করোনায় বদলে গেছে ইবাদত-বন্দেগির ধরন
করোনাভাইরাস মানুষের সামাজিক ও অর্থনৈতিক জীবন স্তব্ধ করে দিয়েছে। স্বাভাবিক নয় ধর্মীয় জীবনও। মধ্যপ্রাচ্যসহ বিভিন্ন দেশের মসজিদগুলোতে সংক্রমণ রোধে নামাজের জামাত সাময়িকভাবে বন্ধ রাখা হয়েছে। মানুষের নিরাপত্তাকে অগ্রাধিকার দিয়ে কোনো কোনো দেশে আজানের বাক্যে কিছুটা পরিবর্তন এনে ঘরে বসে নামাজ আদায়ের কথা বলা হয়েছে। ‘হাইয়া আলাস সালাহ’ (নামাজের জন্য আসুন)-কে পরিবর্তন করে ‘আস সালাতু ফি বুয়ুতিকুম’ (ঘরে নামাজ পড়ুন) বলা হয়েছে। আবার কোথাও আজান শেষ করে ঘরে নামাজের জন্য বলা হচ্ছে। বাংলাদেশের মসজিদগুলোতে নিয়মিত আজান হচ্ছে, তবে আজানের পর মসজিদের মাইক থেকে ঘোষণা দিয়ে বলা হচ্ছে, ঘরে নামাজ পড়ার জন্য। সওয়াবের কাজ হলেও মানুষের সঙ্গে করমর্দন ও কোলাকুলি করা থেকে বিরত থাকার পরামর্শ দেওয়া হয়েছে। করোনাভাইরাসের কোনো লক্ষণ দেখা দিলে মসজিদে না যেতে বলা হচ্ছে।
সীমিত মুসল্লিদের নিয়ে চলছে জামাত ও জুমা
সারা বিশ্বের মতো মুসলিম প্রধান বাংলাদেশেও করোনার সংক্রমণরোধে ঘর থেকে বের হওয়া মানা। মসজিদ-উপাসানলয়ে যেতে বারণ করে দেয়া হয়েছে সরকারের তরফ থেকে। শুধু নামাজ নয়, সব ধর্মের ব্যক্তিদের ঘরে উপাসনা করার জন্য নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। আলেম-উলামাসহ সর্বস্তরের মানুষ সেটাকে সমর্থন করেছেন, মানছেনও। সরকারি নির্দেশে পাঁচ ওয়াক্তের নামাজে ইমাম মুয়াজ্জিন-খাদেমের বাইরে আর কারও অংশ নেওয়ার অনুমতি নেই। আর জুমার জামাতে অংশ নিতে পারবে সব্বোর্চ্চ দশ জন। ফলে মসুল্লি শূন্য মসজিদগুলোতে চালু রয়েছে জামাত ও জুমা। জুমার খুতবা সংক্ষিপ্ত করা হয়েছে, নামাজে কেরাতে সংক্ষিপ্ত করা হয়েছে।
ধর্মপ্রাণ মানুষের জন্য এসব বিষয় মানতে কষ্ট হলেও, করার কিছুই নেই। বাধ্য হয়েই মানুষ ঘরে নামাজ আদায় করছেন। রাজধানীসহ দেশের কোনো কোনো জায়গায় নিজস্ব বাসাবাড়িতে সীমিতসংখ্যক মুসল্লির উপস্থিতিতে জুমার জামাত ও ওয়াক্তিয়া নামাজের জামাত আয়োজনের কথা শোনা যাচ্ছে। সেখানেও মানুষ স্বাস্থ্যবিধি মেনে দূরত্ব বজায় রেখে জামাত আদায় করেছেন।
এই প্রথম বাংলাদেশের মসজিদগুলোতে মুসল্লিহীন জুমা অনুষ্ঠিত হয়েছে। এ দৃশ্য দেখে অনেকে কান্নাকাটি করেছেন। আল্লাহর কাছে ক্ষমা চেয়েছেন। অবশ্য সৌদি আরবসহ বিশ্বের অনেক দেশেই বড় জামাত করে মসজিদে নামাজ নিষিদ্ধ করা হয়েছে। যদিও মসজিদে হারামে সীমিত পরিসরে জুমা ও জামাত চালু রয়েছে।
জামাতে সামাজিক দূরত্ব বজায় রেখে নামাজ
করোনাভাইরাসের কারণে অনেক দেশে মসজিদে জামাতে নামাজ পড়ার সময় সামাজিক দূরত্ব বজায় রেখে দাঁড়াচ্ছেন। মুফতিদের মতে, এভাব কাতারবন্দি মানুষের জন্য ফাঁকা হয়ে দাঁড়ানোয় কোনো ক্ষতি নেই। তবে ভয়াবহ কোনো পরিস্থিতি না থাকলে কিংবা কোনো সংক্রমণের ভয় না থাকলে মসজিদ কিংবা অন্য কোথাও নামাজে জামাত অনুষ্ঠিত হলে তাতে মুসল্লিরা একে অপরের সঙ্গে মিলে, কাতারের ফাঁকা বন্ধ করে দাঁড়াবে। কাতার সোজা করে দাঁড়ানো সুন্নত। দু’জন মুসল্লির মাঝে একজন দাঁড়াতে পারে এ পরিমাণ ফাঁকা রাখা সুন্নতের পরিপন্থী।
বদলে গেছে দাফন-কাফনের পদ্ধতি
করোনাভাইরাসের কারণে বদলে গেছে লাশ দাফনের নিয়ম। কাফনের কাপড়ের বদলে এখন প্লাস্টিকে মুড়ে কবর দেওয়া হচ্ছে বিভিন্ন দেশে। আর জানাজার নামাজে মানুষ অংশ নিচ্ছেন সামাজিক দূরত্ব বজায় রাখার নিয়ম মেনে। চেষ্টা করা হচ্ছে সেখানেও উপস্থিতি সীমিত করতে। বৃহত্তর স্বার্থে ক্ষেত্রবিশেষ লাশের গোসল দেওয়ার নিয়মেও পরিবর্তন আনা হয়েছে। আর মৃতের পরিবার কিংবা আত্মীয়-পরিজনের জন্য পাড়া-প্রতিবেশীরা খাবার-দাবার নিয়ে বাড়িতে গিয়ে মৃতের পরিবারকে সমবেদনা জানানোও আপাতত বন্ধ।
পালিত হলো অন্য ধরনের শবে বরাত
বৃহস্পতিবার (৯ এপ্রিল) দিবাগত রাতে সারাদেশে অন্য ধরনের পবিত্র শবেবরাত পালিত হয়েছে। যথাযোগ্য ধর্মীয় মর্যাদায় প্রতিবছর শবে বরাত পালিত হয়। কিন্ত করোনাভাইরাসের কারণে এবারই প্রথম শুধু ইমাম-খতিব-মুয়াজ্জিন ছাড়া কোনো মুসল্লি শবে বরাতের ইবাদত-বন্দেগি পালন করতে মসজিদে যাননি। নিজ নিজ বাসা-বাড়িতেই রাতভর শবে বরাতের ইবাদত-বন্দেগি করেছেন মুসল্লিরা। বন্ধ ছিল কবর জিয়ারতও। ফলে মসজিদ ও কবরস্থানের সামনে বিকলাঙ্গ ও ভিক্ষুকদের আনাগোনা চোখে পড়েনি।
মানুষ ধর্মমুখী হচ্ছেন, আল্লাহর রহমত কামনা করছেন
করোনার প্রকোপে মানবজাতি আজ অসহায়। এই অসহায়ত্বের মাঝে সৃষ্টিকর্তায় বিশ্বাসীরা ধৈর্য্যশীলতার পরিচয় দিচ্ছেন। তারা আল্লাহতায়ালার কাছে আশ্রয় খুঁজছেন। মানুষ ধর্মমুখী হচ্ছেন। তাদের মাঝে জাগছে খোদাভীতি এবং পরকালের মহা আজাবের ভয়-শঙ্কা। মানুষ আত্মবিশ্লেষণ করেছন। ধর্ম অনুসরণ ও সুশৃঙ্খল জীবনযাপনের অভ্যাস গড়ে তুলছেন। সেই সঙ্গে করোনাভাইরাস থেকে হেফাজতের জন্য আল্লাহতায়ালার দরবারে দোয়া-মোনাজাত করছেন। সীমিত জামাত শেষে কিংবা একাকি নামাজের পর ভেসে আসছে মোনাজাতে কান্নার আওয়াজ।
হে আল্লাহ! দয়াময় মাবুদ বাংলাদেশসহ বিশ্ববাসীকে করোনাভাইরাস থেকে হেফাজত করুন। এই মহামারি থেকে মুসলিম উম্মাহকে হেফাজত করুন। মক্কা-মদিনাসহ গোটা দুনিয়ার মসজিদগুলোর দরজা খুলে দিন। আমাদের পাপমোচন করুন, দয়া করুন। হে আল্লাহ! আমাদের গোনাহের জন্য আমাদের দিক থেকে আপনার রহমতের দৃষ্টি ফিরিয়ে নেবেন না। আপনি তো দয়ার সাগর, গোটা বিশ্বের মালিক। আপনার রহমত থেকে আমাদেরকে বঞ্চিত করবেন না।
রমজানে কী হবে?
বাংলাদেশে শাবান ২৯ দিনে হলে রমজান শুরু হবে ২৫ এপ্রিল, আর শাবান মাস ৩০ দিনের হলে রমজান শুরু হবে এপ্রিলের ২৬ তারিখ। মধ্যপ্রাচ্যে এ তারিখ একদিন কমবেশি হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে। মুসলমানদের কাছে রমজান অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ একটি মাস। এ সময়টি কেমন করে পালন করবেন- তা এখনও স্পষ্ট নয়। এ মাসে অনেকে একসঙ্গে ইফতার করেন এবং জামাতে খতমে তারাবি আদায় করেন। এসব আনুষ্ঠানিকতার কী হবে সেটা অনিশ্চিত।
প্রতিবছর রমজানে বিশ্বের লাখ লাখ মুসলমান ওমরাপালন ও ইতিকাফের জন্য সৌদি আরবের মক্কা-মদিনা যান। প্রায় দেঢ় মাস ধরে উমরা বন্ধ। সহসা উমরা শুরু হওয়ার সম্ভাবনা নেই। করোনা পরিস্থিতি কোন দিকে মোড় নেয়, সেটা অজানা। তাই উমরা, তারাবি ও ইফতার আয়োজন কেমন হবে- সেটা এখনই বলা যাচ্ছে না। এ বছরের হজ নিয়ে এখনও কোনো সিদ্ধান্ত আসেনি। এটা নিয়েও অনেকের মনে নানা সংশয় কাজ করছে।
আলেমদের দায়িত্ব ও অতীত থেকে শিক্ষা
ইসলামি শরিয়তে যে বিষয়গুলো মানুষের জন্য অপরিহার্য, তার একেবারে প্রথম অংশ হচ্ছে- আত্মরক্ষা করা, নিজেকে বাঁচানো ও হেফাজত করা। এ প্রসেঙ্গে আল্লাহতায়ালা বলেছেন, ‘তোমরা নিজেদের হত্যা করো না’, ‘তোমরা নিজেদের ধ্বংস করে দিও না।’ এ কাজটি বিভিন্নভাবে হতে পারে। যেমন- আত্মহত্যা করা, খাওয়া-দাওয়া বন্ধ করে দেওয়া, চিকিৎসা গ্রহণ না করা কিংবা নিশ্চিত বিপদ জেনেও সে পথে পা বাড়ানো। এসব কাজ করতে আল্লাহতায়ালা কোরআনে কারিমে স্পষ্টভাবে নিষেধ করেছেন।
বর্তমান সময়ে আলেম-উলামা ও মুফতিদের দায়িত্ব হলো- জনস্বাস্থ্য এবং মহামারি বিষয়ে পড়াশোনা ও গবেষণা করে তাদের লেখা ও বক্তব্যগুলো সাজানো। জনসাধারণের পক্ষ থেকে আবেগী বক্তব্য আসবে, কিন্তু সেসবের চেয়ে জনস্বাস্থ্য সম্পর্কিত বিষয়গুলো আমলে নিয়ে কথা বলা। কোনো আবেগ নয়, বাস্তবতাকে মেনে নেওয়া।
বিশ্বের বিভিন্ন দেশ করোনা রোধে নানা দিক-নির্দেশনা দিচ্ছেন। অনেক মসজিদ পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতা বিষয়ে সচেতন। তারা মসজিদগুলোতে যথেষ্ট পরিমাণে জীবাণুরোধক সাবান ও অন্যান্য পণ্য মজুত রাখছেন মুসল্লিদের জন্য। তার পরও মসজিদে জমায়েত আপাতত বন্ধ রাখা সবচেয়ে কঠিন চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়িয়েছে। এক্ষেত্রে ইতিহাস থেকে শিক্ষা নেওয়াই হবে বুদ্ধিমানের কাজ। কারণ, যেহেতু আমরা এখন আমরা একটা পরিস্থিতিতে রয়েছি, প্লেগের সময়ে আগের মুসলিম স্কলাররা কী করেছেন তা এখনকার অনেকে নজরে আনছেন। সেসব উল্লেখ করে ধর্মীয় নির্দেশনা দিচ্ছে। এটা মুসলমানদের কিছুটা হলেও স্বস্তি দিচ্ছে। মানুষ স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলছে, এটা ইতিবাচক দিক।
ইতোমধ্যে দেশে তাবলিগের সব কার্যক্রম স্থগিত করা হয়েছে। সারাদেশে ওয়াজ মাহফিলসহ অন্য ধর্মীয় অনুষ্ঠানে নিষেধাজ্ঞা এবং অন্য ধর্মের অনুসারীদেরও উপাসনালয়ে সমবেত না হয়ে নিজ নিজ বাসস্থানে উপাসনা করার জন্য নির্দেশ দিয়েছে ধর্ম মন্ত্রণালয়। সব মিলিয়ে এটা স্পষ্ট যে, করোনা পরিস্থিতির কারণে ধর্মীয় আচার-আচরণ পালনে কিছু নতুনত্ব বিষয় সংযোজিত হয়েছে। ধর্মের বিধান অক্ষুন্ন রেখে এসব কিছু খাপ খাইয়ে নিতে হচ্ছে মুসলমানদের।