দয়া করে উপরওয়ালাকে আর ফাঁকি দেবেন না

  • শেখ মামুনুর রশীদ, অতিথি লেখক
  • |
  • Font increase
  • Font Decrease

নামাজি কখনও মিথ্যা বলবেন না- এটাই কাম্য, ছবি: সংগৃহীত

নামাজি কখনও মিথ্যা বলবেন না- এটাই কাম্য, ছবি: সংগৃহীত

নামাজ ফরজ ইবাদত। ইসলামে দৈনিক পাঁচ ওয়াক্ত নামাজ পড়ার বাধ্যবাধকতা রয়েছে। ইসলাম ধর্মে আরও কিছু বিষয়ের বাধ্যবাধকতা আছে। যেমন- মিথ্যা না বলা। বলাই হয়- মিথ্যা বলা মহাপাপ। ইসলামে ঘুষ খাওয়া, দুর্নীতি করা, ওজনে কারচুপি করা, মদ্যপান করা, বিয়ে বহির্ভূত সম্পর্ক করা, অতিরিক্ত মুনাফা করা, সুদের ব্যবসা করা- প্রভৃতি হারাম।

অনেককে দেখি নিয়মিত নামাজ পড়েন, আবার নিয়ম করে ঘুষ খান। দুর্নীতির টাকায় বাড়ি-গাড়ি-জমি কেনেন। ছেলে-মেয়েকেও ঘুষ-দুর্নীতির টাকায় দেশে-বিদেশে লেখাপড়া করান, মানুষ করার চেষ্টা করেন। স্ত্রীকে দামি অলঙ্কার দেন। নিজে নানাবিধ অনাচারে লিপ্ত থাকেন। এই শ্রেণির লোকদের আয়ের তুলনায় উপার্জন বেশি। মানে বেতনের চেয়ে ঘুষই বেশি। জোর করে না, খুশি হয়ে উপরি নেন তারা!

বিজ্ঞাপন

মজার বিষয় হচ্ছে, শুক্রবার এলে জুমা নামাজ পড়তে এমন মুসল্লির ঢল নামে মসজিদে। নানা ব্রান্ডের গাড়িতে চড়ে তারা মসজিদে আসেন। শরীর থেকে দামি আতরের ঘ্রাণ বের হয়, হাতে শোভা পায় বিদেশি জায়নামাজ, তসবি। আবার কেউ কেউ চোখে সুরমাও দেন। চকচকে জুতা, ধবধবে পোশাক, মাথায় বাহারি টুপি দেখে মনে হবে সব ভালো মানুষের সমাহার ঘটেছে। মসজিদের ভেতরে জায়গা নেই। তবুও সামনের দিকে যেতে হবে তাদের। এই নামাজ উপরওয়ালাকে সন্তুষ্ট করার জন্য নাকি লোক দেখানো- সেটা ভালো জানেন কাজটা যিনি করেন তিনি। হ্যাঁ, এটা ঠিক, সংখ্যায় যদিও এরা কম। তবে তারা ধনিক শ্রেণির প্রতিনিধিত্ব করেন। তারা প্রভাবশালী, তারাই রাষ্ট্র, সমাজ ও জগৎ-সংসারের নীতি-নির্ধারক।

তাই তারা সবার দৃষ্টি আকর্ষণের চেষ্টা করেন। মসজিদের বাইরে ভিক্ষুকরাও তাদের দিকে তীর্থের কাকের মতো তাকিয়ে থাকেন। নামাজ শেষে বের হওয়ার পথে কিংবা মসজিদে ঢোকার মুখে যদি কিছু পয়সা-কড়ি মেলে। টাকা কালো হোক-সাদা হোক, সৎ পথে আসুক, না হয় অসৎ পথে- ভিক্ষুকের তাতে কি? ওর শূন্য থালায় কিছু পরলে, পেটে খাবার জুটবে। ওর বেঁচে থাকার একটা মানে দাঁড়াবে।

বিজ্ঞাপন

শুলশান আজাদ মসজিদ, বায়তুল মোকাররম জাতীয় মসজিদ, হাইকোর্ট মাজার মসজিদ কিংবা শহর-বন্দর-গ্রামে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা লাখো মসজিদে জুমার দিনের চিত্র অনেকটা এমন। এদিন যেমন মসজিদে মানুষের জনস্রোত নামে, তেমনি ভিক্ষ‌ুকেরও ঢল নামে। যার যেখানে যা প্রাপ্তি- তার ওপর নির্ভর করে চলে মানুষের আনাগোনা।

বিখ্যাত উর্দু কবি মির্জা গালিব বোধহয় তাদের কথা ভেবেই বলেছিলেন, ‘হে খোদা! তোমাকে খুঁজি কোথায়, তুমি থাকো কোথায়।’ কোরআন শরিফের বহু জায়গায় বলা আছে, ‘খোদা সবখানেই আছেন, থাকেনও।’ বাইবেলেও বলা হয়েছে, ‘ঈশ্বর সর্বত্র বিরাজমান।’

কেবল তাকে ফ‌াঁকি দিতে চায় কিছু ঠকবাজ মানুষ। তারা মানুষকে ফাঁকি দেয়। ফাঁকি দেয় নিজের পরিবারকে। সমাজ এবং রাষ্ট্রকেও এরা নিয়ম করে ফাঁকি দেয়। ফাঁকির নেশায়, ফাঁকি প্রবণতায় তারা অন্যের জন্য গর্ত খোঁড়ে, একসময় নিজেও সেই ফাঁকির গর্তে ডুবে মরে। এটাকেই বলে নিয়তি।

শুরুতেই বলছি, ইসলাম ধর্মে নামাজ ফরজ। তদ্রুপ রোজা রাখা, হজপালন করা, জাকাত আদায় করাও ফরজ। তবে সবার আগে ইমান আনতে হবে এক আল্লাহর ওপর, নবী মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আল্লাহর রাসূল হওয়ার ওপর। তবেই তিনি মুসলমান হিসেবে স্বীকৃতি পাবেন। এরপর একে একে অন্য ফরজগুলো আদায় করবেন। পাঁচ ওয়‌াক্ত নামাজ পড়া হচ্ছে দ্বিতীয় ধাপ। নামাজি কখনও মিথ্যা বলবেন না- এটাই কাম্য ও ধর্মীয় বিধান। কারণ, মিথ্যা সকল পাপের জননী, মিথ্যা থেকে সূচনা ঘটে অন্য পাপের।

শুক্রবার জুমার নামাজ পড়তে মসজিদে মসজিদে ধর্মপ্রাণ মানুষের উপচে পড়া ভিড় দেখে ভালো লাগে। আশাবাদী হই। এবার বুঝি সমাজ থেকে ঘুষ, দুর্নীতি, অনিয়ম, হিংসা, বিদ্বেষ, হানাহানি, রাহাজানি, হত্যা, ধর্ষণ, লুটতরাজ চিরতরে বিদায় নেবে- এমন আশা হৃদয়ে বুনতে থাকি। ভাবতে থাকি, মসজিদ থেকে বের হয়েই প্রত্যেকে সত্য কথা বলবে; সৎ পথে চলবে।

দোকানের ঝাঁপ বন্ধ করে যে ক্ষুদ্র ব্যবসায়ী নামাজ পড়তে মসজিদে যান, ফিরে এসে তিনি ওজনে আর কারচুপি করবেন না- এমন আশা করি। স্বপ্ন দেখি, ওই ব্যবসায়ী পঁচা আর ফরমালিন দেওয়া পণ্য বিক্রি করা থেকে বিরত থাকবেন। যে শিক্ষক মসজিদে যেয়ে নামাজ পড়ছেন, ফিরে এসে তিনি অনৈতিক কোচিং বন্ধ করবেন, টাকার বিনিময়ে আর নোট বিক্রি করবেন না। গরিব ও অসচ্ছল শিক্ষার্থীর কথা ভাববেন, সম্ভব হলে বিনা পয়সায় তাদের পড়াবেন।

শুধুমাত্র একজন ক্ষুদ্র ব্যবসায়ী বা একজন সাদামাটা শিক্ষককে বদলালে হবে না। বদলাতে হবে সব শ্রেণি পেশার লোকজনকে। অবৈধ পথে, অসৎ উপার্জনে যে যত উঁচুতে, কিংবা উপরতলায় বসবাস করছেন- বদলাতে হবে তার সবার আগে। আর তা করতে না পারলে ঘরে চুপ করে বসে থাকুন। করোনার ভয়ে এখন যেমন ঘরের কোণে আশ্রয় নিয়েছেন, সেভাবেই চুপচাপ শান্ত হয়ে ঘরে থাকুন। আর আয়নায় নিজেকে দেখুন। নিজে কি করছেন- ভাবুন।

ধর্মপ্রাণ আর ধর্ম ব্যবসার পার্থক্য জানার চেষ্টা করুন। অন্তর দিয়ে ধর্ম পালন আর লোক দেখানো ধর্ম পালনের সংস্কৃতি যে আলাদা, হৃদয় দিয়ে সেটা অনুভব করার চেষ্টা করুন। দয়া করে আর উপরওয়ালাকে ফাঁকি দেবেন না। মনে রাখবেন, তিনি সর্বত্র বিরাজমান। তিনি সব দেখেন, সব বোঝেন।

লেখক: শেখ মামুনুর রশীদ, সিনিয়র সাংবাদিক ও সদস্য- বিএফইউজে ও পিআইবি