করোনাকালে আলেমদের সমাজসেবা প্রশংসা কুড়াচ্ছে
করোনাভাইরাস বিশ্ব সমাজ ব্যবস্থার প্রাচীন রীতি, ঐতিহ্য, মূল্যবোধসহ সকল সামাজিক বিষয়গুলোকে তছনছ করে দিয়েছে। প্রতিনিয়ত আমাদের নৈতিক ও মানবিক মূল্যবোধের ঘাটতি প্রকট হয়ে দেখা দিচ্ছে। আজানা আশঙ্কা ও মৃত্যুভয়ে মানুষ নৈতিকতা এবং মানবিক মূল্যবোধের মানদণ্ডে পরাজয় বরণ করেছে। সন্তান তার মাকে জঙ্গলে ফেলে রেখে আসছে। বাবা তার করোনাগ্রস্ত সন্তানকে বুকে জড়িয়ে ধরতে পারছে না। স্বামী তার স্ত্রীর, আর স্ত্রী তার স্বামীর পাশে থাকতে পারছে না। প্রতিবেশীরা মসজিদের খাটিয়া দিচ্ছে না করোনায় মৃত্যু সন্তানের লাশ কবরস্থানে নিতে, লাশ গোসলের জন্য লোক পাওয়া যাচ্ছে না। কবর খনন করার মানুষ ভয়ে লাপাত্তা। বাবা মার জানাজায় সন্তানরা, আর সন্তানের জানাজায় বাপ ভাইয়েরা অংশগ্রহণ করতে পারছে না। মৃতের মুখাগ্নি করছেন অন্যরা।
যাদের আত্মীয়-স্বজন করোনায় মৃত্যুবরণ করেছেন, তাদের স্বজনরা পাড়া-প্রতিবেশীকে জড়িয়ে কাঁদতে পারছে না। তাদের পাশে সমবেদনা জানাতে উপস্থিত থাকতে পারছে না। ক্ষেত্রবিশেষ মৃত্যুর কথা গোপন রাখছে আত্মীয়-স্বজনরা। মানব সভ্যতার ইতিহাসে এমন নির্মম পরিস্থিতির কথা কি বিশ্ব চিন্তা করেছিলো কোনোদিন, না কেউ কোনোদিন কল্পনা করেছিল এমন অস্বাভাবিক পরিস্থিতির কথা? কিন্তু বাস্তবে আমরা তাই দেখছি। নিদারুণ কষ্ট, যাতনা আর শোকের পাথর বুকে নিয়ে আমাদের বেঁচে থাকতে হচ্ছে। এটাকেই বোধহয় বলা হয়, নিয়তির নির্মম পরিহাস, সব আছে কিন্তু পাশে কেউ নেই, দুনিয়ার অর্জন, প্রভাব-প্রতিপত্তি, সন্তান-সন্ততি, আত্মীয়-স্বজন কোনো কাজে আসেনি।
অন্যদিকে টানা লকডাউনে নিম্নআয়ের ঘরবন্দি মানুষের খাদ্য সঙ্কট আস্তে আস্তে প্রকট হচ্ছে। চলছে নিরন্ন মানুষের মুখে দু’বেলা খাদ্য তুলে দেবার লড়াই। ভুলুণ্ঠিত মানবতাকে বাঁচিয়ে রাখার লড়াই। এ লড়াইয়ে বিশ্বকে জিততেই হবে। না হলে পরাজিত হবে বিশ্ব মানবিকতা। পরাজিত হবে মানুষের মূল্যবোধ, বিবেক ও ধর্মীয় শিক্ষা।
এমন এক কঠিন মুহূর্তে একশ্রেণির মানুষ যখন খাদ্যের অন্বেষণে জীবন সংহার হতে পারে জেনেও লকডাউন উপেক্ষা করে ত্রাণের জন্য ঘর ছেড়ে রাস্তায় নামছেন। তখন আরেক শ্রেণির মানুষ(!) গরিবের ত্রাণের চাল চুরিতে ব্যস্ত। এরা কোথাও কোথাও ক্ষমতার দাপটে আবার কোথাও কোথাও ক্ষমতাসীন দলের পরিচয়ে ত্রাণ লোপাট করছে। মানবতা বিবর্জিত কিছু মানুষের ত্রাণ চুরির ঘটনায় গোটা জাতি হতবাক।
করোনায় কে বাচঁবে কে মরবে তা আমরা কেউ জানি না। কিন্তু মানবতা, নৈতিকতা ও কল্যাণবোধ থেকে লাশ দাফন, লাশের সৎকার, নিরন্ন মানুষের মুখে খাবার তুলে দেওযা থেকে শুরু করে সাধারণ মানুষের পাশে দাঁড়িয়েছে কওমি মাদরাসার আলেম-উলামা ও ছাত্র-শিক্ষকরা। চলমান পরিস্থিতিতে সরকারি-বেসরকারি বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান, রাজনৈতিক দল, সংস্থা ও অনেক মানবহিতৈষী যার যার জায়গা থেকে এগিয়ে এসেছেন। কিন্তু আলেমরা এগিয়ে এসেছেন সম্পূর্ণ নিজ উদ্যোগে। তাদের সেবাগুলো মানুষের বিবেককে নাড়িয়ে দিয়েছে।
লকডাউনে আর্থিকভাবে বিপর্যস্ত মানুষের মাঝে প্রয়োজনীয় খাদ্যদ্রব্য পৌঁছে দেওয়া, করোনাভাইরাসে মৃত মানুষের কাফন দাফনের ব্যবস্থা করা, গণমানুষকে এই প্রাণঘাতী ভাইরাসের সংক্রমণ থেকে বাঁচাতে জনসচেতনতা সৃষ্টিসহ বিভিন্নভাবে সাধারণ মানুষের জন্য ইতিবাচক ভূমিকা রেখে চলেছেন উলামায়ে কেরাম।
বিশেষ করে করোনায় মৃত মানুষের লাশ পুড়ানোসহ বিভিন্ন গুজব ছড়িয়ে পড়লে সাধারণ মানুষের মাঝে মৃত্যুর পর জানাজা ও কবর না পাওয়া নিয়ে শঙ্কা তৈরি হয়, সেই শঙ্কার সময় আলেমরা এগিয়ে আসেন দ্বিধাহীনভাবে। সারাদেশে করোনা আক্রান্ত কিংবা করোনা উপসর্গ নিয়ে মৃত্যুবরণকারীদের গোসল দেওয়া থেকে শুরু জানাজা ও কবর দিয়েছেন, ভিন্ন ধর্মের হলে ওই ধর্মের রীতি অনুযায়ী লাশের সৎকার করেছেন ও করছেন। সহযোগী বিভিন্ন দৈনিকে এসব নিয়ে প্রচুর প্রতিবেদন প্রকাশিত হয়েছে ও হচ্ছে।
বৈশ্বিক মহামারির এই সময়ে আলেম-উলামাদের নেতৃত্বে যেসব সংগঠন, প্রতিষ্ঠান নানামাত্রিক সেবার কাজ করছেন, তাদের প্রত্যেকের প্রতি জানাই আন্তরিক কৃতজ্ঞতা। আশা করি, তারা নিজেদের নিরাপদে রেখে গণমানুষের সেবায় নিয়োজিত থেকে মানুষকে স্বস্তি দেবেন।
আলেম-উলামাদের পরিচালনায় যেসব সংস্থা, প্রতিষ্ঠান কিংবা সংগঠন এই দুর্যোগের সময় মানুষের পাশে দাঁড়িয়েছেন তাদের অন্যতম হলো- আল মারকাজুল ইসলামি (ত্রাণ বিতরণ ও লাশ দাফন), তাকওয়া ফাউন্ডেশন (ত্রাণ ও রান্না করা খাবার বিতরণ, লাশ দাফন), বাংলাদেশ খেলাফত যুব মজলিস, হাফেজ্জী হুজুর রহ. সেবা সংস্থা, রাবেতাতুল ওয়ায়েজিন বাংলাদেশ, আস সুন্নাহ ফাউন্ডেশন (নগদ অর্থ), ইকরামুল মুসলিমিন ফাউন্ডেশন (লাশ দাফন ও ত্রাণ বিতরণ), বাসমাহ ফাউন্ডেশন, সিলেটের সিয়ানাহ ট্রাস্ট, চট্টগ্রামের আল মানাহিল ওয়েলফেয়ার ফাউন্ডেশন, সিলেটের মারকাজুল হিদায়া, খিদমাহ ব্লাড ব্যাংক, কিশোরগঞ্জের ইমাম-উলামা পরিষদ, আল্লামা আযহার আলী রহ. ফাউন্ডেশন, কিশোরগঞ্জের তরুণ আলেম প্রজন্ম, ময়মনসিংহের ইত্তেফাকুল ওলামা, বাড়েরা (ময়মনসিংহ) খানকায়ে মাদানিয়া, উত্তরার আল হিকমাহ সেবা সংস্থা, মিরপুরের খিদমা ফাউন্ডেশন, শুভেচ্ছা ফাউন্ডেশন, গোপালগঞ্জের হোফা বাংলাদেশ, ইসলাহুল মুসলিমিন পরিষদ ও ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশ (লাশ দাফন, ত্রাণ বিতরণ ও কৃষকের ধান কাটা) অন্যতম।
এ ছাড়া চট্টগ্রাম, রাজশাহী, খুলনা, পাবনা, সিরাজগঞ্জ, ফরিদপুর, নোয়াখালী, কুমিল্লা, ব্রাহ্মণবাড়িয়া, পঞ্চগড়, ঠাকুরগাঁও এবং দিনাজপুরসহ দেশের প্রায় প্রতিটি জেলা, উপজেলায় তরুণ আলেমরা সঙ্কটাপন্ন মানুষের পাশে দাঁড়িয়েছেন। কেউ কৃষকের ধান কেটে দিচ্ছেন। কেউ ক্ষেতের তরমুজ ইত্যাদি কেটে কৃষকের সেবার নিজেদের আত্মনিয়োগ করেছেন।
আলেমদের সমাজসেবার এসব কথা দেশি-বিদেশি গণমাধ্যমসহ নানাভাবে আলোচনায় এসেছে। এর বাইরে ইসলামি অঙ্গনের বহু ব্যক্তিত্ব ও প্রতিষ্ঠান অনেকটা নীরবে নানামাত্রিক সেবা দিয়ে যাচ্ছেন। তারা কোনোভাবেই প্রচারের আলোতে আসতে চান না।
অবাক করার মতো বিষয় হলো- আলেমদের নেতৃত্বাধীন প্রতিষ্ঠানগুলোর সেবা বিতরণের ক্ষেত্রে সেবাগ্রহীতার মান-মর্যাদা ও সৌজন্যতার নানামাত্রিক দৃষ্টান্ত স্থাপিত হয়েছে। সেবাগ্রহীতার ছবি প্রচার থেকে নির্মোহ থেকে সঙ্কটগ্রস্ত মানুষকে খাবারের প্যাকেজ পৌঁছে দেওয়া, বাড়ির সামনে গোপনে খাবার রেখে আসা, যাচনাবিমুখ অভাবগ্রস্ত ভদ্র মানুষজনের মাঝে গোপনে নগদ অর্থ পৌঁছে দেওয়া, রান্না করা খাবার ও ইফতার বিভিন্ন জায়গায় পৌঁছে দেওয়া, স্বাস্থ্য সুরক্ষার সরঞ্জাম এবং স্যানিটাইজারসহ প্রয়োজনীয় দ্রব্য বিভিন্ন পরিবারের হাতে তুলে দিয়েছেন তারা। এমনকি লাশ দাফনের ক্ষেত্রে মৃতের পরিবারের মান-মর্যাদা রক্ষায় সবোর্চ্চ গোপনীয়তা অবলম্বন করা হয়েছে। এখনও পথে-ঘাটে জীবাণুনাশক ছিটানো এবং করোনায় আক্রান্ত হয়ে মৃত্যুবরণকারী মানুষজনের জানাজা ও দাফন-কাফনের ব্যবস্থা করাসহ ঈদকে সামনে রেখে বিভিন্ন সেবা অব্যাহত রেখেছেন তারা।
জীবনের ঝুঁকি নিয়ে লাশ দাফনে এগিয়ে আসা থেকে শুরু করে সঙ্কটাপন্ন মানুষের পাশে আলেমদের দাঁড়ানোর বিষয়টি অবশ্যই ইতিবাচক একটি দিক। আলেম-উলামাদের এই সেবা ইসলামি আদর্শ ও শিক্ষারই অংশবিশেষ।