সংখ্যালঘুর সমানাধিকার ও সম্মানের শিক্ষা দেয় ইসলাম



ড. মাহফুজ পারভেজ, কন্ট্রিবিউটিং এডিটর, বার্তা২৪.কম

  • Font increase
  • Font Decrease

ধর্মীয়, জাতিগত, ভাষাগত সংখ্যালঘুর মানবাধিকারের দাবিতে সোচ্চার বিশ্ব সম্প্রদায় আইনগত ও সামরিক-বেসামরিক পদক্ষেপ গ্রহণ করেও বিশ্বব্যাপী নিপীড়িত মানবতার আহাজারি থামাতে পারছে না। বরং ইসলামে সংখ্যালঘুর অধিকার সংরক্ষণের উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত থাকার পরেও মুসলিমরাই হচ্ছে সবচেয়ে বেশি নির্যাতিত। ‘ইসলামে সংখ্যালঘুর অধিকার’ সম্পর্কে ঐতিহাসিক পর্যালোচনা: পর্ব- ২

সামান্যতম সংখ্যালঘু উৎপীড়নের আশঙ্কাকা এড়ানোর জন্য মুসলমানের পক্ষে জিম্মির জমি ক্রয় করা নিষিদ্ধ করা হয়েছিল এবং এমন ব্যবস্থা করা হয়েছিল যে- ইমাম, খলিফা, সুলতান বা সাধারণ মুসলমান, কেউই জিম্মিকে তার সম্পত্তি থেকে বেদখল করতে পারবে না। আইনের চোখে মুসলমান আর জিম্মি ছিল সম্পূর্ণ সমান।

খলিফা হজরত আলী (রা.) বলেছেন, ‘তাদের রক্ত আর আমাদের রক্ত একই রকম।’ সমস্ত আধুনিক সরকার, এমন কি সবচেয়ে সভ্য সরকারগুলোও সমানাধিকার ও সংখ্যালঘু নীতির রক্ষার্থে ইসলাম ও এর ভিত্তিতে পরিচালিত শাসনকে তাদের আদর্শ করতে পারে। কারণ, তখন অপরাধের শাস্তির ব্যাপারে শাসক ও শাসিতের মধ্যে কোনো পার্থক্য করা হত না। ইসলামের আইন এই যে, কোনো মুসলমান একজন জিম্মিকে হত্যা করলে তার যা শাস্তি, জিম্মি কোনো মুসলমানকে হত্যা করলে তারও সেই একই শাস্তি।

প্রসঙ্গত খলিফা হজরত ওমর (রা.)-এর আমলের একটি ঘটনার উল্লেখ করা যেতে পারে। বকর ইবনে ওয়াইল নামে জনৈক মুসলমান হাইরূত নামে একজন খ্রিস্টানকে হত্যা করে। বিচার শেষে খলিফা আদেশ দেন, ‘হত্যাকারীকে নিহত ব্যক্তির উত্তরাধিকারীদের হাতে সমর্পণ করা হোক।’ অপরাধীকে হাইরূতের উত্তরাধিকারী হোনাইনের হাতে সমর্পণ করা হলে বদলা হিসাবে হোনাইন তাকে হত্যা করে।

পরবর্তীতে প্রসিদ্ধ হজরত ওমর ইবনে আবদুল আজীজ (রহ.)-এর সময়েও অনুরূপ একটি ঘটনা বর্ণিত হয়েছে। নবী করিম (সা.), তার সাহাবি (রা.) এবং পরবর্তী উত্তরাধিকারীদের (রহ.) কর্ম ও আচরণের মধ্যে অমুসলমান ও সংখ্যালঘুদের প্রতি সমানাধিকার ও সম্মানজনক বিধানের শিক্ষাই লক্ষ্য করা যায়।

অমুসলমান ও সংখ্যলঘুদের প্রতি সহনশীল ও উদার ব্যবহারের উজ্জ্বল আরেক প্রমাণ হল, অমুসলমান ও সংখ্যলঘু জিম্মিগণ মুসলমানদের অসিয়তনামার নির্বাহক নিযুক্ত হতে পারতেন। তারা মুসলিম বিশ্ববিদ্যালয় ও শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের সর্বোচ্চ কর্তা বা রেক্টর নিযুক্ত হতে পারতেন। আর ধর্মীয় অনুষ্ঠান পালনের প্রয়োজন না থাকলে ধর্মস্বত্বে তত্ত্বাবধায়কের পদ পূরণ করতে পারতেন এবং কোনো সুযোগ্য বা গুণবাণ অমুসলমান মারা গেলে মুসলমানরা দলেবলে তার শেষকৃত্যে উপস্থিত থেকে অংশগ্রহণ করতেন। ইসলামের অধীনে প্রতিষ্ঠিত এমন অধিকার, মর্যাদা ও সম্মানের উদার উদাহরণ পৃথিবীর অন্য ধর্ম ও আদর্শের শাসনে শুধু বিরলই নয়; অকল্পনীয়ও বটে।

যদিও ইসলামের প্রাথমিক পর্যায়ে সুস্পষ্ট কারণবশতঃ অমুসলমানদেরকে সামরিক নেতৃত্বে দেওয়া হয়নি; তথাপি অন্যান্য উচ্চবেতনযুক্ত ও দায়িত্বপূর্ণ পদে তারা মুসলমানদের সঙ্গে সম-অধিকারের ভিত্তিতে নিয়োগ লাভ করতেন। এই সমতা কেবল নীতিরই ব্যাপার থাকেনি; বাস্তবায়িতও হয়েছিল। কারণ ইসলামের সূচনাকালেই হিজরি প্রথম শতকে দেখতে পাওয়া যায় যে, খ্রিস্টান-ইহুদি-ম্যাজিয়ানরা গুরুত্বপূর্ণ রাষ্ট্রীয় পদে নিযুক্ত হয়েছেন। প্রাথমিক শাসকগণ প্রজাদের মধ্যে কোনোরূপ ধর্মভিত্তিক পার্থক্য স্বীকার করেননি। আর পরবর্তী শাসকগণও অতি যত্ন সহকারে অগ্রণীদের উদাহরণ অনুসরণ করেছেন।

মোদ্দা কথায়, ইসলামী দেশগুলোতে যদি অমুসলমান-সংখ্যালঘুদের আচরণের সঙ্গে ইউরোপীয় সরকারগুলোর অধীনে অখ্রিস্টানদের প্রতি ব্যবহারের তুলনা করা হয়, তবে সকল বিবেচনায় সমানাধিকার, মানবতা আর মহত্ত্বের পাল্লা ইসলামের দিকেই ঝুঁকবে। আরবের বাইরেও ইসলামী শাসন বা মুসলিম প্রশাসনে অভিন্ন সমানাধিকারের বিবরণ দেখা যায় অমুসলমানদের প্রতি আচরণের ক্ষেত্রে।

দিল্লি¬র মুঘল সম্রাটদের অধীনে অমুসলিম হিন্দুরা সেনাবাহিনীর অধিনায়ক হতেন; প্রাদেশিক শাসনকর্তা নিযুক্ত হতেন; সম্রাটের মন্ত্রী পরিষদ ও পরামর্শ সভায় সদস্যরূপে অন্তর্ভূক্ত হতেন। সুলতানী আমলের বাংলায় অমুসলমান হিন্দুরা ভাষা-শিল্প-সাহিত্য-ধর্ম প্রসারে রাষ্ট্রীয় পূর্ণ সমর্থন ও পৃষ্ঠপোষকতা পেয়ে নবজন্ম লাভ করেন। রাষ্ট্রীয় উচ্চপদে তাদের অবাধ বিচরণ বর্তমানকালের তথাকথিক সমানাধিকারের প্রবক্তাদের কাছেও ভাবনাতীত বিষয় বলে প্রতীয়মান হচ্ছে।

আজকে, এই একবিংশ শতাব্দীতেও কেউই জোর গলায় বলতে পারবে না যে, ইউরোপ-আমেরিকার পশ্চিমা আদর্শের অধীনস্থ মিশ্র জাতি ও ধর্ম বিশিষ্ট দেশগুলোতে বিশ্বাস, ধর্ম, বর্ণ, অঞ্চল, সংস্কৃতি ও বংশের ভিত্তিতে কোনো পার্থক্য নেই!

প্রসঙ্গত ইসলামে রাষ্ট্র ব্যবস্থার লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য হচ্ছে, স্রষ্টা মানুষের মধ্যে যেসব গুণাবলী দেখতে চান সেগুলোর প্রচলন, প্রতিপালন ও বিকাশ এবং তিনি যেগুলোকে ত্রুটিপূর্ণ মনে করেন সেগুলোতে বাধা দেওয়া ও দূর করা। ফলে ইসলামী রাষ্ট্র কোনো রাজনৈতিক প্রশাসনের হাতিয়ারে পরিণত হবে না এবং কোনো নির্দিষ্ট গোষ্ঠীর ইচ্ছাপূরণের মাধ্যম হবে না। ইসলামে রাষ্ট্র কাঠামোয় ব্যক্তি ও রাষ্ট্র সম্মিলিতভাবে ঐশী বিধান অনুযায়ী ধার্মিকতা, নৈতিক উৎকর্ষতা, সৌন্দর্য, সচ্চরিত্রতা, সফলতা, পারস্পরিক শ্রদ্ধা ও সম্মৃদ্ধির আদর্শ-স্থানীয় গুণসমূহ অর্জনের প্রয়াস চালাবে এবং একইসঙ্গে সকল ধরনের অন্যায়, অসভ্যতা, দুর্নীতি, ভ্রান্তি, অসহিষ্ণুতা ও চরমপন্থার বিরুদ্ধে লড়াই করবে। মানবতা ও মানব কল্যাণের জন্য হঠকারিতামুক্ত টেকসই আর স্থায়ী পরিকল্পনা ও কার্যক্রম ইসলামী ব্যবস্থার প্রধান অবলম্বন।

প্রকৃতিগতভাবে মানুষ স্বাধীনরূপে জন্মগ্রহণ করে এবং নিজের খুশি অনুযায়ী বেপরোয়াভাবে যা কিছু ইচ্ছা করতে চায়। দার্শনিক নিৎসরে মতে- ‘একটি শিশুকে জন্মের পর পরই যদি মানুষের তত্ত্বাবধান ছাড়া জঙ্গলে ছেড়ে দেওয়া হয় এবং সে যদি জীবজন্তুর মাধ্যমে লালিত-পালিত হয়, তাহলে সে তার বাকী জীবন জন্তুর মতোই আচরণ করবে। তাকে দেখতে অন্যান্য মানুষের মতো মনে হলেও সে কখনোই মানবিক আচরণ, গুণাবলী ও মর্যাদাবোধ পাবে না। সে কেবলমাত্র একটি সামাজিক ব্যবস্থায় অন্য মানুষের সঙ্গে মিশেই তার মানবিক সম্ভাবনা ও সুযোগকে বিকশিত ও বাস্তবায়িত করতে পারবে।’

নিৎসের বক্তব্যের সঙ্গে বর্তমান কালের পরিস্থিতি পর্যালোচনা করা হলে দেখা যাবে, এখনও চরম শাস্তি বলতে কাউকে সমাজ থেকে বিচ্ছিন্ন ও নিঃসঙ্গ করা উল্লেখযোগ্য। এটাই ভয়ঙ্কর শাস্তি হিসাবে যথেষ্ট, যদি কাউকে কারারুদ্ধ করা হয়, নিঃসঙ্গভাবে আটকে রাখা হয়, এমনকি বিলাস বহুল অবস্থাতে। নিঃসঙ্গভাবে থাকার আরেকটি প্রতিফলন হচ্ছে কবরের ভীতি।

ইসলাম সম্মিলিত সামাজিক জীবন ও মূল্যবোধে বিশ্বাস করে। যে জীবন ও সমাজে থাকবে সম্প্রীতি, শান্তি ও ন্যায়বিচার। এ সব শর্ত মানুষকে তার শারীরিক অস্তিত্বের ঊর্ধ্বে উঠে চিন্তা করতে এবং পরকালের পরবর্তী জীবন সম্পর্কে প্রস্তুতি নিতে উদ্বুদ্ধ করে। ফলে হজ, নামাজ, জাকাত, জিহাদ, সৎ কাজের আদেশ ও অসৎ কাজের নিষেধ ইত্যাদি ইবাদত বা প্রার্থণা ব্যক্তিগত হলেও চূড়ান্ত বিচারে সুন্দর মানুষের বিকাশের মাধ্যমে সমাজ ও রাষ্ট্রকে সুন্দর করার কাজ হিসাবেই চিহ্নিত এবং সমাজ ও রাষ্ট্রকে সহায়তা করারই নামান্তর। ব্যক্তিবর্গের মন ও মানসিকতা এমন হলে পারস্পরিক সহমর্মিতা ও সমানাধিকারের দায়িত্ববোধ জাগ্রত ও প্রতিষ্ঠিত হতে বাধ্য। এভাবেই নিজের, অন্য মানুষের ও সমাজের প্রতি কর্তব্যের ভিত্তিতে ইসলাম মানুষের জন্য সার্বজনীন মানবাধিকারের রূপরেখা প্রণয়ন করেছে এবং তা সকল পরিস্থিতিতে অনুসরণ করতে হবে। এ সকল অধিকার ও দায়িত্ববোধ মুসলমান ও অমুসলমান; সংখ্যাগুরু ও সংখ্যালঘু সকলের জন্যই সমভাবে প্রযোজ্য।

আরও পড়ুন: পর্ব-১: ইসলামে বর্ণবাদ ও বর্ণবৈষম্য বলে কিছু নেই

   

হজযাত্রীদের সেবায় সৌদি ঐতিহ্য



রাহাফ জামবি
অতীতে হজযাত্রীরা দীর্ঘসময় নিয়ে জাহাজে করে আসতেন জেদ্দায়, ছবি: সংগৃহীত

অতীতে হজযাত্রীরা দীর্ঘসময় নিয়ে জাহাজে করে আসতেন জেদ্দায়, ছবি: সংগৃহীত

  • Font increase
  • Font Decrease

ষাটের দশকে বেশিরভাগ মানুষ পবিত্র হজপালন করতে আসতেন জলপথে অর্থাৎ জাহাজে। কোনো হজযাত্রীর জেদ্দাবন্দরে পৌঁছাতে চার-পাঁচ মাস সময় লেগে যেত। জেদ্দায় আসার পরে চড়তে হতো মক্কার বাসে। এ সময় বেশিরভাগ ক্ষেত্রে তাদের যাত্রার সঙ্গী হতেন একজন মুতাওয়িফ।

মুতাওয়িফ হলেন একজন গাইড, হজযাত্রীদের সেবা প্রদানকারী। তিনি মক্কা-মদিনায় হজযাত্রীদের নানাভাবে, নানাক্ষেত্রে সহায়তা করেন এবং তাদের যত্ন নেন, আবাসান ও খাবারের ব্যবস্থা করেন। ঐতিহ্যগতভাবে একজন মুতাওয়িফ পারিবারিকভাবে দায়িত্বটি পালন করতেন এবং এক প্রজন্ম থেকে পরবর্তী প্রজন্মের কাছে এভাবেই রীতিটি হস্তান্তরিত হতো। একসময় এই অতীত রীতি ব্যক্তি পর্যায়ে সীমাবদ্ধ থাকলেও এখন তা প্রাতিষ্ঠানিক রূপ নিয়েছে।

রিয়াদের বাসিন্দা হায়াত ইদ একজন সাবেক মুতাওয়িফ। তিনি অতীতের কথা স্মরণ করে বলেন, এ সময়টাতে তিনি তার সবচেয়ে সুন্দর পোশাক পরে, বাড়িতে ধূপ জ্বালিয়ে দূর থেকে আসা হজযাত্রীদের স্বাগত জানাতে প্রস্তুত থাকতেন।

ইদের দাদা একসময় হজযাত্রীদের আবাসনের ব্যবস্থা করে দিতেন এবং সেগুলো নিজেই পরিষ্কার করতেন। তিনি হজযাত্রীদের সহায়তা দেওয়ার জন্য সুপারভাইজার এবং অনুবাদক নিয়োগ করতেন। পরে এ দায়িত্ব বর্তায় তার ছেলে ইদের বাবার হাতে।

হায়াত ইদের বাবা জামিল আবদুর রহমান ইদ দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার হজযাত্রীদের ‘শায়খ’ (শায়খ একটি সম্মানসূচক পদবি। এটি সাধারণত ধর্মীয় শিক্ষকদের ক্ষেত্রে ব্যবহৃত হতো। তবে সৌদি আরবে কোনো বিষয়ে অভিজ্ঞদের পদবি হিসেবেও শায়খ ব্যবহৃত হয়।) ছিলেন বলে জানান তিনি। জনসাধারণের মাঝে মুতাওয়িফদের শায়খ হিসেবেই পরিচিতি ছিল।

ইদ পরিবার বংশ পরম্পরায় হাজিদের সেবা করে আসছেন, ছবি: সংগৃহীত

হায়াত ইদ বলেন, ‘আমার দাদার পাশাপাশি দাদীও মুতাওয়িফ ছিলেন। আমার দাদা ছিলেন ‘জাভার শায়খ’ অর্থাৎ ইন্দোনেশিয়া থেকে আগত হজযাত্রীদের সেবা করতেন তিনি। আমার দাদা-দাদি মারা যাওয়ার পর আমার বাবা মুতাওয়িফের পদ গ্রহণ করেন।’

যাট ও সত্তরের দশকের সেই দিনগুলোর কথা মনে করে ৫০ বছর বয়সী ইদ বলেন, হজযাত্রীরা তার পরিবারকে চিঠি পাঠাতেন যেন তাদের আবাসনের সুযোগ হয়। হজযাত্রীদের জন্য ঈদের সময় বাড়তি খাবারেরও প্রস্তুতি নিত তার পরিবার।

শায়খরা হজযাত্রীদের হজের আচার-অনুষ্ঠান এবং তাদের কী করা উচিত সেসব বুঝিয়ে দিতেন। তাদেরকে মক্কা এবং অন্যান্য স্থানে নিয়ে যাওয়া এবং সঙ্গে করে বাড়ি ফিরে আনার দায়িত্ব ছিল তাদের।

এ সময় তার ভাই আদেল ইদ বলেন, মুতাওয়িফের ভূমিকা অতীতে একটি স্বতন্ত্র অবস্থান ছিল কিন্তু এখন এটি একটি প্রাতিষ্ঠানিক ভূমিকায় পরিণত হয়েছে।

হজযাত্রীদের খাবারের প্রস্তুতি, ছবি: সংগৃহীত

প্রত্যেক মুতাওয়িফকে তাদের সামর্থ্যের ভিত্তিতে নির্দিষ্টসংখ্যক হজযাত্রীর দায়িত্ব দেওয়া হত। কেউ মাত্র ১০০ জনের দায়িত্ব নিত, আবার অনেকে ১ হাজার জনেরও দায়িত্ব নিতে পারত। তবে তাদের অবশ্যই হজযাত্রীদের ভাষা বোঝার জন্য বা তাদের সঙ্গে কথা বলতে দোভাষী নিয়োগ দিতে হত।

তিনি বলেন, প্রত্যেক মুতাওয়িফ একাই হজযাত্রীদের সেবা করতে পারতেন। তারা নির্দিষ্ট এলাকার হজযাত্রীদের সুষ্ঠুভাবে সেবা প্রদানের জন্য সেসব দেশে ভ্রমণ করতেন এবং তাদের বিভিন্ন বিষয়গুলো শিখে আসতেন। তাদের খাদ্যাভ্যাস, রুচি, আচার-আচরণ ও ভাষা রপ্ত করাও ছিল একজন মুতাওয়িফের বিশেষ গুণ।

ইদ পরিবার ইন্দোনেশিয়া থেকে আসা হজযাত্রীদের সহায়তা করত। তাই তারা মালয় ভাষা এবং তাদের মেহমানদের পছন্দের মশলা এবং খাবার সম্পর্কে শিখেছিলেন, যেন তারা হজযাত্রীদের যতটা সম্ভব মক্কাকে নিজের বাড়ি অনুভব করাতে পারেন।

একইভাবে ৪৬ বছর বয়সী উইজদান আবদুর রাজ্জাক লুলু বুকাস উত্তরাধিকারসূত্রে মুতাওয়িফের পেশা পেয়েছেন। তিনি মালয় ভাষায় সাবলীল ছিলেন। তার বাবা এবং দাদার কাছ থেকে মালয় ভাষা রপ্ত করেন তিনি।

১৯৯৩ সালে হজযাত্রীদের সঙ্গে আবদুর রাজ্জাক লুলু বুকাস, ছবি: সংগৃহীত

তিনি বলেন, কিছু জাতীয়তা বা দেশের ভাষা অন্যদের চেয়ে বেশি চ্যালেঞ্জিং বলে মনে হয়। এক্ষেত্রে আমরা সে দেশের অনুবাদক নিয়োগ দিই। উদাহরণস্বরূপ, আমরা দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার হজযাত্রীদের সেবাপ্রদানের ক্ষেত্রে তাদের সঙ্গে তাদের নিজস্ব ভাষায় কথা বলি। কিন্তু চীনা ভাষা কঠিন, তাই আমরা চীনা যাত্রীদের জন্য একজন দক্ষ অনুবাদক নিয়োগ দিয়েছি।

বুকাস বলেন, কিছু হজযাত্রী ঈদুল আজহায় মুতাওয়িফকে উপহার দেওয়ার জন্য উপহার হিসেবে সোনা বা মুক্তা নিয়ে আসতেন। তার বাবা, আবদুল হান্নান লুলু বুকাস হজযাত্রীদের কাছ থেকে অনেক উপহার পেয়েছেন বলে তার নামের সঙ্গে লুলু যোগ করেছেন যার অর্থ মনিমুক্তা।

মুতাওয়িফ থাকা অবস্থায় ঘটা এক অবিস্মরণীয় পরিস্থিতির বর্ণনা করেন বুকাস। তিনি একজন গর্ভবতী নারী হজযাত্রীর কথা বলেন, যিনি হজে এসে বাচ্চা জন্ম দিয়েছিলেন। তিনিই তখন তাকে হাসপাতালে নিয়ে যান এবং ওই নারী নিরাপদে সন্তান জন্ম দেন।

বুকাস বলেন, তিনি বছরের পর বছর ধরে হজের বহু অভিজ্ঞতা অর্জন করেছেন। তবে বর্তমান সময়ে বেশ ভালোই পরিস্থিতির পরিবর্তন দেখেছেন বলে মন্তব্য করেন তিনি।

তিনি বলেন, অতীতে এবং আধুনিক সময়ের হজের মধ্যে পার্থক্য হলো- যাতায়াত ও আবাসনের অসুবিধা এবং চ্যালেঞ্জ মোকাবেলায় আগে কয়েক মাস সময় লেগে যেত। যা এখন মাত্র ঘণ্টায় সমাধান হয়ে যায়। এক্ষেত্রে সৌদি সরকারের প্রশাসনিক সুবিধার বিষয়টির ভূমিকা রয়েছে বলে মনে করেন তিনি।

আরব নিউজ থেকে অনুবাদ আসমা ইসলাম, নিউজরুম এডিটর, বার্তা২৪.কম

;

সৌদিতে আরও এক বাংলাদেশি হজযাত্রীর মৃত্যু



ইসলাম ডেস্ক, বার্তা২৪.কম
ছবি: সংগৃহীত

ছবি: সংগৃহীত

  • Font increase
  • Font Decrease

চলতি মৌসুমে হজ পালন করতে গিয়ে মো. মোস্তফা (৮৯) নামে আরও এক হজ যাত্রী মারা গেছেন। শনিবার (১৮ মে) মক্কায় মারা যান তিনি।

রোববার (১৯ মে) রাত ২টার হজ পোর্টালের আইটি হেল্প ডেস্কের প্রতিদিনের বুলেটিন থেকে এ তথ্য জানা গেছে।

এর আগে, গত বুধবার (১৫ মে) চলতি হজ মৌসুমে সৌদি আরবের প্রথম বাংলাদেশি এক হজযাত্রী মারা যান। মো. আসাদুজ্জামান নামের ওই ব্যক্তি মদিনায় মৃত্যুবরণ করেন।

এ দিকে পবিত্র হজ পালন করতে গিয়ে এখন পর্যন্ত (১৮ মে রাত ১টা ৫৯ মিনিট) সৌদি পৌঁছেছেন ২৮ হাজার ৭৬০ জন হজযাত্রী। মোট ৭২টি ফ্লাইটে তারা সৌদিতে পৌঁছান। এর মধ্যে সরকারি ব্যবস্থাপনায় ৩ হাজার ৭৪৭ জন ও বেসরকারি ব্যবস্থাপনায় হজযাত্রী ২৫ হাজার ১৩ জন। এখন পর্যন্ত ৮১ হাজার ৮৬২টি ভিসা ইস্যু করা হয়েছে।

হজ সম্পর্কিত সবশেষ বুলেটিনে এ তথ্য জানানো হয়েছে। এয়ারলাইন্স, সিভিল এভিয়েশন অথরিটি অব বাংলাদেশ, বাংলাদেশ হজ অফিস ঢাকা এবং সৌদি আরব সূত্রে এ তথ্য জানিয়েছে হেল্পডেস্ক।

হেল্প ডেস্কের তথ্য মতে, এ পর্যন্ত মোট ৭২টি ফ্লাইটের মধ্যে বিমান বাংলাদেশ এয়ারলাইনসের ২৮টি, সৌদি এয়ারলাইনসের ২৬টি এবং ফ্লাইনাস এয়ারলাইনস ২০টি ফ্লাইট পরিচালনা করেছে।

হজ ফ্লাইট শুরু হওয়ার পর গত মধ্যরাত পর্যন্ত ৮১ হাজার ৮৬২ জন হজযাত্রীর ভিসা ইস্যু হয়েছে। সে হিসেবে এখনো ৩ হাজার ৩৯৫ জন হজযাত্রীর ভিসা হয়নি। সর্বশেষ শনিবার (১৮ মে) মো. মোস্তফা নামের ৮৯ বছর বয়সী হজযাত্রী মক্কায় মারা যান।

;

নিবন্ধিত কোনো হজযাত্রী হজপালনে বঞ্চিত হবেন না



মুফতি এনায়েতুল্লাহ, অ্যাসিস্ট্যান্ট এডিটর, বার্তা২৪.কম
হজ ক্যাম্পে হজযাত্রীদের একাংশ, ছবি: বার্তা২৪.কম

হজ ক্যাম্পে হজযাত্রীদের একাংশ, ছবি: বার্তা২৪.কম

  • Font increase
  • Font Decrease

নিবন্ধিত কোনো হজযাত্রী হজপালনে বঞ্চিত হবেন না বলে আশাবাদী বাংলাদেশ হজ অফিসের পরিচালক মুহাম্মদ কামরুজ্জামান।

ভিসা না হওয়া হজযাত্রীরা এক ধরনের অনিশ্চয়তার মধ্যে রয়েছেন। তবে বাংলাদেশ হজ অফিসের পরিচালক মুহাম্মদ কামরুজ্জামান বার্তা২৪.কমকে বলেন, চলতি হজ মৌসুমে নিবন্ধিত সবার ভিসা হবে বলে আমি আশাবাদী। কয়েকটি এজেন্সির হজযাত্রী নিয়ে জটিলতা হচ্ছে, তার অর্ধেকই ইতোমধ্যে সমাধান হয়েছে। বাকি কাজ সমাধানের পথে।

জিলহজ মাসে চাঁদ দেখা সাপেক্ষে ১৬ জুন পবিত্র হজ অনুষ্ঠিত হতে পারে। বাংলাদেশ থেকে ৯ মে শুরু হওয়া হজফ্লাইট শেষ হবে ১০ জুন। এই সময়ের মধ্যে সরকারি ও বেসরকারি ব্যবস্থাপনায় গাইডসহ হজপালনে সৌদি আরব যাবেন ৮৫ হাজার ১১৭ জন। ইতোমধ্যে ২৮ হাজার ৪ জন হজযাত্রী সৌদি আরব পৌঁছেছেন। ৮২ হাজার ১০০ জনের ভিসা ভিসা হয়েছে। এখনও বেসরকারিভাবে নিবন্ধিত ৩ হাজার ৩৩৬ জনের ভিসা হয়নি।

মুহাম্মদ কামরুজ্জামান, পরিচালক, হজ অফিস, ছবি: বার্তা২৪.কম

জানা গেছে, যথাসময়ে ভিসার আবেদন না করায় ওয়ার্ল্ডলিঙ্ক ট্যুরস অ্যান্ড ট্রাভেলস (লাইসেন্স ৫৭০, যাত্রী সংখ্যা ২৮৬), আনসারি ওভারসিস (লাইসেন্স ৬০১, যাত্রী সংখ্যা ২৬০), আল রিসান ট্রাভেল এজেন্সি (লাইসেন্স ৬৭২, যাত্রী সংখ্যা ৪৪৪), মিকাত ট্যুর অ্যান্ড ট্রাভেলস (লাইসেন্স ১০২৫, যাত্রী সংখ্যা ৩৭৫), নর্থ বাংলা হজ ট্রাভেলস এন্ড ট্যুরস (লাইসেন্স ১০৮৬, যাত্রী সংখ্যা ২৬০), হলি দারুন নাজাত হজ ওভারসিস (লাইসেন্স ১৪৬২, যাত্রী সংখ্যা ২৫০) কে ধর্ম মন্ত্রণালয় শোকজ করে। এসব এজেন্সির মাধ্যমে ১ হাজার ৮৭৫ জনের চলতি বছর হজে যাওয়ার কথা রয়েছে।

আর আল রিসান ট্রাভেলস এজেন্সির নিবন্ধিত হজযাত্রীদের মধ্যে এখন পর্যন্ত কারও ভিসা না করায় বৃহস্পতিবার (১৬ মে) এজেন্সির ব্যবস্থাপনা পরিচালক মো. আব্দুস সালাম মিয়ার দেশত্যাগ স্থগিত ও তার বিরুদ্ধে আইনি ব্যবস্থা নেওয়ার জন্য স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে চিঠি দিয়েছে ধর্ম মন্ত্রণালয়।

হজ এজেন্সির মালিকদের সংগঠন হজ এজেন্সিস অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশ (হাব)-এর সভাপতি এম শাহাদাত হোসাইন তসলিম বার্তা২৪.কমকে বলেন, আল রিসান ট্রাভেলস এজেন্সিসহ অভিযুক্ত এজেন্সির মালিকদের নিয়ে আমরা বসে, পয়েন্ট পয়েন্ট ধরে সমস্যা নিয়ে আলোচনা করে সমাধানের চেষ্টা করেছি। ইতোমধ্যে হলি দারুন নাজাত হজ ওভারসিস, ওয়ার্ল্ডলিঙ্ক ট্যুরস অ্যান্ড ট্রাভেলস এবং মিকাত ট্যুর অ্যান্ড ট্রাভেলসের হজযাত্রীদের ভিসা প্রক্রিয়া শুরু হয়েছে। অন্যদেরও হয়ে যাবে। নিবন্ধিত কোনো হজযাত্রী হজপালন থেকে বঞ্চিত হবেন না বলেও তিনি আশা প্রকাশ করেন।

এমন আশাবাদী হওয়ার কারণ জানতে চাইলে হাব সভাপতি বলেন, হজ ব্যবস্থাপনায় সৌদি আরব অংশে যে পরিমাণ অর্থ প্রেরণ করা দরকার এজেন্সিগুলো তা পাঠিয়েছে। আর যতটুকু সমস্যা রয়েছে, আশা করি তা সমাধান করা যাবে।

এম শাহাদাত হোসাইন তসলিম, ছবি: বার্তা২৪.কম

এ বিষয়ে জানতে চাইলে আল রিসান ট্রাভেলস এজেন্সি লিমিটেডের ব্যবস্থাপনা পরিচালক মো. আব্দুস সালাম মিয়া বার্তা২৪.কমকে বলেন, ‘আমি এবার হজে কোনো লোক পাঠাইনি। আকবর হজ গ্রুপের মুফতি লুৎফর রহমান ফারুকী তার লাইসেন্সে সমস্যা হওয়ায় আমার লাইসেন্স ব্যবহার করে ৪৪৮ জন হজযাত্রী পাঠাচ্ছে। চলতি সমস্যা নিয়ে হাব সভাপতির সঙ্গে বৈঠকে মুফতি লুৎফর রহমান সৌদি থেকে ফোনে কথা বলেছেন, তিনি আশ্বস্থ করেছেন; আজকালের মধ্যে ২০ থেকে ৩০ জনের ভিসা হয়ে যাবে। আর আগামীকাল বা পরশুর মধ্যে সবার ভিসা হয়ে যাবে। তিনি মদিনার বাড়ি ভাড়া করেছেন, মক্কার বাড়িও ভাড়া হওয়ার পথে।’

;

মৃত্যুদণ্ড কার্যকরের আগমুহূর্তে ছেলের খুনিকে ক্ষমা করলেন বাবা



ইসলাম ডেস্ক, বার্তা২৪.কম
আল হুমাইদি আল হারবি, ছবি: সংগৃহীত

আল হুমাইদি আল হারবি, ছবি: সংগৃহীত

  • Font increase
  • Font Decrease

মৃত্যদণ্ড কার্যকরের আগ মুহূর্তে ছেলের খুনিকে ক্ষমা করে দিলেন বাবা। শেষ সময়ে জন্মদাদা বাবার এমন উদারতা দেখে উপস্থিত কর্মকর্তারা হতবাক হয়ে যায়। ঘটনাটি ঘটেছে সৌদি আরবে। খবর গালফ নিউজের।

আল হুমাইদি আল হারবি নামের ওই বাবা হঠাৎ করে দণ্ড কার্যকরের স্থানে যান। সেখানে গিয়ে ঘোষণা দেন, ছেলের হত্যাকারীকে ক্ষমা করে দিয়েছেন তিনি। ওই হত্যাকারীর দণ্ড কার্যকরের প্রস্তুতি নেওয়ার আগে আল হুমাইদি আল হারবির কাছে একাধিকবার গিয়েছিলেন সরকারি কর্মকর্তারা।

কিন্তু ওই সময় তিনি ছেলের হত্যাকারীকে ক্ষমা করতে চাননি। কিন্তু পরে নিজের সিদ্ধান্ত পরিবর্তন করেন। নিজ ছেলের হত্যাকারীকে ক্ষমা করার একমাত্র অধিকারী ব্যক্তি ছিলেন ওই বাবা। সে অনুযায়ী, বিনা শর্তে তিনি হত্যাকারীকে ক্ষমা করে দেন। এতে করে সেখানে থাকা সবাই বেশ অবাক হন।

আল হারবি জানিয়েছেন, ধর্মীয় দিক বিবেচনা করে তিনি এমন সিদ্ধান্ত নিয়েছেন। যদিও প্রথমে হত্যাকারীকে ক্ষমা করতে চাননি। কিন্তু পরে নিজের মন পরিবর্তন করেন। ছেলের হত্যারকারীকে ক্ষমা করা ওই বাবার এমন উদারতার প্রশংসা করেছেন সাধারণ মানুষ। তারা এটিকে ক্ষমার একটি অনন্য উদাহরণ হিসেবে অভিহিত করেছেন।

খবরে প্রকাশ, নিজ গোত্রের প্রতিবেশীর বন্ধুর ছেলের হাতে তার ছেলে খুন হন। দেশটির আইন অনুযায়ী বিচার শেষে হত্যাকারীর মৃত্যুদণ্ড ঘোষণা করা হয়। সৌদি আরবের আইনে রক্তপণ নিয়ে কিংবা অভিভাবক হিসেবে খুনিকে ক্ষমা করে দেওয়ার বিধান রয়েছে।

সে হিসেবে তিনি ছেলের খুনিকে ক্ষমা করে বলেন, ‘আমাদের সম্পর্ক আজও আগের মতো।’

তার স্পষ্ট কথা, আমি একমাত্র আল্লাহর সন্তুষ্টির জন্য ছেলের হত্যাকারীকে ক্ষমা করেছি। এ বিষয়ে সরকারি কর্মকর্তারা ক্ষমার কথা বললেও তার পরিবার ক্ষমা প্রসঙ্গে কোনো কথা বলেননি।

তিনি আরও বলেন, ঘটনার পর আমাদের সম্পর্ক গত ছয় দশকের মতোই আজও আছে। ছেলের খুনের পর যেমন ছিল, এখনও সম্পর্ক তেমনি আছে।

হত্যাকারীর বাবা আবদুল মাজিদ আল হারবি বলেন, আমি নিহতের বাবাকে অন্তরের অন্তস্থল থেকে শ্রদ্ধা করি এবং সম্মান করি, তিনি আমার ভাইয়ের চেয়েও বেশি।

;