দুনিয়া মানুষের জন্য যেমন নিয়ামত, তেমনি কষ্টের
চলমান করোনা পরিস্থিতিতে প্রতিদিন বাড়ছে আক্রান্ত রোগী ও মৃতের সংখ্যা। দীর্ঘ ছুটির পর সবকিছু উন্মুক্ত করার পর পুনরায় করোনাভাইরাস প্রতিরোধে ৫০টি জেলা ও ৪০০ উপজেলা সম্পূর্ণ, ১৩টি জেলা ও ১৯টি উপজেলাকে আংশিক লকডাউন করার ঘোষণা দিয়েছে স্বাস্থ্য অধিদফতর।
রোববার (৭ মে) সকাল থেকে স্বাস্থ্য অধিদফতর এই লকডাউন কার্যকরের জন্য ব্যবস্থা নিয়েছে। জনজীবনের স্বাস্থ্য নিরাপত্তার কথা ভেবেই এমন উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। তাই এই সময়ে স্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞদের কথা মেনে চলা প্রয়োজন। তাদের উপদেশ শুনে সে অনুযায়ী চলা পবিত্র দ্বীনেরও আদেশ। কারণ আল্লাহতায়ালার দেওয়া আমানত জীবনকে রক্ষা করা আমাদের দায়িত্ব।
চলমান কঠিন সময়ে সময়ে ঈমান-আখলাক ঠিক রেখে মানুষের সামাজিক ও আধ্যাত্মিক দিকগুলোকে শক্তিশালী করতে হবে। এ জন্য সবার ওপর অর্পিত কিছু দায়িত্ব রয়েছে, এসব দায়িত্ব যথাযথভাবে পালন করতে হবে। রাষ্ট্র, প্রশাসন, ব্যক্তি, পরিবার, নারী-পুরুষ, যুবক-বৃদ্ধ থেকে শুরু করে সব শ্রেণি-পেশা ও ধর্মের মানুষের ওপর এ দায়িত্ব রয়েছে। এই কঠিন সময়কে সম্মিলিতভাবে দুশ্চিন্তা, উদ্বেগ ও শঙ্কার বদলে রহমতে রূপান্তরিত করতে হবে। মনে সাহস ও জোর বাড়াতে হবে। কোনোভাবেই হতাশ হওয়া চলবে না।
এখন আফসোস আর হাহাকার করার সময় নয়, মানুষের পাশে দাঁড়ানো এবং সমস্যাকে দূর করার সময়। এমন কঠিন সময়ে জীবন দিয়ে যারা এই মহামারিকে প্রতিহত করার চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছেন, সেসব ডাক্তার, নার্স এবং তাদের পাশাপাশি মানুষের জরুরি প্রয়োজনসমূহ পূরণ করার জন্য সব ধরণের ঝুঁকি নিয়ে সেবাকে ইবাদত মনে করে দায়িত্ব পালন করে যাচ্ছেন, কোনো রোগীকে বাসায় সেবা দিচ্ছেন- তারা নিঃসন্দেহে সওয়াবের কাজ করছেন। এ জন্য তারা আল্লাহতায়ালার কাছ থেকে উত্তম প্রতিদান পাবেন।
কোরআনে কারিমে যে ধৈর্যের কথা উল্লেখ করা হয়েছে তার অর্থ সহ্য করা কিংবা কোনোভাবে বিদপ পার করে দেওয়া নয়। কোরআনে কারিমে যে ধৈর্যের কথা বলা হয়েছে, তার অর্থ হলো- প্রতিরোধী হওয়া, অন্যায় এবং অত্যাচারের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ ও প্রতিরোধের প্রেরণাকে হারিয়ে না ফেলা।
বিষয়কে কোরআনে কারিমে এভাবে উল্লেখ করা হয়েছে, ‘যারা সচ্ছল ও অসচ্ছল সব অবস্থায়ই অর্থ-সম্পদ ব্যয় করে এবং যারা ক্রোধ দমন করে ও অন্যের দোষ-ক্রটি মাফ করে দেয়। আর এ ধরনের সৎলোকদের আল্লাহ অত্যন্ত ভালোবাসেন।’
ইনশাল্লাহ আল্লাহতায়ালার অশেষ মেহেরবানীতে এই কঠিন সময় চলে যাবে। কিন্তু এই সময়ে আমরা যে মর্যাদা ও মানবতাপূর্ণ আচরণ অর্জন করব তা থেকে যাবে। থেকে যাবে কঠোর কিংবা কঠিন আচরণের ক্ষতও। এ সময়ে ভাইরাসে আক্রান্ত না হওয়ার জন্য আমাদের শরীরের রোগ প্রতিরোধ ব্যবস্থা শক্তিশালী রাখা, সতর্ক থাকা যতটা গুরুত্বপূর্ণ; একইসঙ্গে জাতি হিসেবে আমাদের আধ্যাত্মিকতা, সামাজিকতা, মানবিকতা ও দায়িত্ববোধকে শক্তিশালী করা আরও বেশি গুরুত্বপূর্ণ।
এই কঠিন সময়ে আল্লাহ প্রদত্ত জীবনকে রক্ষা করা, তার সবচেয়ে বড় আদেশসমূহের একটি। কিন্তু শরীরকে রক্ষার সময় আমাদের ঐক্য, একতা, ভ্রাতৃত্ব ও মমত্ববোধ যেন বিনষ্ট না হয়- এটা মনে রাখতে হবে। এক দিক থেকে সামাজিক দূরত্ব বজায় রাখছি, কিন্তু আমরা যেন আমাদের মধ্যকার বন্ধনকে শক্তিশালী করার কথা ভুলে না যাই। একদিক থেকে শারীরিকভাবে একে-অপরের সঙ্গে একত্রিত হওয়া থেকে বঞ্চিত হচ্ছি, মুসাফাহা পর্যন্ত করতে পারছি না। কিন্তু এই সময়ে আমাদের মধ্যকার আন্তরিক সম্পর্কে যেন ভাটা না পরে। নিয়ম মানতে হবে এবং সামাজিক ঐক্য এবং ভ্রাতৃত্বকে রক্ষা করার জন্য সর্বাত্মক প্রচেষ্টা চালাতে হবে। যে সব ভাষা আমাদেরকে মধ্যে শত্রুতা সৃষ্টি করে ও দূরত্ব বাড়ায় সেই সব ভাষা থেকে দূরে থাকতে হবে। সামাজিক শান্তি ও নিরাপত্তা প্রতিষ্ঠার জন্য অন্য যেকোনো সময়ের তুলনায় অনেক বেশি সতর্ক থাকতে হবে। আমরা নিকট অতীতে আমাদের জাতিকে যে বিভাজন করেছি ও নিজেরা বিভাজিত হয়েছি সেটাকে ভুলে যেতে হবে।
আবারও বলি, করোনার বিপদ আজ হোক কিংবা কাল হোক শেষ হবে- ইনশাল্লাহ। কিন্তু এই সময়ে যদি আমরা কারো মনে কষ্ট দেই তাহলে কিন্তু সেটা থেকে যাবে, খুব সহজে সেই ক্ষত দূর হবে না। তাই সাবধান! আমরা কারও মনে কষ্ট না দেই। মানবতার এই কঠিন সময় পাড়ি দেওয়ার মুহূর্তে নিজের ওপর অর্পিত দায়িত্ব ও কর্তব্য যথাযথভাবে পালন করি।
মসিবতের এই সময়কে মূল্যায়ন করার সময় তাড়াহুড়া করে যেন আমাদের কেউ এটাকে ভীতিকর কিছু না বলে, সেদিকে খেয়াল রাখি। কোনো বিষয়কে মূল্যায়ন করার সময় সামগ্রিকভাবে মূল্যায়ন করা দরকার। ইতিহাসের দিকে যদি তাকাই তাহলে দেখতে পাই যে, বড় বড় বিপদ সময়ে একইসঙ্গে ইতেকাদ (বিশ্বাস) বিনষ্টকারী বাতিল বিশ্বাসসমূহের জন্ম হয়ে থাকে। তাই খুব সাবধানে কথা বলা দরকার। এসব বিষয়কে বিশ্লেষণ কিংবা মূল্যায়ন করার সময় সামগ্রিক বিষয়কে বিবেচনায় রাখতে হবে।
মানুষের জন্য এই বিশ্বজগত একইসঙ্গে নিয়ামত ও কষ্টের জায়গা। মহান আল্লাহ রাব্বুল আলামিন এই প্রতিকূলতাকে নিয়ামতে রূপান্তরিত করার মানুষকে জন্য শক্তি এবং সম্ভাবনা দান করেছেন। ইতিহাসের গতিধারাকে পরিবর্তন করে দেওয়ার মতো শক্তি ও সম্ভাবনা দিয়ে মানুষকে সৃষ্টি করা হয়েছে। মানবতার ইতিহাসের অনেক মুসিবতকে আল্লাহর সাহায্যে নিয়ামতে পরিণত করতে সক্ষম হয়েছে গবেষকরা। এতে কোনো সন্দেহ নেই যে- ইনশাআল্লাহ জ্ঞানের মাধ্যমে, ঈমানের মাধ্যমে, দৃঢ় সংকল্পের মাধ্যমে, তদবিরের (চিকিৎসা) মাধ্যমে এবং তাওয়াক্কুলের (আশা-ভরসা) মাধ্যমে চলমান এই সঙ্কটকে মোকাবেলা করতে সক্ষম হব।