুকু ও সিজদা ছিল অতি দীর্ঘ। এমনকি অনেক সাহাবা আগ্রহ-উদ্দীপনা থাকা সত্ত্বেও ক্ষান্ত হয়ে গিয়েছিলেন। নামাজ শেষে তিনি বলেন, ‘চন্দ্র ও সূর্য কারও জন্ম বা মৃত্যুতে আলোহীন হয় না। তাই যখন তোমরা চন্দ্র-সূর্যের এ অবস্থা প্রত্যক্ষ করবে, তখন জলদি নামাজে দাঁড়িয়ে যাবে এবং বেশি বেশি দোয়া ও ইস্তেগফার পড়বে। আমি যা জানি তোমরা যদি তা জানতে, তাহলে অধিক পরিমাণে কাঁদতে এবং কম হাসতে।’ –সহিহ বোখারি ও মুসলিম
চন্দ্রগ্রহণের নামাজ সুন্নত। ইমাম আবু হানিফা রহমাতুল্লাহি বলেন, যেহেতু এ নামাজ রাত্রিকালীন তাই ঘরে একাকী আদায় করা উত্তম। -বাদায়েউস সানায়ে
ইসলামি স্কলারদের অভিমতও তাই। গ্রহণের সময় বেশি বেশি নফল নামাজ পড়া, কোরআন তেলাওয়াত করা ও দান-সদকা করা।
সমাজে চন্দ্রগ্রহণ নিয়ে এক ধরনের কুসংস্কার রয়েছে। অনেকেই বলেন, গ্রহণের সময় খেতে নেই, ওই সময়ে তৈরিকৃত খাবার ফেলে দিতে হয়, গর্ভবতী নারীরা ওই সময় যা যা করেন তার প্রভাব সন্তানের ওপর পরে ইত্যাদি। এর কোনোটাই ইসলাম সমর্থন করে না। ইসলাম এসব কুসংস্কারকে কখনোই গুরুত্ব প্রদান করেনি।