মায়ের দুধ সন্তানের অধিকার
একজন নারী। হয়রান, পেরেশান। সে সম্ভ্রান্ত আযদ বংশের। দরবারে নববীতে এসে আবেদন জানালেন, আমাকে পবিত্র করুন। উদাত্ত পরামর্শ এলো, ‘যাও, তওবা করো।’
নারী বললেন, ‘আমাকে আপনি মায়িযের মতো ফিরিয়ে দিতে চান? অথচ আমার গর্ভের এ সন্তান ব্যাভিচারের।’ অগত্যা রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম জিজ্ঞেস করলেন, ‘সত্যিই তুমি গর্ভবতী?’ নারী স্বীকারোক্তি দিলো- হ্যাঁ।
নবী করিম (সা.) তাকে সন্তান প্রসব পর্যন্ত অপেক্ষা করতে বললেন। সন্তান হলো। তিনি আবার এলেন। আবারও তাকে ফিরিয়ে দেওয়া হলো এই বলে যে, ‘সন্তানকে রেখে তোমাকে হত্যা করতে পারি না। যাও, সন্তানকে দুধ পান করাও। দুধ ছাড়ানো পর্যন্ত অপেক্ষা করো।’
শিশু দুধ ছাড়লো। সন্তানের হাতে এক টুকরো রুটি দিয়ে আবারো হাজির ওই নারী। আবদার, ‘এবার তো আমাকে পবিত্র করুন!’
নবী করিম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম শিশুটির ভরণপোষণের দায়িত্বভার এক সাহাবির জিম্মায় সোপর্দ করে রজমের আদেশ দিলেন।’ –সহিহ মুসলিম: ১৬৯৫
দয়ার সাগর নবীজী!
গুনাহ কী তা শুনতেই চাননি। দেখিয়ে দিয়েছেন তওবার প্রশস্ত দরজা।
বিপরীতে অনুশোচনাদগ্ধ অন্তর!
শাস্তি পাওয়ার আগ পর্যন্ত নিভছিলো না অনুতাপের অসহনীয় জ্বালা! তার সামনে ছিলো পলায়নের সুযোগ, সন্তানের পিছুটান। কিন্তু মহান রবের সাক্ষাত আকাঙ্খীকে কোনোভাবেই ফেরানো যায়নি।
ওপরের ঘটনায় শিক্ষণীয় অনেক বিষয় রয়েছে। এ ঘটনাটি এখানে আলোচনা করার উদ্দেশ্য হলো- মায়ের দুধের গুরুত্ব বুঝানো। যেজন্য নবী করিম (সা.) শরীয়ত প্রণোদিত শাস্তি দিতেও বিলম্ব করেছেন। তিনি চাননি শিশুটি বঞ্চিত হোক আল্লাহর দেওয়া এ নিয়ামত থেকে।
নবী করিম (সা.)-এর সময়কালের শুরুর দিকে আরবরা দুগ্ধদাত্রী স্ত্রী থেকে দূরে থাকতো। তাদের ধারণা ছিলো, এমতাবস্থায় স্ত্রীর নিকটবর্তী হলে দুধের মধ্যে ক্ষতিকর উপাদান যুক্ত হওয়ার সম্ভাবনা থাকে। আবার এমতাবস্থায় যদি স্ত্রী পুনরায় গর্ভবতী হয়ে যায়, তাহলে দুধ শুকিয়ে যায়। উভয় অবস্থাতেই শিশুর ক্ষতি। তাই তো, নবী করিম (সা.) চেয়েছিলেন, শরীয়তের হুকুমই আসুক এ নিষেধাজ্ঞার সমর্থনে। কিন্তু পরবর্তীকালে পারস্যবাসীদের মধ্যে দু’টি অভ্যাসই দেখতে পেলেন, কিন্তু এতে বাচ্চাদের ক্ষতি হয় না। তখন তিনি এ ইচ্ছা থেকে ফিরে আসেন।
এই হলো আমাদের দ্বীন। ইসলাম। যার শিক্ষা হলো- রবের গোলামের প্রথম খাদ্য তাই হোক, যা রব তাকে দিয়েছেন।
দুনিয়াবী বিবেকও তাই বলে। মাতৃদুগ্ধ ছাড়া অন্য খাবারে সন্তান বেঁচে থাকতে পারে, কিন্তু মায়ের দুধের তৃপ্তি ও উপকার কোনোটাতেই নেই। এতে যে মাতৃস্নেহ আর অকৃত্রিম ভালোবাসা মিশে আছে!
সন্তান জন্মের পর প্রথমদিকে সন্তান যে দুধ পায়, সেটাকে শালদুধ বলা হয়। এই হলুদাভ ও আঠালো দুধের পুষ্টিগুণ অন্য সময়ের দুধ থেকে ভিন্ন হয়ে থাকে। যা শিশুর উপযুক্ত বিকাশ ও সুস্থতার পাশাপাশি কাজ করে নানা প্রতিষেধকের।
শিশুর বয়স বাড়তে থাকে, মায়ের দুধেও আসে পরিবর্তন। সহযোগী এক পত্রিকায় প্রকাশিত সমীক্ষায় দেখা গেছে, ৩১ শতাংশ নবজাতকের মৃত্যু প্রতিরোধ করা সম্ভব, যদি মা জন্মের এক ঘন্টার মধ্যে শিশুকে দুধ পান করান।
আজকাল মায়েদের মধ্যে সন্তানকে জোর করে ফিডারে অভ্যস্ত করার প্রবণতা দেখা যায়। অনেকে তো নিশ্চিন্ত স্বরে বলেন, ‘মেয়েটা ফিডার খেতে শিখে গেছে, এখন আর আমার কোনো চিন্তা নেই।’ অথচ মেয়ের এই ফিডারে অভ্যস্ত হওয়াটাই হওয়া উচিত ছিলো- বড় এক চিন্তা! কেননা, মায়ের দুধের পুষ্টিগুণের বিপরীতে নিতান্তই অপ্রতুল এসব গুঁড়োদুধ, এগুলো অক্ষমও রোগ প্রতিরোধে। এতে বেড়ে যায় সন্তানের অসুস্থভাবে বেঁচে থাকার ঝুঁকি।
কাজেই, গুঁড়োদুধকে প্রত্যাখ্যান করে শিশুকে মায়ের দুধ খাওয়ানোর প্রতি সচেষ্ট হওয়া শুধু একজন মায়ের দায়িত্ব নয়, আল্লাহর বান্দা হিসেবে অবশ্য পালনীয়ও বটে। এজন্যও আল্লাহর পক্ষ থেকে রয়েছে বিপুল প্রতিদান।