আমার ঘর, আমার মসজিদ

  • মুফতি মাহফূযুল হক, অতিথি লেখক, ইসলাম
  • |
  • Font increase
  • Font Decrease

ঘরে জামাতে নামাজ আদায় সওয়াবের কাজ, ছবি: সংগৃহীত

ঘরে জামাতে নামাজ আদায় সওয়াবের কাজ, ছবি: সংগৃহীত

করোনা পরিস্থিতিতে সরকারি নিষেধাজ্ঞার কারণে এখন আর মসজিদে যাওয়া যাচ্ছে না। ঘরে থাকতে হচ্ছে সবাইকে। এতে সবারই মন ভাঙা, মনে অনেক কষ্ট। আমাদের মনের এ ব্যথা কিছুটা লাঘব হবে, অস্থির মন কিছুটা প্রশান্তি পাবে যদি আমরা প্রত্যেকে আমাদের প্রতিটি ঘরকে একেকটি মসজিদে পরিণত করি। আমাদের ঈমানি স্লোগান হক, আমার ঘর আমার মসজিদ।

মসজিদের আমলগুলো ঘরে চালু করি। ঘরে মসজিদের পরিবেশ সৃষ্টি করি। এতে ২৪ ঘণ্টাই মনে হবে আমি যেন মসজিদেই আছি।

বিজ্ঞাপন

মসজিদের সর্বাধিক গুরুত্বপূর্ণ আমল হলো- পাঁচ ওয়াক্ত নামাজের জামাত। আমরা নিষেধাজ্ঞার দিনগুলোতে ঘরে ঘরে পাঁচ ওয়াক্ত নামাজের জামাত কায়েম করি। ঘরের জামাতের জন্য আজান ও ইকামত ইচ্ছে হলে দিতে পারেন। আবার না দিলেও চলবে। কেননা, মহল্লার মসজিদের আজান-ইকামাত মহল্লাবাসীদের জন্য যথেষ্ট। কিন্তু মহল্লার মসজিদ যদি বন্ধ থাকে, তাতে আজান ইকামত না হয় তাহলে ঘরের জামাতের জন্য আজান-ইকামত দেওয়াই বাঞ্চনীয়। প্রাপ্তবয়স্ক পুরুষদের মধ্যে যার কোরআন পড়া বেশি শুদ্ধ তিনি ইমাম হবেন, বাকিরা সবাই মুক্তাদি।

দু’জন পুরুষ জামাত করলে মুক্তাদি ইমামের ডান পাশে দাঁড়াবে। তবে সতর্কতারস্বরূপ কয়েক আঙুল পরিমাণ পেছনে। দুইয়ের অধিক পুরুষ জামাত করলে সবাই ইমামের পেছনে দাঁড়াবে। একজন পুরুষ, এক বা একাধিক মহিলা জামাত করলে মহিলা দাঁড়াবে পুরুষের বরাবর পেছনে। দু’জন পুরুষ এবং এক বা একাধিক মহিলা জামাত করলে পুরুষ মুক্তাদি ইমামের পাশে কয়েক আঙুল পিছিয়ে দাঁড়াবে আর এক বা একাধিক মহিলা ইমামের বরাবর পেছনে। লক্ষ্য রাখতে হবে যেন, সেজদাতে মহিলার মাথা পুরুষ মুক্তাদির পাশাপাশি না হয়। সামনে পেছনে যেন থাকে।

বিজ্ঞাপন

দুইয়ের অধিক পুরুষ এবং এক বা একাধিক মহিলা জামাত করলে পুরুষ মুক্তাদিরা ইমামের পেছনে দাঁড়াবে আর এক বা একাধিক মহিলা পুরুষদের সারির পেছনে দাঁড়াবে। জায়গা সঙ্কুলান না হলে দুইয়ের অধিক পুরুষ মুক্তাদি ইমামের দু’পাশে দাঁড়াতে পারবে। কিন্তু মহিলারা কোনো অবস্থাতেই জামাতে নামাজ পড়াকালীন সময় কোনো পুরুষের পাশাপাশি হতে পারবে না। শুধু স্বামী-স্ত্রী অথবা শুধু মা-পুত্র অথবা শুধু ভাই-বোন অথবা শুধু পিতা-কন্যা জামাত করতে পারবে। দাঁড়াতে হবে উপরোক্ত নিয়মে।

মসজিদের দ্বিতীয় গুরুত্বপূর্ণ আমল হলো- কোরআন শেখানো। নিষেধাজ্ঞার দিনগুলোতে আমরা মসজিদের এ আমলের প্রতি অনেক বেশি যত্নশীল হতে পারি। ঘরের সদস্যদের মধ্যে যার কোরআন পাঠ অন্যদের চেয়ে তুলনামূলক বেশি শুদ্ধ- তিনি অন্য সবাইকে কোরআন পড়া শেখাবেন। যদি বাসার সবার কোরআন পড়া শুদ্ধ থাকে তাহলে কোরআন মুখস্থ করার চর্চা শুরু করতে পারেন। বাসার প্রত্যেকই যার যার সাধ্য অনুযায়ী প্রতিদিন নিয়মিত একটু একটু করে কোরআন মুখস্থ করবে আর বাসার অন্যদের শোনাবে।

মসজিদের তৃতীয় গুরুত্বপূর্ণ আমল ওয়াজ-নসিহত। ঘরের কোনো সদস্য যদি আলেম হন, তিনি প্রতিদিন নির্দিষ্ট পরিমাণ সময় এক বা দু’বার কোরআন-হাদিস থেকে ওয়াজ-নসিহত করবেন। সেই সঙ্গে বাসার সবাইকে বিভিন্ন ফরজ ইবাদত শেখাবেন। আর যদি বাসার কেউ আলেম না হয় তাহলে এ ক্ষেত্রে নিরাপদ হলো ওয়াজ-নসিহত না করে নির্ভরযোগ্য আলেমের লেখা বই দেখে তালিম করা। ধারাবাহিক তালিমের জন্য এ ৪টি কিতাব নির্বাচন করতে পারেন। যথা- ইমাম নববির রচিত রিয়াদুস সালিহিন, মাওলানা আশরাফ আলী থানভী (রহ.) রচিত ইসলাহি নেসাব, মাওলানা হেমায়েত উদ্দীন রচিত আহকামে যিন্দেগি অথবা মুফতি মানসূরুল হক রচিত ইসলামি যিন্দেগি এবং নবী জীবনী- আর রাহিকুল মাখতুম।

বাসার সবার সঙ্গে বসে পরামর্শ করে নিন, ওয়াজ-নসিহত, কিতাবি তালিম, কোরআনের মশক ইত্যাদি কোনটা কখন এবং কতক্ষণ হলে ভালো হয়।

মসজিদের আরেকটি আমল হলো- মানবসেবার উদ্যোগ ও পরামর্শ। আপনি বাসায় মাঝে মধ্যেই বাসার সবাইকে নিয়ে পরামর্শ করুন, প্রতিবেশিদের মধ্যে কে কোন সমস্যায় আছে। আপনাদের পক্ষে সমস্যাগ্রস্ত প্রতিবেশিদের জন্য কতটুকু করার সুযোগ আছে।

মসজিদের আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ আমল হলো- জিকির। বাসার সবাই পরামর্শ করে সময়ের পালা ভাগ করে দিন-রাতের বড়ো একটা সময় কোরআন তেলাওয়াত বা হাদিসে বর্ণিত বিভিন্ন জিকির-আজকারে মশগুল থাকুন। আল্লাহর নবী হজরত দাউদ (আ.) তো পরিবারের সদস্যদের নিয়ে ২৪ ঘণ্টার জিকিরের পালা ভাগ করে নিয়েছিলেন। যেন সময়ের কোনো একটা ক্ষুদ্রতম অংশ আমার বাড়ি আল্লাহর জিকিরশূন্য না থাকে- এটা ছিল নবী দাউদ (আ.)-এর মনোবাসনা। আমরা ততটুকু না পারি, অনেকটাইতো পারব- ইনশাআল্লাহ। আমরা তো এভাবে ইচ্ছা করতেই পারি, দিন-রাতের বেশিরভাগ সময়েই আমার বাসার কেউ না কেউ আল্লাহর জিকির করবে।

উল্লেখিত বিষয়গুলো হলো- আমল বিষয়ক। এবার পরিবেশ। মসজিদের পরিবেশ হলো- মসজিদের ভেতরে জেনে-বুঝে কেউ গোনাহর কাজ করে না, কেউ কাউকে কষ্ট দেয় না, গালাগালি করে না, কেউ নাপাক থাকে না, সবসময় সবাই অজুর সঙ্গে থাকে, দুনিয়ার অহেতুক গল্পগুজব করে না। দুর্যোগকালীন আমরা আমাদের বাসাগুলোতে মসজিদের পরিবেশ সৃষ্টি করতে পারি। বাসার সবাই সব সময় অজুর সঙ্গে থাকব। তাতে বারবার হাত ধোয়াও হবে আবার অজুর সওয়াব ও বরকত লাভ হবে। নাচ, গান, বাজনাসহ গায়রে মাহরাম নারীদেহের প্রদর্শনী বাসায় শতভাগ বন্ধ রাখি। টিভির যে সব চ্যানেল এগুলো দেখায় সেগুলো চালু না করি। বাসার প্রত্যেকেই প্রত্যেকের কষ্ট বুঝার চেষ্টা করি। সবাই সবার ইচ্ছাকে শ্রদ্ধা করি।

এভাবে যদি আমরা ঘরেই মসজিদের আমল আর পরিবেশের চর্চা শুরু করি তবে মসজিদ বন্ধ আমাদের হতাশ করবে না, বেশি আহত করবে না। আর আল্লাহ চাহে তো, প্রতিটি ঘর মসজিদে পরিণত হলে আল্লাহ সত্যিকার মসজিদগুলো খোলার পরিবেশ সৃষ্টি করে দেবেন।