সন্তানের অবাধ্যতা ও পিতামাতার দায়
পৃথিবী তার বুড়ো বয়সে পৌঁছে গেছে। শেষ দিবস হাতছানি দিয়ে ডাকছে। এই বৃদ্ধ পৃথিবীর চারদিকে এখন তাই বিশৃঙ্খলা, অনাচার আর হাহাকার। হজরত রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের ভবিষ্যদ্বাণী করেছেন, কিয়ামতের আগের নানাবিধ বিশৃঙ্খলা প্রসঙ্গে। এসব এখন অনেকটাই সত্য। বর্তমান পৃথিবীর নানা প্রান্তে দারুণভাবে অবহেলিত হচ্ছে ইসলামি শিক্ষা। ফলশ্রুতিতে সমাজে সয়লাব হচ্ছে নৈতিক বিভিন্ন অবক্ষয়ের। এসব সামাজিক অবক্ষয়ের একটি হলো- পিতা-মাতার অবাধ্যতা, বড়দের প্রতি অশ্রদ্ধা এবং শিক্ষকের অবমূল্যায়ন ও অমর্যাদা।
আমরা জানি, জীবনের নিয়মে একটা বয়সে পৌঁছার পর সন্তান বাবা-মায়ের আঙুল ছেড়ে দেয়৷ জীবনকে নিজের মতো গড়ে নেওয়ার অজুহাতে তাদের আদেশ-নিষেধের কোনো তোয়াক্কা করে না। নিজেকে স্বয়ংসম্পূর্ণ ভাবতে শুরু করে, বড়দের উপদেশকে পাত্তা দেয় না। হারিয়ে ফেলে শিক্ষকের প্রতি স্বভাবজাত শ্রদ্ধা। আর এসবের পেছনে কাজ করে, এক ধরণের উগ্রতা।
বস্তুত পৃথিবীতে কারণহীন কোনো কিছুই ঘটে না। সবকিছুর পিছনে থাকে যৌক্তিক কোনো না কোনো কারণ ও মর্ম, বাহ্যিক কোনো উসিলা। কিন্তু আফসোসের বিষয় হলো- বড়রা কেবল ছোটদের দোষ দিয়েই ক্ষান্ত থাকেন। বেয়াদব, অবাধ্য ইত্যাদি উপাধি দিয়ে, তার প্রতি কিছুটা বিরক্তি প্রকাশ করে থেমে যান। কিন্তু সন্তানটি কেনো এমন হলো, এর কারণ অনুসন্ধানের চেষ্টা করেন না। ঘটনার গভীরে যান না। অথচ সামান্য অনুসন্ধান করলেই স্পষ্ট হয়ে যায় এর পেছনের কারণগুলো। সন্তানের হঠাৎ এমন পরিবর্তন, অবাধ্যতা ও নিন্দনীয় চরিত্রের পেছনে সামান্য হলেও বড়দের ভূমিকা রয়েছে।
কারণ, ইসলাম মনে করে- ছোটদের কাছ থেকে উত্তম চরিত্র ও ব্যবহার পেতে হলে, তাদের মাঝে ইসলামপ্রিয়তা ফুটিয়ে তুলতে হলে; সর্বাগ্রে বড়দের আল্লাহভীরু হতে হবে৷ আল্লাহর বিধান সংরক্ষণে যত্নশীল হতে হবে। হজরত ইবনে আব্বাস রাযিয়াল্লাহু আনহু থেকে বর্ণিত এক হাদিসে রয়েছে, হজরত রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তাকে উদ্দেশ্য করে বলেন, ‘বৎস! তোমাকে আমি কিছু কথা শিখিয়ে দিচ্ছি। আল্লাহর বিধি-নিষেধ রক্ষা করো, আল্লাহ তোমাকে রক্ষা করবেন। আল্লাহর বিধান হেফাজত করো, আল্লাহকে তোমার সামনে পাবে।’ –সুনানে তিরমিজি
অনেক তাৎপর্যপূর্ণ এক হাদিস। এখানে বলা হয়েছে, আল্লাহর বিধান রক্ষা করলে স্বয়ং আল্লাহতায়ালা ব্যক্তির রক্ষাকারী হয়ে যাবেন। আর হেফাজতের পূর্ণতা তখনই হবে, যখন ব্যক্তির সন্তানাদি, আপনজন ও ঘনিষ্ঠজনদেরও হেফাজত হবে। কেননা এদের মাধ্যমে সেই ব্যক্তি আঘাতপ্রাপ্ত হলে তো হেফাজতের ঘাটতি থেকে যাবে। আর আল্লাহর রক্ষণাবেক্ষণে কোনো ঘাটতি থাকা অসম্ভব! হাদিসে ব্যাখ্যায় এমনই বলছেন ইসলামি স্কলাররা।
এ হাদিস প্রসঙ্গে ইবনে রজম হাম্বলি রহমাতুল্লাহি আলাইহি ইবনুল মুনকাদির রহমাতুল্লাহি আলাইহির কথা উদ্ধৃত করে বলেন, ‘নেককার বান্দাদের উসিলায় আল্লাহ তার সন্তান-সন্ততি, নাতি-নাতনি এবং আপনজনদের হেফাজত করেন। তারা আল্লাহর পক্ষ থেকে হেফাজত এবং আবরণে থাকেন।’
অর্থাৎ ব্যক্তি যখন আল্লাহওয়ালা হবে, তার সন্তান-সন্ততি-আপনজন-অধীনস্থ সবার ওপর এর উত্তম ও কল্যাণকর প্রভাব পড়বে৷ এর ফলশ্রুতিতে আল্লাহ তাদেরকেও খোদাভীরু এবং সৎ হিসেবে জীবন গঠনের তওফিক দেবেন। উগ্র চরিত্র ও বিপথে যাওয়ার পথে বাঁধা তৈরি করবেন। এ জন্যেই সাঈদ ইবনুল মুসাইয়্যাব রহমাতুল্লাহি আলাইহি নিজের সন্তানের কল্যাণ কামনা করে বেশি বেশি নামাজ পড়তেন। যেন এর উসিলায় আল্লাহতায়ালা তার সন্তানের হেফাজতকারী হয়ে যান। তার বিপথ ও গোমরাহির মাঝে বাঁধা হয়ে যান।
অথচ আজকাল এমনটা দেখা যায় না বললেই হয়। ভিন্ন নফল তো দূরের ব্যাপার, ফরজ সমাপান্তে দোয়াতেও হয় না ছোটদের বিশেষ করে সন্তানদের উল্লেখ৷ থাকে না তাদের জন্য অশ্রুঝরা আবেদন। তবে আর কী করে ছোটদের সংশোধন কামনা করা যায়?
শুধু বড়দের ভালো আমলের সুফলই নয়, বরং মন্দ আমলের কুফলও অনেক সময় ছোটদের ছুঁয়ে যায়। খারাপ প্রভাব ফেলে৷ ফলতঃ তারা হয় অবাধ্য ও উগ্রস্বভাবের। এক বুজুর্গ এ সম্পর্কে বলেন, ‘আমি যখন কোনো গুনাহ করি, তখন এর ছাপ আমার সেবক এবং বাহনের মাঝেও দেখতে পাই।’
বাহনের মতো অবলা পশুর ওপর যদি মালিকের গুনাহের ছাপ পড়তে পারে, তবে সন্তান-সন্ততি ও আপনজনদের ওপর প্রভাব পড়তে পারে তা বলাই বাহুল্য।
কাজেই, ছোটদের দোষারোপ ও অন্যায় নির্ণয়ের পূর্বে নিজেদের ভুলগুলো শুধরে নেওয়া উচিত এবং ছোটদের সুন্দরভাবে বুঝানো উচিত। বড়দের ভালো আমলের উত্তম প্রভাব ও নসিহতের উসিলায় হয়তো আল্লাহতায়ালা পরিশুদ্ধ করবেন সবাইকে।