বস্তুনিষ্ঠ সংবাদ পরিবেশনকারীর জন্য রয়েছে মহাপুরস্কার

  • মুফতি জাওয়াদ তাহের, অতিথি লেখক, ইসলাম
  • |
  • Font increase
  • Font Decrease

বস্তুনিষ্ঠ সংবাদ পরিবেশনকারীর জন্য রয়েছে মহাপুরস্কার, ছবি: সংগৃহীত

বস্তুনিষ্ঠ সংবাদ পরিবেশনকারীর জন্য রয়েছে মহাপুরস্কার, ছবি: সংগৃহীত

গণমাধ্যমের গুরুত্ব ও প্রয়োজনীয়তা কারো অজানা নয়। যুগ যুগ ধরে সংবাদ প্রচারের বিভিন্ন পদ্ধতি চলে আসছে। পাঠকমাত্রই এ বিষয়ে অবগত। সাংবাদিকের যেমন মর্যাদা রয়েছে, তেমনি রয়েছে তার জন্য সতর্কবাণী। হজরত রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আমাদেরকে বিভিন্ন বিষয়ের সংবাদ দিয়েছেন। অসংখ্য হাদিসে এসেছে তিনি সাহাবিদের উপদেশ দিতে গিয়ে এভাবে উল্লেখ করেছেন, ‘আমি কী তোমাদেরকে এমন সংবাদ দেবো না, যার ওপর আমল করলে তোমরা জান্নাতে যেতে পারবে?’ প্রত্যেক নবী-রাসূলই আল্লাহতায়ালার দেওয়া সংবাদ পৃথিবীর মানুষদের কাছে পৌঁছে দিয়েছেন। বর্তমান সমাজের নানাবিধ খবরা-খবর আমরা জানতে পারি সাংবাদিকদের মাধ্যমে।

কোরআনে কারিমে সাংবাদিকতা প্রসঙ্গ
আল্লাহতায়ালা সূরা সাবায় হুদহুদ পাখির সংবাদের কথা আলোচনা করেছেন। সংবাদ কেমন হওয়া চাই, সাংবাদিকের গুণাবলী কী কী- এ নিয়েও চমৎকার বিশ্লেষণ করা হয়েছে। কোরআনে কারিমে আল্লাহতায়ালা বলেন, ‘তারপর হুদহুদ এসে বলল, আমি যা অবগত হয়েছি আপনি তা অবগত নন, আমি সাবা থেকে আপনার জন্য নিশ্চিত খবর নিয়ে এসেছি। আমি এক নারীকে দেখতে পেলাম, সে তাদের ওপর রাজত্ব করছে। তাকে দেওয়া হয়েছে সব কিছু। আর তার আছে এক বিশাল সিংহাসন। আমি তাকে ও তার সম্প্রদায়কে দেখতে পেলাম তারা আল্লাহর পরিবর্তে সূর্যকে সিজদা করছে। আর শয়তান তাদের কার্যাবলিকে তাদের জন্য সৌন্দর্যমণ্ডিত করে দিয়েছে এবং তাদের সৎপথ থেকে নিবৃত্ত করেছে, ফলে তারা হেদায়াত পায় না। যাতে তারা আল্লাহকে সিজদা না করে, যিনি আসমান ও জমিনের লুকায়িত বস্তুকে বের করেন। আর তোমরা যা গোপন করো এবং তোমরা যা প্রকাশ করো তিনি সবই জানেন। আল্লাহ ছাড়া সত্যিকারের কোনো ইলাহ নেই। তিনি মহা আরশের রব।’ -সূরা আন নামল: ২২-২৬

বিজ্ঞাপন

বর্ণিত আয়াতের কয়েকটি বিষয় লক্ষণীয়। ১. খবরটি নির্ভরযোগ্য ও সুনিশ্চিত কি না সে বিষয়ে যাচাই করা। ২. সংবাদ প্রমাণ নির্ভর হওয়া। ৩. সমালোচনা সবার জন্য সমান। এমন নয় যে শুধু প্রজাদের জন্য সমালোচনা হলো আর নেতৃস্থানীয়দের ক্ষেত্রে কোনো সমালোচনা নেই। ৪. সমস্যা ও তার সমাধানের প্রতি ইঙ্গিত থাকা। দূর থেকে নয় বরং মাঠে-ময়দানে যেয়ে সংবাদ সংগ্রহ করা।

হাদিসে সংবাদের বর্ণনা
হজরত রাসূলুল্লাহ (সা.) হুদাইবিয়ার সন্ধির পর বিভিন্ন দেশের রাজা-বাদশাদের কাছে পত্র প্রেরণ করেছেন ইসলাম প্রচারের উদ্দেশে। ইতিহাসের পাতায় সেসব বিরল ঘটনাবলী আজো সংরক্ষিত। হজরত আবদুল্লাহ ইবনে আব্বাস (রা.) থেকে বর্ণিত, আল্লাহর রাসূল (সা.) বাদশা কায়সারের নিকট চিঠি লিখেছিলেন এবং এতে বলেছিলেন, যদি তুমি মুখ ফিরিয়ে রাখো তাহলে প্রজাদের পাপের বোঝা তোমার ওপর চাপানো হবে। -সহিহ বোখারি: ২৯৩৬

বিজ্ঞাপন

ভুল সংবাদ প্রচার থেকে বিরত থাকা
আল্লাহতায়ালা কোরআনে কারিমে বলেন, হে মুমিনগণ! যদি কোনো পাপাচারী ব্যক্তি তোমাদের কাছে কোনো সংবাদ আনয়ন করে, তবে তোমরা পরীক্ষা করে দেখবে, যাতে অজ্ঞতাবশতঃ তোমরা কোনো সম্প্রদায়ের ক্ষতিসাধনে প্রবৃত্ত না হও এবং পরে নিজেদের কৃতকর্মের জন্যে অনুতপ্ত না হও। -সূরা আল হুজরাত: ৬

আজ থেকে সাড়ে চৌদ্দশ বছর পূর্বে আল্লাহতায়ালা এই আদেশ দিয়েছেন। বর্তমান সময়ে যদি এই আয়াতের প্রতি লক্ষ্য করি, তাহলে মনে হবে এখনকার প্রেক্ষাপটকে সামনে রেখে আয়াতটি নাজিল হয়েছে।

শোনা কথা যাচাই-বাছাই ছাড়া প্রচার করে বেড়ানো ভয়াবহ অপরাধ। এ বিষয়ে হাদিসে ইরশাদ হয়েছে, হজরত আবু হুরায়রা (রা.) থেকে বর্ণিত। তিনি বলেন, হজরত রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন, কোনো লোকের মিথ্যাবাদী হওয়ার জন্য এতটুকুই যথেষ্ট যে, সে যা শুনে (সত্যতা যাচাই না করে) তা-ই বলে বেড়ায়। -সহিহ মুসলিম: ৫

যেকোনো সংবাদ যাচাই না করে তা প্রকাশ ও প্রচার করতে নিষেধ করা হয়েছে। বর্তমান সময়ে সবার আগে সংবাদ দেওয়ার প্রবণতা থেকে দেখা যাচ্ছে, প্রায়ই ভুল ও অসত্য সংবাদ করো হচ্ছে। এর ফলে সাংবাদিক তার নির্ভরযোগ্যতা হারিয়ে ফেলেন। এমনকি ওই প্রতিষ্ঠানের গ্রহণযোগ্যতা নিয়ে নানা প্রশ্ন ওঠে। যা কোনোভাবেই কাম্য নয়। মিথ্যা, বানোয়াট, অসত্য, গুজব প্রচার ও প্রকাশ ইসলাম নিষিদ্ধ কাজ।

সংবাদ প্রচার করা একটি আমানত
সংবাদ এক ধরনে আমানত। এই আমানতকে কোনো ধরণের কাট-ছাঁট না করে হুবহু প্রকাশ করাই একজন পেশাদার সাংবাদিকের নৈতিক দায়িত্ব আমানতের খেয়ানত ইসলামে কঠোরভাবে নিষিদ্ধ। এ প্রসঙ্গে কোরআনে কারিমে ইরশাদ হয়েছে, হে ঈমানদারগণ! খেয়ানত করো না আল্লাহর সঙ্গে ও রাসূলের সঙ্গে এবং খেয়ানত করো না নিজেদের পারস্পরিক আমানতে জেনে-শুনে। -সূরা আল আনফাল: ২৭

আল্লাহতায়ালা আমাদেরকে সদা সত্য ও নির্ভেজাল কথার প্রতি উদ্বুদ্ধ করেছেন। ইরশাদ হয়েছে, হে ইমানদারগণ! আল্লাহকে ভয় করো এবং সঠিক কথা বলো। -সূরা আল আহজাব: ৭০

তাই নিজস্ব চিন্তা কিংবা দল-মতের প্রলেপ মাখিয়ে সংবাদকে আংশিক বা পুরোপুরি পরিবর্তন করে উপস্থাপন করা ইসলামের দৃষ্টিতে সম্পূর্ণ হারাম। বস্তুনিষ্ঠ কোনো সংবাদের একটু পরিবর্তনে ঘটতে পারে অশান্তির দাবানল। তাই এ বিষয়ে সর্বোচ্চ সতর্কতা অবলম্বন অপরিহার্য। আল্লাহতায়ালা বলেন, এবং পৃথিবীতে অনর্থ সৃষ্টি করতে প্রয়াসী হয়ো না। নিশ্চয়ই আল্লাহতায়ালা অনর্থ সৃষ্টিকারীদের পছন্দ করেন না।’ -সূরা কাসাস: ৭৭

সাংবাদিকের পুরস্কার
যারা অনেক পরিশ্রম করে দেশের স্বার্থে অমানতের সঙ্গে দূর-দূরান্ত থেকে সংবাদ আহরণ করে তাদের জন্য রয়েছে বিশাল পুরস্কার। হজরত হুযায়ফা (রা.)-এর ঘটনা থেকে এমনটিই ফুটে উঠে। হজরত ইবরাহিম তাইমি তার বাবা থেকে বর্ণনা করেন, তিনি বলেন আমরা হুযায়ফাহ (রা.)-এর কাছে ছিলাম। তখন এক ব্যক্তি বলে উঠল। হায়, আমি যদি রাসূলুল্লাহ (সা.) কে পেতাম, তবে তার সঙ্গে মিলে একত্রে যুদ্ধ করতাম এবং তাতে কোনোরূপ পিছপা হতাম না। হজরত হুযায়ফাহ (রা.) বললেন, হয়তো তুমি তা করতে, কিন্তু আমি তো আহজাবের রাতে রাসূলুল্লাহ (সা.)-এর সঙ্গে ছিলাম (সে রাতে) প্রচণ্ড বায়ু ও তীব্র শীত আমাদের কাবু করে ফেলেছিল। এমনি সময় রাসূলুল্লাহ (সা.) ঘোষণা করলেন, ওহে! এমন কেউ আছে কি যে আমাকে শত্রুর খবর এনে দেবে, আল্লাহতায়ালা তাকে কিয়ামতের দিন আমার সঙ্গে (মর্যাদার আসনে) রাখবেন। আমরা তখন চুপ করে রইলাম এবং আমাদের মধ্যে কেউ তার সে আহ্বানে সাড়া দেয়নি। এভাবে তিনি তিনবার বললেন এবং সবাই চুপ রইল। তারপর তিনি বললেন, হে হুযাইফা! ওঠো এবং তুমি শত্রুদের খবরাদি আমাকে এনে দাও। হজরত রাসূলুল্লাহ (সা.) যখন এবার আমার নাম ধরেই ডাক দিলেন, তাই উঠা ছাড়া আমার আর কোনো উপায় ছিল না। এবার তিনি বললেন, শত্রুপক্ষের খবর আমাকে এনে দাও, কিন্তু সাবধান, তাদের আমার বিরুদ্ধে উত্তেজিত করো না। আমি ফিরে আসলাম এবং ফিরে আসার সময়ও উষ্ণতা অনুভব করলাম। প্রতিপক্ষের খবর তাকে দিলাম। আমার দায়িত্ব পালন করে অবসর হতেই আবার আমি শীতের তীব্রতা অনুভব করলাম। তখন হজরত রাসূলুল্লাহ (সা.) তার অতিরিক্ত একটি কম্বল দিয়ে আমাকে আবৃত করে দিলেন, যা তিনি সাধারণতঃ নামাজ আদায়ের সময় গায়ে দিতেন। তারপর আমি ভোর পর্যন্ত একটানা নিদ্রায় বিভোর রইলাম। যখন ভোর হলো- তখন তিনি বললেন, হে গভীর নিদ্রামগ্ন! এখন উঠে পড়ো। -সহিহ মুসলিম: ১৭৮৮ (সংক্ষেপিত)

হাদিসে রাসূল (সা.) সত্য সংবাদ দাতাকে কিয়ামতের দিন তার সঙ্গে থাকার সুসংবাদ দিয়েছেন। তাই যে সাংবাদিক বস্তুনিষ্ঠ সংবাদ পরিবেশন করবে তার জন্য রয়েছে এই সুসংবাদ।

মুফতি জাওয়াদ তাহের: সিনিয়র শিক্ষক, জামিয়া বাবুস সালাম, বিমানবন্দর, ঢাকা-১২৩০