করোনাকালে শেখার আছে অনেক কিছু
মানুষ কে? আল্লাহতায়ালার সেরা সৃষ্টি, দেহ আর আত্মার সমষ্টির নাম। মাটির এ দেহে প্রাণের সঞ্চার হলেই মানুষ মানুষ হয়। দেহ আর আত্মা মানুষ হওয়ার জন্য একটি অপরটির পরিপূরক।
মানব জীবনের হাজারও ব্যস্ততা, কর্মচঞ্চলতা সবই নির্ভর করে প্রাণের ওপর। তাই প্রাণহীন মানুষ মৃত। সুতরাং দেহের তুলনায় প্রাণের মূল্য বেশি। কিন্তু বাস্তবতা ভিন্ন। আমাদের ব্যস্ততা দেহকেন্দ্রিক। এই যে করোনাভাইরাস। যা দেখা যায় না, ধরা যায় না। তার ভয়ে আমরা ভীতু। করোনা দেহে অনুপ্রবেশ করলে আমরা মরে যাবো, তাই কত সতর্কতা। সামাজিক দূরত্ব, মাস্ক, গগলস, গ্লাভস, হ্যান্ডস্যানিটাইজার, পিপিই- আরও কত কী? দেহকে রোগমুক্ত করতে আমাদের কত সচেতনতা। ক্ষণে ক্ষণে কত গবেষণা। কিন্তু মানুষের আত্মাও যে রোগাক্লিষ্ট হয়- তা কী আমরা জানি?
এ প্রসঙ্গে কোরআনে কারিমে ইরশাদ হচ্ছে, ‘তাদের অন্তর ব্যাধিগ্রস্ত আর আল্লাহ তাদের ব্যাধি আরও বাড়িয়ে দিয়েছেন। আর তাদের জন্য আছে যন্ত্রণাদায়ক শাস্তি তাদের মিথ্যাচারের দরুণ।’ –সূরা আল বাকারা: ১০
শরীর অসুস্থ হলে মানুষ দূর্বল হয়, তৈরি হয় অরুচি। তেমনি অন্তর রোগাক্রান্ত হলে মানুষ দূর্বল হয়, হারিয়ে ফেলে ইবাদতের শক্তি। জড়িয়ে পড়ে অন্যায়-অবিচারে। হাদিস শরিফে এসেছে, হজরত নুমান ইবনে বাশির (রাযি.) থেতে বর্ণিত, হজরত রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেন, ‘জেনে রাখো, দেহের মধ্যে এক টুকরা গোশত আছে। যখন তা সুস্থ থাকে তখন সমস্ত শরীরই সুস্থ থাকে, আর যখন তা নষ্ট হয়ে যায় তখন সমস্থ শরীরই নষ্ট হয়ে যায়। স্মরণ রেখো, তা হলো- কলব (হৃদয়, আত্মা)। -সহিহ মুসলিম: ৩৯৪৯
বর্ণিত হাদিসের থেকে এটা স্পষ্ট বুঝা যায়, আত্মা নষ্ট হলে সবই নষ্ট। এখন প্রশ্ন হলো- আত্মার রোগ কী? কীভাবে আত্মা নষ্ট হয়?
কোরআনে কারিম ও হাদিসে নববী থেকে আত্মার রোগ সম্পর্কে আমরা জানতে পারি। বলা হয়েছে আত্মার রোগ হলো- হিংসা, লোভ, অহঙ্কার, গীবত, মিথ্যা, লোক দেখানো ইবাদত, অন্যের ক্ষতি কামনা করা, খারাপ ব্যবহার করা, শরিয়তের বিধান পালনে অলসতা ইত্যাদি। আরও সহজে বলা যায়, প্রতিটি কবিরা গোনাহই অন্তরের জন্য ব্যাধি। এ সব ব্যাধি থেকে আরোগ্যলাভ করতে হবে। অন্যথায় আত্মা এক সময় মারা যাবে। করোনা বা অন্যকোনো রোগে আক্রান্ত হলে মানুষ সর্বোচ্চ মারা যায়। এমনিতেই মানুষ মরণশীল। কিন্তু অন্তরের ব্যাধি নিয়ে কেউ মারা গেলে সে হয় জাহান্নামি, জাহান্নামের অধিবাসী। এ প্রসঙ্গে কোরআনে কারিমে ইরশাদ হচ্ছে, ‘আপনি বলে দিন উত্তাপে জাহান্নামের আগুন প্রচণ্ডতম। যদি তাদের বিবেচনা শক্তি থাকত।’ -সূরা তাওবা: ৮১
করোনা রোগীর সংস্পর্শে গেলে আমরা আক্রান্ত হওয়ার আশঙ্কা করি, তাই দূরে থাকি। সুতরাং গোনাহের সংস্পর্শে গেলেও মানুষের অন্তর আক্রান্ত হওয়ার আশঙ্কায় থাকে, তাই গোনাহ এবং গোনাহের পরিবেশ থেকে দূরে থাকার অভ্যাস করা দরকার।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন চোখ, কান, মুখ দিয়ে করোনা শরীরে প্রবেশ করে, তাই মানুষ এগুলো রাখেন। কিন্তু গোনাহের দরজা বন্ধ রাখার কোনো উদ্যোগ নেই না। কবি বলেছেন, ‘তুমি তোমার চোখ, মুখ এবং কান বন্ধ করো, তার পরও যদি সত্যের জ্যোতি না দেখো- তবে আমায় প্রশ্ন করো।’ অর্থাৎ মানুষ এ তিন ইন্দ্রিয় বন্ধ করলে সে সত্যের দিশা পাবে। কারণ এ তিন ইন্দ্রিয় বড় বড় গোনাহের কারণ। চোখ দিয়ে অশ্লীলতার গোনাহ করে, কান দিয়ে গীবত, গান-বাজনা বা এ জাতীয় গোনাহের কথা শোনে। জবান তো হরহামেশা মিথ্যা, পরনিন্দা, গালমন্দ, অশালীন বক্তব্য কখনও কুফরির কথা বের হয়। করোনা থেকে দূরে থেকে দেহকে বাঁচাতে যদি আমাদের সতর্কতার মাত্রা অত্যাধিক হয়, তাহলে অন্তরকে গোনাহ থেকে বাঁচাতে আরও বেশি সতর্ক হতে হবে- এটাই বাস্তবতা ও ঈমাদের দাবি, মুসলমানদের করণীয়।
সেদিন বাড়ি গেলাম। এক নিকটাত্মীয়ের সঙ্গে দেখা। অন্যসময় দেখা-সাক্ষাতে বেশ সমাদর করত। খোঁজ-খবর নিতো কেমন আছি, কখন এসেছি। কিন্তু সেদিনের চিত্র পুরো উল্টো। আমাকে দেখে চোখ দুটো বড় করে তাকালেন। আর মুখে যা বললেন, সেটা না বলাই ভালো। অপরাধ, এই সময়ে কেন আমি বাড়ি গেছি! আশ্চর্য মানুষের মনোভাব?
এ ঘটনায় মনে হলো- এই মানুষগুলো করোনার ভয়ে যতটা প্রতিবাদী ও সতর্ক, এর অর্ধেক সতর্ক যদি হতো সমাজে সংঘটিত অন্যায়-অপরাধের বিরুদ্ধে; তাহলে সমাজের চিত্রটা কেমন হত?
করোনা রোগীর সংস্পর্শে আশা ব্যক্তিকে ১৪ দিনের হোম কোয়ারেন্টাইনে রাখা হচ্ছে, তাকে নিরাপদ রাখার জন্য। যদি গোনাহের সংস্পর্শে আশা মানুষগুলোকে কোনো আল্লাহওয়ালার সংস্পর্শে ৭ দিনও রাখা হয়; তাহলে সে পরিবার, দেশ ও জাতির জন্য হবে নিরাপদ। সে হয়ে ওঠবে আল্লাহর প্রিয় বান্দা। আমরা সচেতন মানুষ। এতটুকু শিক্ষা কি গ্রহণ করতে পারি না?
মাওলানা হাসান মুরাদ: শিক্ষক, জামিয়া ইসলামিয়া দারুল উলুম, বুজরুকগড়গড়ী, চুয়াডাঙ্গা