করোনায় বদলে গেছে ইবাদত-বন্দেগির ধরন



মুফতি এনায়েতুল্লাহ, বিভাগীয় প্রধান, ইসলাম
সীমিত মুসল্লিদের উপস্থিতিতে বায়তুল মোকাররমে জুমার নামাজ, ছবি: সংগৃহীত

সীমিত মুসল্লিদের উপস্থিতিতে বায়তুল মোকাররমে জুমার নামাজ, ছবি: সংগৃহীত

  • Font increase
  • Font Decrease

করোনাভাইরাস মানুষের সামাজিক ও অর্থনৈতিক জীবন স্তব্ধ করে দিয়েছে। স্বাভাবিক নয় ধর্মীয় জীবনও। মধ্যপ্রাচ্যসহ বিভিন্ন দেশের মসজিদগুলোতে সংক্রমণ রোধে নামাজের জামাত সাময়িকভাবে বন্ধ রাখা হয়েছে। মানুষের নিরাপত্তাকে অগ্রাধিকার দিয়ে কোনো কোনো দেশে আজানের বাক্যে কিছুটা পরিবর্তন এনে ঘরে বসে নামাজ আদায়ের কথা বলা হয়েছে। ‘হাইয়া আলাস সালাহ’ (নামাজের জন্য আসুন)-কে পরিবর্তন করে ‘আস সালাতু ফি বুয়ুতিকুম’ (ঘরে নামাজ পড়ুন) বলা হয়েছে। আবার কোথাও আজান শেষ করে ঘরে নামাজের জন্য বলা হচ্ছে। বাংলাদেশের মসজিদগুলোতে নিয়মিত আজান হচ্ছে, তবে আজানের পর মসজিদের মাইক থেকে ঘোষণা দিয়ে বলা হচ্ছে, ঘরে নামাজ পড়ার জন্য। সওয়াবের কাজ হলেও মানুষের সঙ্গে করমর্দন ও কোলাকুলি করা থেকে বিরত থাকার পরামর্শ দেওয়া হয়েছে। করোনাভাইরাসের কোনো লক্ষণ দেখা দিলে মসজিদে না যেতে বলা হচ্ছে।

সীমিত মুসল্লিদের নিয়ে চলছে জামাত ও জুমা
সারা বিশ্বের মতো মুসলিম প্রধান বাংলাদেশেও করোনার সংক্রমণরোধে ঘর থেকে বের হওয়া মানা। মসজিদ-উপাসানলয়ে যেতে বারণ করে দেয়া হয়েছে সরকারের তরফ থেকে। শুধু নামাজ নয়, সব ধর্মের ব্যক্তিদের ঘরে উপাসনা করার জন্য নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। আলেম-উলামাসহ সর্বস্তরের মানুষ সেটাকে সমর্থন করেছেন, মানছেনও। সরকারি নির্দেশে পাঁচ ওয়াক্তের নামাজে ইমাম মুয়াজ্জিন-খাদেমের বাইরে আর কারও অংশ নেওয়ার অনুমতি নেই। আর জুমার জামাতে অংশ নিতে পারবে সব্বোর্চ্চ দশ জন। ফলে মসুল্লি শূন্য মসজিদগুলোতে চালু রয়েছে জামাত ও জুমা। জুমার খুতবা সংক্ষিপ্ত করা হয়েছে, নামাজে কেরাতে সংক্ষিপ্ত করা হয়েছে।

বাড়তি সতর্কতা হিসেবে বিদেশের মসজিদে নিয়মিত জীবাণুনাশক স্প্রে করা হয়, ছবি: সংগৃহীত

ধর্মপ্রাণ মানুষের জন্য এসব বিষয় মানতে কষ্ট হলেও, করার কিছুই নেই। বাধ্য হয়েই মানুষ ঘরে নামাজ আদায় করছেন। রাজধানীসহ দেশের কোনো কোনো জায়গায় নিজস্ব বাসাবাড়িতে সীমিতসংখ্যক মুসল্লির উপস্থিতিতে জুমার জামাত ও ওয়াক্তিয়া নামাজের জামাত আয়োজনের কথা শোনা যাচ্ছে। সেখানেও মানুষ স্বাস্থ্যবিধি মেনে দূরত্ব বজায় রেখে জামাত আদায় করেছেন।

এই প্রথম বাংলাদেশের মসজিদগুলোতে মুসল্লিহীন জুমা অনুষ্ঠিত হয়েছে। এ দৃশ্য দেখে অনেকে কান্নাকাটি করেছেন। আল্লাহর কাছে ক্ষমা চেয়েছেন। অবশ্য সৌদি আরবসহ বিশ্বের অনেক দেশেই বড় জামাত করে মসজিদে নামাজ নিষিদ্ধ করা হয়েছে। যদিও মসজিদে হারামে সীমিত পরিসরে জুমা ও জামাত চালু রয়েছে।

জামাতে সামাজিক দূরত্ব বজায় রেখে নামাজ
করোনাভাইরাসের কারণে অনেক দেশে মসজিদে জামাতে নামাজ পড়ার সময় সামাজিক দূরত্ব বজায় রেখে দাঁড়াচ্ছেন। মুফতিদের মতে, এভাব কাতারবন্দি মানুষের জন্য ফাঁকা হয়ে দাঁড়ানোয় কোনো ক্ষতি নেই। তবে ভয়াবহ কোনো পরিস্থিতি না থাকলে কিংবা কোনো সংক্রমণের ভয় না থাকলে মসজিদ কিংবা অন্য কোথাও নামাজে জামাত অনুষ্ঠিত হলে তাতে মুসল্লিরা একে অপরের সঙ্গে মিলে, কাতারের ফাঁকা বন্ধ করে দাঁড়াবে। কাতার সোজা করে দাঁড়ানো সুন্নত। দু’জন মুসল্লির মাঝে একজন দাঁড়াতে পারে এ পরিমাণ ফাঁকা রাখা সুন্নতের পরিপন্থী।

বদলে গেছে দাফন-কাফনের পদ্ধতি
করোনাভাইরাসের কারণে বদলে গেছে লাশ দাফনের নিয়ম। কাফনের কাপড়ের বদলে এখন প্লাস্টিকে মুড়ে কবর দেওয়া হচ্ছে বিভিন্ন দেশে। আর জানাজার নামাজে মানুষ অংশ নিচ্ছেন সামাজিক দূরত্ব বজায় রাখার নিয়ম মেনে। চেষ্টা করা হচ্ছে সেখানেও উপস্থিতি সীমিত করতে। বৃহত্তর স্বার্থে ক্ষেত্রবিশেষ লাশের গোসল দেওয়ার নিয়মেও পরিবর্তন আনা হয়েছে। আর মৃতের পরিবার কিংবা আত্মীয়-পরিজনের জন্য পাড়া-প্রতিবেশীরা খাবার-দাবার নিয়ে বাড়িতে গিয়ে মৃতের পরিবারকে সমবেদনা জানানোও আপাতত বন্ধ।

মসজিদে হারামে সীমিত মুসল্লিদের নিয়ে জামাত, ছবি: সংগৃহীত

পালিত হলো অন্য ধরনের শবে বরাত
বৃহস্পতিবার (৯ এপ্রিল) দিবাগত রাতে সারাদেশে অন্য ধরনের পবিত্র শবেবরাত পালিত হয়েছে। যথাযোগ্য ধর্মীয় মর্যাদায় প্রতিবছর শবে বরাত পালিত হয়। কিন্ত করোনাভাইরাসের কারণে এবারই প্রথম শুধু ইমাম-খতিব-মুয়াজ্জিন ছাড়া কোনো মুসল্লি শবে বরাতের ইবাদত-বন্দেগি পালন করতে মসজিদে যাননি। নিজ নিজ বাসা-বাড়িতেই রাতভর শবে বরাতের ইবাদত-বন্দেগি করেছেন মুসল্লিরা। বন্ধ ছিল কবর জিয়ারতও। ফলে মসজিদ ও কবরস্থানের সামনে বিকলাঙ্গ ও ভিক্ষুকদের আনাগোনা চোখে পড়েনি।

মানুষ ধর্মমুখী হচ্ছেন, আল্লাহর রহমত কামনা করছেন
করোনার প্রকোপে মানবজাতি আজ অসহায়। এই অসহায়ত্বের মাঝে সৃষ্টিকর্তায় বিশ্বাসীরা ধৈর্য্যশীলতার পরিচয় দিচ্ছেন। তারা আল্লাহতায়ালার কাছে আশ্রয় খুঁজছেন। মানুষ ধর্মমুখী হচ্ছেন। তাদের মাঝে জাগছে খোদাভীতি এবং পরকালের মহা আজাবের ভয়-শঙ্কা। মানুষ আত্মবিশ্লেষণ করেছন। ধর্ম অনুসরণ ও সুশৃঙ্খল জীবনযাপনের অভ্যাস গড়ে তুলছেন। সেই সঙ্গে করোনাভাইরাস থেকে হেফাজতের জন্য আল্লাহতায়ালার দরবারে দোয়া-মোনাজাত করছেন। সীমিত জামাত শেষে কিংবা একাকি নামাজের পর ভেসে আসছে মোনাজাতে কান্নার আওয়াজ।

হে আল্লাহ! দয়াময় মাবুদ বাংলাদেশসহ বিশ্ববাসীকে করোনাভাইরাস থেকে হেফাজত করুন। এই মহামারি থেকে মুসলিম উম্মাহকে হেফাজত করুন। মক্কা-মদিনাসহ গোটা দুনিয়ার মসজিদগুলোর দরজা খুলে দিন। আমাদের পাপমোচন করুন, দয়া করুন। হে আল্লাহ! আমাদের গোনাহের জন্য আমাদের দিক থেকে আপনার রহমতের দৃষ্টি ফিরিয়ে নেবেন না। আপনি তো দয়ার সাগর, গোটা বিশ্বের মালিক। আপনার রহমত থেকে আমাদেরকে বঞ্চিত করবেন না।

রমজানে কী হবে?
বাংলাদেশে শাবান ২৯ দিনে হলে রমজান শুরু হবে ২৫ এপ্রিল, আর শাবান মাস ৩০ দিনের হলে রমজান শুরু হবে এপ্রিলের ২৬ তারিখ। মধ্যপ্রাচ্যে এ তারিখ একদিন কমবেশি হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে। মুসলমানদের কাছে রমজান অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ একটি মাস। এ সময়টি কেমন করে পালন করবেন- তা এখনও স্পষ্ট নয়। এ মাসে অনেকে একসঙ্গে ইফতার করেন এবং জামাতে খতমে তারাবি আদায় করেন। এসব আনুষ্ঠানিকতার কী হবে সেটা অনিশ্চিত।

সীমিত পরিসরে তাওয়াফ চললেও একেবারে ফাঁকা সাফা-মারওয়া, ছবি: সংগৃহীত

প্রতিবছর রমজানে বিশ্বের লাখ লাখ মুসলমান ওমরাপালন ও ইতিকাফের জন্য সৌদি আরবের মক্কা-মদিনা যান। প্রায় দেঢ় মাস ধরে উমরা বন্ধ। সহসা উমরা শুরু হওয়ার সম্ভাবনা নেই। করোনা পরিস্থিতি কোন দিকে মোড় নেয়, সেটা অজানা। তাই উমরা, তারাবি ও ইফতার আয়োজন কেমন হবে- সেটা এখনই বলা যাচ্ছে না। এ বছরের হজ নিয়ে এখনও কোনো সিদ্ধান্ত আসেনি। এটা নিয়েও অনেকের মনে নানা সংশয় কাজ করছে।

আলেমদের দায়িত্ব ও অতীত থেকে শিক্ষা
ইসলামি শরিয়তে যে বিষয়গুলো মানুষের জন্য অপরিহার্য, তার একেবারে প্রথম অংশ হচ্ছে- আত্মরক্ষা করা, নিজেকে বাঁচানো ও হেফাজত করা। এ প্রসেঙ্গে আল্লাহতায়ালা বলেছেন, ‘তোমরা নিজেদের হত্যা করো না’, ‘তোমরা নিজেদের ধ্বংস করে দিও না।’ এ কাজটি বিভিন্নভাবে হতে পারে। যেমন- আত্মহত্যা করা, খাওয়া-দাওয়া বন্ধ করে দেওয়া, চিকিৎসা গ্রহণ না করা কিংবা নিশ্চিত বিপদ জেনেও সে পথে পা বাড়ানো। এসব কাজ করতে আল্লাহতায়ালা কোরআনে কারিমে স্পষ্টভাবে নিষেধ করেছেন।

বর্তমান সময়ে আলেম-উলামা ও মুফতিদের দায়িত্ব হলো- জনস্বাস্থ্য এবং মহামারি বিষয়ে পড়াশোনা ও গবেষণা করে তাদের লেখা ও বক্তব্যগুলো সাজানো। জনসাধারণের পক্ষ থেকে আবেগী বক্তব্য আসবে, কিন্তু সেসবের চেয়ে জনস্বাস্থ্য সম্পর্কিত বিষয়গুলো আমলে নিয়ে কথা বলা। কোনো আবেগ নয়, বাস্তবতাকে মেনে নেওয়া।

বিশ্বের বিভিন্ন দেশ করোনা রোধে নানা দিক-নির্দেশনা দিচ্ছেন। অনেক মসজিদ পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতা বিষয়ে সচেতন। তারা মসজিদগুলোতে যথেষ্ট পরিমাণে জীবাণুরোধক সাবান ও অন্যান্য পণ্য মজুত রাখছেন মুসল্লিদের জন্য। তার পরও মসজিদে জমায়েত আপাতত বন্ধ রাখা সবচেয়ে কঠিন চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়িয়েছে। এক্ষেত্রে ইতিহাস থেকে শিক্ষা নেওয়াই হবে বুদ্ধিমানের কাজ। কারণ, যেহেতু আমরা এখন আমরা একটা পরিস্থিতিতে রয়েছি, প্লেগের সময়ে আগের মুসলিম স্কলাররা কী করেছেন তা এখনকার অনেকে নজরে আনছেন। সেসব উল্লেখ করে ধর্মীয় নির্দেশনা দিচ্ছে। এটা মুসলমানদের কিছুটা হলেও স্বস্তি দিচ্ছে। মানুষ স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলছে, এটা ইতিবাচক দিক।

ইতোমধ্যে দেশে তাবলিগের সব কার্যক্রম স্থগিত করা হয়েছে। সারাদেশে ওয়াজ মাহফিলসহ অন্য ধর্মীয় অনুষ্ঠানে নিষেধাজ্ঞা এবং অন্য ধর্মের অনুসারীদেরও উপাসনালয়ে সমবেত না হয়ে নিজ নিজ বাসস্থানে উপাসনা করার জন্য নির্দেশ দিয়েছে ধর্ম মন্ত্রণালয়। সব মিলিয়ে এটা স্পষ্ট যে, করোনা পরিস্থিতির কারণে ধর্মীয় আচার-আচরণ পালনে কিছু নতুনত্ব বিষয় সংযোজিত হয়েছে। ধর্মের বিধান অক্ষুন্ন রেখে এসব কিছু খাপ খাইয়ে নিতে হচ্ছে মুসলমানদের।

   

মসজিদের নগরী এখন মসজিদের দেশে পরিণত হয়েছে



ইসলাম ডেস্ক, বার্তা২৪.কম
বাংলাদেশ দ্বীনি সেবা ফাউন্ডেশনের উদ্যোগ আয়োজিত আলোচনা সভায় আমন্ত্রিত অতিথি, ছবি : সংগৃহীত

বাংলাদেশ দ্বীনি সেবা ফাউন্ডেশনের উদ্যোগ আয়োজিত আলোচনা সভায় আমন্ত্রিত অতিথি, ছবি : সংগৃহীত

  • Font increase
  • Font Decrease

সবার সম্মিলিত প্রচেষ্টায় সমাজের অনাচার দূর করা সম্ভব। বিশেষ করে দুর্নীতি, মাদকাসক্তিসহ সব সমস্যা দূরীকরণে সামাজিক সংঠনগুলো বিশেষ ভূমিকা পালন করতে পারে। তাই সমাজের ইতিবাচক পরিবর্তনে সামাজিক সংগঠনগুলোকে নিষ্ঠার সঙ্গে আরও ব্যাপকভাবে কাজ করা দরকার।

বৃহস্পতিবার (২৮ মার্চ) রাজধানীর কাকরাইলস্থ ইনস্টিটিউট অব ডিপ্লোমা ইঞ্জিনিয়ার্স মিলনায়তনে বাংলাদেশ দ্বীনি সেবা ফাউন্ডেশনের উদ্যোগ আয়োজিত আলোচনা সভা ও সংবর্ধনা অনুষ্ঠানে বক্তারা এসব কথা বলেন।

বক্তারা আরও বলেন, উগ্রবাদীদের টার্গেটে যখন বাংলাদেশ, তখন এগিয়ে এসেছেন আলেম-উলামা এবং সংগঠনসমূহ। একসময় ঢাকা শহরকে মসজিদের নগরী বলা হতো। এখন সেটা ছাপিয়ে পুরো বাংলাদেশ মসজিদের দেশ হিসেবে পরিচিতি লাভ করেছে। আর সেটা সম্ভব হয়েছে সবার সম্মিলিত প্রচেষ্টা এবং সামাজিক সংগঠনগুলোর কারণে।

ফাউন্ডেশনের প্রতিষ্ঠাকালীন প্রধান উপদেষ্টা ধর্মবিষক মন্ত্রণালয়ের মন্ত্রী মো. ফরিদুল হক খান এমপিকে পূর্ণ মন্ত্রী, প্রধান পৃষ্ঠপোষক প্রধানমন্ত্রীর প্রাক্তন মূখ্যসচিব মো. আবুল কালাম আজাদ সংসদ সদস্য নির্বাচিত হওয়ায় এবং আসাদুজ্জামান খান কামাল এমপিকে পরপর তিনবার স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের মন্ত্রীর দায়িত্ব দেওয়ায় সংগঠনের বাংলাদেশ দ্বীনি সেবা ফাউন্ডেশনের পক্ষ থেকে সংবর্ধনা দেওয়া হয়।

ফাউন্ডেশনের সভাপতি মাওলানা ওমর ফারুকের সঞ্চালনায় অনুষ্ঠানে বক্তব্য রাখেন মুফতি আবুল বাশার নুমানি, মাওলানা মুজিবুর রহমান, ধর্ম বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের সচিব আব্দুল হামিদ জমাদ্দার, ডি আইজি নাফিউর রহমান, মুফতি মুনিরুল ইসলাম এবং মুফতি রেজাউল হক মোহাম্মদ আব্দুল্লাহ প্রমুখ।

উল্লেখ্য, বাংলাদেশ দ্বীনি সেবা ফাউন্ডেশন একটি অরাজনৈতিক সেবামূলক প্রতিষ্ঠান। এর প্রতিষ্ঠাকাল থেকে বিভিন্ন সামাজিক কাজের মধ্য দিয়ে এটি আলোচনায় আসে।

২০২২ সালে বঙ্গবন্ধু আন্তর্জাতিক সম্মেলন কেন্দ্রে ‘বিশ্বজয়ী হাফেজদের সংবর্ধনা ও জাতীয় হিফজুল কুরআন প্রতিযোগীতা’ আয়োজনের মধ্য দিয়ে ফাউন্ডেশনটি ব্যাপক কার্যক্রম শুরু করে।

২০২৩ সালের ১৩ আগস্ট বঙ্গবন্ধু আন্তর্জাতিক সম্মেলন কেন্দ্রে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার উপস্থিতিতে বাংলাদেশের ইতিহাসে সর্বপ্রথম দেশসেরা হাফেজদের সম্মাননা প্রদান করা হয়।

কাজের ধারাবাহিকতায় ফাউন্ডেশনের উদ্যোগে সিলেটের বন্যা পরিস্থিতিতে ত্রাণ সহায়তা প্রদান, ঢাকার মিরপুরে পুলিশ কনভেনশন হলে ডেঙ্গু পরিস্থিতিতে সচেতনতামূলক সেমিনার, ঢাকা উত্তর সিটি কর্পোরেশনের আয়োজনে ফাউন্ডেশনের সহযোগিতায় ‘এডিস মশা ও ডেঙ্গু বিস্তাররোধে করণীয়’ সম্পর্কে ইমাম-খতিবদের নিয়ে সেমিনারের আয়োজন ছাড়াও সারাদেশে ধর্মীয় ও সচেতনতামূলক নানা কার্যক্রম অব্যাহত রয়েছে।

;

রমজানে উমরাকারীর সংখ্যা ২ কোটি ছাড়িয়ে যাবে



ইসলাম ডেস্ক, বার্তা২৪.কম
কাবা তওয়াফ করছেন উমরাকারীরা, ২৮ মার্চ সকালের দৃশ্য, ছবি : হারামাইন পেইজ

কাবা তওয়াফ করছেন উমরাকারীরা, ২৮ মার্চ সকালের দৃশ্য, ছবি : হারামাইন পেইজ

  • Font increase
  • Font Decrease

সৌদি আরবের পবিত্র মক্কা ও মদিনায় এখন শুধু মানুষ আর মানুষ। দৃষ্টি যতদূর যায় শুধুই মানুষের ভিড়। তাদের কেউ ইহরাম পরিহিত, কেউ স্বাভাবিক পোষাকে। তবে সবার লক্ষ্য এক জায়গা- মসজিদে হারাম।

সোমবার (২৫ মার্চ) এক প্রতিবেদনে সংবাদমাধ্যম আল আরাবিয়া জানিয়েছে, সৌদি আরবের হজ ও উমরা মন্ত্রণালয়ের তথ্য অনুযায়ী, পবিত্র এই মাস শুরু হওয়ার পর থেকে এখন পর্যন্ত মোট ৮২ লাখ ৩৫ হাজার ৬৮০ জন মুসল্লি উমরা পালন করেছেন।

সৌদি কর্তৃপক্ষ বলছে, এর আগে এত বিপুল সংখ্যক মুসল্লি এভাবে ভিড় করেননি। তাদের আশা আগামী ১৫ দিনে এই সংখ্যা ২ কোটি পার হয়ে যাবে।

প্রতিবেদন অনুসারে রমজান মাস শুরুর পর থেকে ৭২ লাখ ৫৯ হাজার ৫০৪ জন উমরা সম্পন্ন করেছে। বর্তমানে দেশটিতে ৯ লাখ ৭৬ হাজার ১৭৬ জন অবস্থান করছেন।

মন্ত্রণালয়ের তথ্য মতে, স্থলপথে সবচেয়ে বেশিসংখ্যক উমরাযাত্রী সৌদি আরব এসেছেন। এরপর যথাক্রমে আকাশপথ ও সমুদ্রপথে এসেছেন। স্থলপথে ৯ লাখ ৮০ হাজার ৫৫৬ জন আগমন করেছেন। আর আকাশপথে সাত লাখ ৯৮৩ জন এবং সমুদ্রপথে ৫৪ হাজার ১৪১ জন এসেছেন। রমজান মাসে পবিত্র মসজিদে হারামে ভিড় নিয়ন্ত্রণে এবং স্বাচ্ছন্দ্যে উমরা পালন নিশ্চিত করতে নানা বিধি-নিষেধ আরোপ করেছে সৌদি আরব।

বিশেষ করে নুসুক অ্যাপের মাধ্যমে চলতি রমজানে উমরা পালনের কোনো ব্যক্তি দ্বিতীয়বারের মতো অনুমতি পাননি। অ্যাপে আবেদন করলে একটি বার্তা ভেসে ওঠে। তাতে লেখা থাকে, ‘অনুমতি প্রদান ব্যর্থ হয়েছে। সবাইকে সুযোগ দিতে রমজানে দ্বিতীয়বার কেউ উমরা করতে পারবেন না।’

অন্য আরেক নির্দেশনায় পবিত্র কাবাঘরের প্রাঙ্গণ তথা মাতাফে নামাজ না পড়ে মসজিদে হারামে নামাজ পড়তে বলা হয়েছে। যেন ওই সময় উমরাযাত্রীরা তওয়াফ করতে পারেন। এ ছাড়া রমজান মাসে একবারের বেশি উমরা পালনে বারণ করাসহ মক্কার বাসিন্দাদের মসজিদে হারামে ভিড় না করে আশপাশের মসজিদে নামাজ পড়তে উৎসাহিত করা হয়।

উল্লেখ্য, ২০২৩ সালে এক কোটি ৩০ লাখ ৫৫ হাজারের বেশি মুসলিম উমরা পালন করেছে, যা ছিল সৌদি আরবের ইতিহাসে সর্বোচ্চ সংখ্যা।

;

শিক্ষাদানের শর্তে যে যুদ্ধের বন্দিরা মুক্তি পায়



মাওলানা সাইফুল ইসলাম, অতিথি লেখক, ইসলাম
বদর যুদ্ধে মুসলমানদের সহযোগিতায় আসমান থেকে ফেরেশতা এই পাহাড়ে অবতীর্ণ হয়, বর্তমান নাম জাবালে মালাইকা, ছবি : সংগৃহীত

বদর যুদ্ধে মুসলমানদের সহযোগিতায় আসমান থেকে ফেরেশতা এই পাহাড়ে অবতীর্ণ হয়, বর্তমান নাম জাবালে মালাইকা, ছবি : সংগৃহীত

  • Font increase
  • Font Decrease

বদর যুদ্ধে বিপুলবৈভব কুরাইশদের বিরুদ্ধে মুসলিম বাহিনীর অভাবনীয় বিজয় অর্জিত হয়। এই যুদ্ধে ৭০ জন কুরাইশ যোদ্ধা নিহত হয় এবং সমপরিমাণ ব্যক্তি বন্দি হয়। যুদ্ধ শেষে হজরত রাসুলুল্লাহ (সা.) মদিনায় পৌঁছার পর সাহাবায়ে কেরামের সঙ্গে যুদ্ধবন্দিদের ব্যাপারে পরামর্শ করলেন। হজরত আবুবকর সিদ্দিক (রা.) বললেন, হে আল্লাহর রাসুল, ওরা তো চাচাতো ভাই এবং আমাদের আত্মীয়-স্বজন। আমার মত হলো, ওদের কাছ থেকে মুক্তিপণ নিয়ে ছেড়ে দেওয়া হোক। এতে অর্জিত সম্পদ অবিশ্বাসীদের বিরুদ্ধে আমাদের শক্তিতে পরিণত হবে। আর এমনও হতে পারে, আল্লাহতায়ালা তাদের হেদায়েত দেবেন এবং তারা একসময় আমাদের পাশে এসে দাঁড়াবে।

হজরত ওমর ইবনে খাত্তাব (রা.) ভিন্ন মত দিলেন। তিনি বললেন, কুরাইশ যোদ্ধাদের হত্যা করা হোক, যেন ইসলামের বিরুদ্ধে অস্ত্রধারণের সাহস কেউ না পায়। এ ছাড়া এ যুদ্ধবন্দিরা নেতৃস্থানীয় ব্যক্তি। তাদের অনুপস্থিতি অবিশ্বাসী শিবিরকে দুর্বল করে দেবে।

হজরত রাসুলুল্লাহ (সা.) হজরত আবুবকরের পরামর্শ গ্রহণ করলেন। কিন্তু আল্লাহতায়ালা হজরত ওমরের সিদ্ধান্তটিই অধিক সঠিক ছিল বলে জানিয়ে দেন। হজরত রাসুলুল্লাহ (সা.) নিকটবর্তী একটি গাছের প্রতি ইশারা করে বললেন, আমার কাছে ওদের আজাব এই গাছের চেয়ে নিকটতর করে উপস্থাপন করা হয়েছে। -তারিখে ওমর ইবনে খাত্তাব, ইবনে জওজি, পৃষ্ঠা ৩৬

তবে আল্লাহতায়ালা ফিদইয়া গ্রহণের সিদ্ধান্তের বৈধতা দেন এবং প্রদেয় মুক্তিপণকে মুসলিমদের জন্য হালাল ঘোষণা করেন। তবে আল্লাহতায়ালা এ জন্য করেছেন যে তারা শুধু যুদ্ধবন্দি ছিল না; বরং তারা ইসলাম, মুসলমান ও মানবতার বিরোধী অনেক অপরাধের সঙ্গে জড়িত ছিল।

যুদ্ধবন্দিদের কাছ থেকে নেওয়া মুক্তিপণের পরিমাণ ছিল এক হাজার থেকে চার হাজার দিরহাম পর্যন্ত। যাদের মুক্তিপণ দেওয়ার সামর্থ্য ছিল না, তাদের পেশা দক্ষতার বিনিময়ে মুক্তি লাভের সুযোগ দেওয়া হয়। যেমন- মক্কাবাসী লেখাপড়া জানত। পক্ষান্তরে মদিনায় লেখাপড়া জানা লোকের সংখ্যা ছিল হাতে গোনা। ফলে যাদের মুক্তিপণ প্রদানের সামর্থ্য নেই এবং লেখাপড়া জানে, তাদের সুযোগ দেওয়া হলো যে তারা মদিনায় ১০টি করে শিশুকে লেখাপড়া শেখাবে। শিশুরা ভালোভাবে লেখাপড়া শেখার পর শিক্ষক বন্দিদের মুক্তি দেওয়া হবে।

হজরত রাসুলুল্লাহ (সা.) কয়েকজন বন্দিকে বিশেষ দয়া করায় তাদের কাছ থেকে ফিদইয়া গ্রহণ করা হয়নি, এমনিতেই মুক্তি দেওয়া হয়। তারা ছিল মোত্তালিব ইবনে হানতাব, সাঈফি ইবনে আবু রেফায়া ও আবু আযযা জুমাহি। হজরত রাসুলুল্লাহ (সা.) তার জামাতা আবুল আসকে এই শর্তের ওপর ছেড়ে দিয়েছিলেন যে তিনি নবীনন্দিনী হজরত জয়নব (রা.)-র পথে বাধা হয়ে দাঁড়াবেন না।

এর কারণ ছিল যে হজরত জয়নব (রা.) আবুল ইবনে আসের ফিদইয়া হিসেবে কিছু সম্পদ পাঠিয়েছিলেন। এর মধ্যে একটি হারও ছিল। হারটি হজরত খাদিজা (রা.) হজরত জয়নব (রা.)-কে আবুল আসের ঘরে পাঠানোর সময় উপহারস্বরূপ দিয়েছিলেন। মহানবী (সা.) তা দেখে অশ্রুসজল হয়ে ওঠেন এবং আবেগে তার কণ্ঠস্বর রুদ্ধ হয়ে আসে। তিনি আবুল আসকে ছেড়ে দেওয়ার ব্যাপারে সাহাবাদের মতামত চান। সাহাবারা প্রিয় নবী (সা.)-এর এই প্রস্তাব সশ্রদ্ধভাবে অনুমোদন করেন। অতঃপর মহানবী (সা.) তার জামাতা আবুল আসকে এই শর্তে ছেড়ে দেন যে তিনি হজরত জয়নব (রা.)-কে মদিনায় আসার সুযোগ করে দেবেন। স্বামীর অনুমতি পেয়ে জয়নব (রা.) মদিনায় হিজরত করেন।

হজরত রাসুলুল্লাহ (সা.) হজরত জায়েদ ইবনে হারেসা এবং অন্য একজন আনসারি সাহাবিকে মক্কায় প্রেরণ করেন। তাদের বলা হয়, তোমরা মক্কার উপকণ্ঠ অথবা জাজ নামক জায়গায় থাকবে। হজরত জয়নব (রা.) তোমাদের কাছ দিয়ে যখন যেতে থাকবেন, তখন তাকে সঙ্গে নিয়ে আসবে। এই দুজন সাহাবি মক্কায় গিয়ে হজরত জয়নব (রা.)-কে মদিনায় নিয়ে আসেন। হজরত জয়নব (রা.)-এর হিজরতের ঘটনা অনেক দীর্ঘ এবং মর্মস্পর্শী।

;

ইতিহাস বদলে দেওয়া বদর যুদ্ধের প্রেক্ষাপট



মাওলানা আবদুল জাব্বার, অতিথি লেখক, ইসলাম
বদর যুদ্ধে যেখানে রাসুলুল্লাহ (সা.)-এর তাঁবু ছিল সেখানে পরে এই মসজিদটি নির্মিত হয়েছে, নাম মসজিদে আরিশ, ছবি : সংগৃহীত

বদর যুদ্ধে যেখানে রাসুলুল্লাহ (সা.)-এর তাঁবু ছিল সেখানে পরে এই মসজিদটি নির্মিত হয়েছে, নাম মসজিদে আরিশ, ছবি : সংগৃহীত

  • Font increase
  • Font Decrease

মুসলিম ইতিহাসের প্রথম সশস্ত্র যুদ্ধ বদর। দ্বিতীয় হিজরির ১৭ রমজান মদিনার উপকণ্ঠে বদর নামক স্থানে মুখোমুখি হয় মুসলিম ও কুরাইশ বাহিনী। ঐতিহাসিক এ যুদ্ধ ছিল অসত্যের বিরুদ্ধে সত্যের লড়াই। ইসলাম ও মুসলিমদের অস্তিত্বের সংগ্রাম। বদর যুদ্ধে আল্লাহতায়ালা অসম প্রতিপক্ষের বিরুদ্ধে মুসলিম বাহিনীকে বিজয় দান করেন। অস্তিত্বের সংকট থেকে মুসলিম উম্মাহকে মুক্তি দিয়ে অমিত সম্ভাবনার দুয়ারে পৌঁছে দেন।

৬২৪ খ্রিস্টাব্দ তথা দ্বিতীয় হিজরির ১৭ রমজান সংঘটিত হয়েছিল ইসলামে চিরস্মরণীয় ও গৌরবময় অধ্যায় বদর যুদ্ধ। এটি ছিল সত্য ও মিথ্যার, হক ও বাতিলের, মুসলিম ও কাফেরদের মধ্যকার ঐতিহাসিক যুদ্ধ, ইসলামের প্রথম যুদ্ধ। মদিনার অদূরে অবস্থিত একটি কূপের নাম ছিল বদর। সেই সূত্রে এই কূপের নিকটবর্তী আঙিনাকে বলা হতো বদর প্রান্তর। এই বদর প্রান্তরেই মহান আল্লাহ তার প্রিয় হাবিব নিরস্ত্র মুহাম্মাদুর রাসুলুল্লাহ (সা.) ও তার সঙ্গীদের বিজয়ী করেছিলেন হাজার সশস্ত্র যোদ্ধার মোকাবেলায়।

ঘটনার সূত্রপাত
মদিনায় বইতে থাকা ইসলামের বসন্তের হাওয়া মক্কার কাফেরদের বেশ ভাবিয়ে তুলেছিল। না জানি কখন এই হাওয়া দমকা হাওয়ায় রূপ নিয়ে তাদের উড়িয়ে নিয়ে যায়, কিংবা তাদের ব্যবসার পথে বাধা হয়ে দাঁড়ায়। তাই মুসলমানদের চিরতরে নিশ্চিহ্ন করার জন্য অর্থ জোগান ও অত্যাধুনিক সমরাস্ত্র ক্রয় করার উদ্দেশ্যে আবু সুফিয়ানের নেতৃত্বে মক্কার একটি বিশাল বাণিজ্য কাফেলা শামে গিয়েছিল। মক্কার প্রতিটি ঘর থেকে প্রত্যেকের সামর্থ্য অনুযায়ী অর্থ দিয়ে গঠন করা হয়েছিল ৪০ জন সশস্ত্র অশ্বারোহী যোদ্ধার পাহারায় এক হাজার মালবাহী উটের একটি বাণিজ্যিক বহর।

বিষয়টি আঁচ করতে পেরেছিল মুসলমানরাও। তাই যখন তারা শাম থেকে ব্যবসা শেষে অস্ত্র নিয়ে ঘরে ফিরছিল, তখন তাদের ওপর হামলা করার সিদ্ধান্ত হলো। মুসলমানদের আত্মরক্ষার্থে হামলা করা ছাড়া আর কোনো পথ খোলা ছিল না। বিষয়টি আবু সুফিয়ান টের পেয়ে দ্রুত সাহায্যের জন্য মক্কায় খবর পাঠায়। তবে খবরটি ছিল, মুসলমানরা আবু সুফিয়ানের কাফেলার ওপর হামলা করেছে। খবর পেয়ে তৎক্ষণাৎ আবু জাহেলের নেতৃত্বে এক হাজার সশস্ত্র যোদ্ধার এক বিশাল বাহিনী মদিনা আক্রমণের জন্য বের হয়। অথচ মুসলমানরা যুদ্ধের প্রস্তুতি নিয়ে আসেনি। তাদের উদ্দেশ্য ছিল শুধু আবু সুফিয়ানকে আটকানো।

এই যুদ্ধ সংঘটিত হওয়ার পেছনে যেসব বিষয় প্রত্যক্ষভাবে কাজ করেছিল তা ছিল নাখলার খণ্ডযুদ্ধ, কাফেরদের রণপ্রস্তুতি, আবু সুফিয়ানের অপপ্রচার, যুদ্ধপ্রস্তুতির জন্য অহি লাভ ও মক্কাবাসীর ক্ষোভ ইত্যাদি। আর পরোক্ষ কারণ হিসেবে দেখা হয়, মদিনা শরিফে সাফল্যজনকভাবে ইসলাম সুপ্রতিষ্ঠিত হওয়ায় কুরাইশদের হিংসা, আবদুল্লাহ বিন উবাই ও ইহুদিদের ষড়যন্ত্র, কুরাইশদের যুদ্ধের হুমকি, তাদের বাণিজ্য বন্ধ হওয়ার আশঙ্কা, কাফেরদের আক্রান্ত হওয়ার শঙ্কা, ইসলামের ক্রমবর্ধমান শক্তির ধ্বংসসাধন এবং রাসুল (সা.)-কে চিরতরে নিশ্চিহ্ন করার কাফেরদের অশুভ বাসনা।

যুদ্ধের ফলাফল ও প্রভাব

ঐতিহাসিক বদর যুদ্ধ ইসলামের ইতিহাসে অত্যন্ত তাৎপর্যপূর্ণ ঘটনা। মহান আল্লাহ এই যুদ্ধকে ‘ইয়াওমুল ফুরকান’- সত্য ও মিথ্যার মধ্যে পার্থক্য স্পষ্টকারী দিন বলে আখ্যা দিয়েছেন। আল্লাহর এই নামকরণ থেকেই বদর যুদ্ধের প্রভাব ও ফলাফল সম্পর্কে ধারণা পাওয়া যায়। মূলত প্রতিষ্ঠিত শক্তি কুরাইশদের বিরুদ্ধে সদ্যঃপ্রসূত মদিনার ইসলামি রাষ্ট্রের জন্য বদর ছিল অস্তিত্বের লড়াই। বদর যুদ্ধের বিজয় ছিল মুসলিম উম্মাহর জন্য প্রথম রাজনৈতিক স্বীকৃতি। এ যুদ্ধই ইসলামি রাষ্ট্রের পথচলার গতিপথ নির্ধারণ করে দিয়েছিল। বদর যুদ্ধের পূর্বাপর অবস্থা বিশ্লেষণ করলে বোঝা যায়, এই যুদ্ধ শুধু মদিনা নয়; বরং সমগ্র আরব উপদ্বীপে মুসলিম উম্মাহর ভাবমূর্তি উজ্জ্বল করেছিল।

ঐতিহাসিকরা মনে করেন, হজরত রাসুলুল্লাহ (সা.)-এর হিজরতের পর মদিনায় যে ইসলামি রাষ্ট্রের গোড়াপত্তন হয়েছিল, তার প্রকৃত প্রতিষ্ঠা বদর প্রান্তে বিজয়ের মাধ্যমেই হয়েছিল। এই বিজয়ের আগে মদিনার মুসলিমরা ছিল একটি ধর্মীয় সম্প্রদায় মাত্র। কিন্তু কুরাইশদের মতো প্রতিষ্ঠিত শক্তির বিরুদ্ধে সামরিক বিজয় এই ধারণা পাল্টে দেয় এবং আরব উপদ্বীপে মদিনার মুসলিমদের একটি রাজনৈতিক পক্ষের মর্যাদা এনে দেয়। শুধু তা-ই নয়, বদর যুদ্ধ আরবের বহু মানুষের হৃদয়ের সংশয় দূর করে দেয় এবং তারা ইসলাম গ্রহণের সৎসাহস খুঁজে পায়। এ ছাড়া অসম শক্তির বিরুদ্ধে এই অসাধারণ বিজয় মুসলিম উম্মাহর জন্য অনন্ত অনুপ্রেরণার উৎস।

আরবের অমুসলিমদের ওপরও বদর যুদ্ধের প্রভাব ছিল অপরিসীম। বদর যুদ্ধে কুরাইশ বাহিনীর ৭০ জন নিহত হয়। তাদের বেশির ভাগই ছিল শীর্ষস্থানীয় ব্যক্তিত্ব ও খ্যাতনামা আরব বীর। আবু জাহেল, উতবা ইবনে রাবিয়া, শায়বা ইবনে রাবিয়া, ওয়ালিদ ইবনে মুগিরা, নদর বিন হারেস ও উমাইয়া বিন খালাফের মতো কুরাইশ নেতাদের করুণ মৃত্যু তাদের হৃদয়াত্মাকে কাঁপিয়ে দেয় এবং তাদের চোখ থেকে অহমিকার পর্দা সরে যায়। কারণ সমকালীন ইতিহাসে কুরাইশ গোত্রের এমন বিপর্যয় আরবরা দেখেনি।

এ ছাড়া বদর যুদ্ধে মুসলিম বাহিনীর বিজয় কুরাইশদের অবাধ বাণিজ্য এবং আরবের অন্যান্য গোত্রের ওপর অন্যায় প্রভাব খাটানোর পথ বন্ধ করে দেয়। মদিনার উপকণ্ঠে ডাকাতি ও লুণ্ঠনের যে ধারা যুগ যুগ ধরে চলে আসছিল- যার পেছনে কুরাইশ নেতাদের সহযোগিতা ও প্রশ্রয় ছিল, তা বন্ধ হয়ে যায়। ফলে মুসলিম বাহিনীর এই বিজয়ে স্বস্তি প্রকাশ করে মদিনা ও আশপাশের সর্বস্তরের মানুষ। তারা স্বাগত জানায় সত্যপক্ষের এই মহান বিজয়কে।

;