কোরবানির পশুকে কষ্ট দেবেন না
ইসলামের বিধি-বিধান সব কিছু সুবিন্যস্ত, বিস্তৃত। শাশ্বত ও চিরন্তন এ ধর্মে মানবজীবনের সব দিক আলোচিত হয়েছে। অন্যান্য প্রাণীদের প্রসঙ্গও এ ধর্মে অবহেলিত হয়নি। এগুলোর ব্যাপারেও রয়েছে ইসলামের সুস্পষ্ট বিধান। তাদেরও রয়েছে আমাদের মতো অধিকার।
পবিত্র কোরআনে পশুপাখির মর্যাদা এবং মানবসমাজে তাদের অবস্থান সুস্পষ্ট করে বলে দেওয়া হয়েছে। আল্লাহতায়ালা বলেন, ‘আর চতুষ্পদ জন্তুগুলো তিনি তোমাদের জন্য সৃষ্টি করেছেন, তাতে রয়েছে উষ্ণতার উপকরণ ও বিবিধ উপকার। তা থেকে তোমরা আহার গ্রহণ করো। তোমাদের জন্য তাতে রয়েছে সৌন্দর্য, যখন সন্ধ্যায় তা ফিরিয়ে আনো এবং সকালে চারণে নিয়ে যাও। এগুলো তোমাদের বোঝা বহন করে এমন দেশে নিয়ে যায়, ভীষণ কষ্ট ছাড়া যেখানে তোমরা পৌঁছাতে সক্ষম হতে না। তোমাদের পালনকর্তা অনুগ্রহশীল, পরম দয়ালু।’ -সূরা নাহল: ৫-৭
সামনে মুসলমানদের ধর্মীয় উৎসব কোরবারির ঈদ। ধর্মপ্রাণ মুসলমানরা কোরবানির মাধ্যমে আল্লাহর নৈকট্য হাসিলের চেষ্টা করে। একে ঘিরে তৈরি হয় পুরো মুসলিম বিশ্বময় এক ধরণের আমেজ ও আবহ। কিন্তু পরিতাপের বিষয় হচ্ছে, এ মহান কাজটি করতে গিয়ে ইচ্ছায়-অনিচ্ছায় কিছু অন্যায় করে ফেলি। কোরবানির পশু পরিবহন থেকে নিয়ে জবেহ পর্যন্ত অমানবিক কিছু আচরণ করি যার কারণে অর্থহীন হয়ে যেতে পারে আমাদের কোরবানি। এই প্রাণীগুলো আমাদের মতই একটি জাতি। এক আয়াতে আল্লাহতায়ালা প্রাণী সম্পর্কে বলেন, ‘ভূপৃষ্ঠে বিচরণশীল প্রত্যেকটি জীব এবং (বায়ুমন্ডলে) নিজ ডানার সাহায্যে উড়ন্ত প্রত্যেকটি পাখি তোমাদের মতোই একেকটি জাতি।’ –সূরা আনআম: ৩৮
আমাদের দেশে কোরবানির পূর্বে সচরাচর একটি চিত্র দেখা যায়, অনেক দূর-দূরান্ত থেকে ট্রাকে করে গরু বহন করে নিয়ে আসা হয়। বিশ থেকে বাইশ ঘন্টা পর্যন্ত একনাগারে নিরীহ পশুগুলো দাঁড়িয়ে থাকে। অল্প জায়গায় অধিক পশু নেওয়ার জন্য তারা এমনভাবে পশুকে দাঁড় করিয়ে রাখে যেন পশুগুলো বসতে না পারে, মাঝখানে বাঁশ দিয়ে দেয় যাতে কোনোক্রমেই বসতে না পারে। এ চিত্র আমাদের সমাজে সচরাচর। পশুগুলো কষ্টের তাড়নায় তাদের চোখ বেয়ে অশ্রু ঝরতে থাকে, কিন্তু আমরা মানুষ হয়েও তাদের এই কষ্টগুলো বুঝি না। অথচ ইসলামে পশুপাখির সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ অধিকার হলো- তাদের কোনো ধরনের কষ্ট না দেওয়া। হজরত জাবির (রা.) বর্ণনা করেন, দয়ার নবী (সা.) একবার মুখে আঘাতের চিহ্ন আছে এমন এক গাধার পিঠে চড়ে কোথায় যাচ্ছিলেন। তিনি বললেন, ‘গাধাটিকে আঘাত করে যে চিহ্নিত করেছে, তার ওপর আল্লাহর অভিশাপ।’ –সহিহ মুসলিম: ৭১১২
অন্য হাদিসে এসেছে সাহল ইবনুল হানজালিয়াহ বলেন, চলার পথে একবার হজরত রাসূলুল্লাহ (সা.) প্রচণ্ড ক্ষুধার্ত একটি উট দেখতে পান। তখন তিনি বলেন, ‘এসব ভাষাহীন পশুর ব্যাপারে আল্লাহকে ভয় করো। উত্তমভাবে এতে আরোহণ করো। উত্তমভাবেই মাংস ভক্ষণ করো।’ –সুনানে আবু দাউদ: ২৫৪৮
ইসলাম আমাদের প্রতিটি বিষয় এত সুন্দর করে বুঝিয়ে দিয়েছেন যা অন্য কেউ দিতে পারেনি। মানুষকে অমানবিকভাবে কেউ কষ্ট দিলে মানুষটার যে কষ্ট হয়, একটা পশুরও তাই হয়। মৃত্যু বা ব্যথা পাওয়ার ভয় যেমন মানুষের আছে, তেমন পশুরও আছে। যেমন আমরা গরু, ছাগল ও ঘোড়া ইত্যাদি পালন করতে গিয়ে লাঠি, বেত কিংবা চাবুক ব্যবহার করে থাকি। এতে বুঝা যায়, ব্যথা বা আঘাতের অনুভূতিটা একটা মানুষ আর পশুর মধ্যে সমান। আল্লাহ আপনাকে এর মালিক বানিয়েছে তাই তার সঙ্গে যাচ্ছে-তাই করবেন এই অনুমোদন শরিয়ত প্রদান করে না।
এক ধরণের প্রতারক ব্যবসায়ী পশুকে মোটাতাজা করার জন্য বিভিন্ন ধরণের ওষুধ সেবন করায়। অবার পশুকে বাজারে নেওয়ার পূর্বে জোর করে পানি ও অন্যান্য খাবার খাওয়ায়। এই বেশি লাভের মোহে নিরীহ ‘বোবা প্রাণী’কে কষ্ট দেওয়া বা মৃত্যুঝুঁকিতে ঠেলে দেওয়া নৈতিক ও ধর্মীয় দৃষ্টিতে বর্জনীয়, যা সম্পূর্ণ হারাম। পাশাপাশি এটা এক ধরণের প্রতারণা। হজরত রাসূলুল্লাহ (সা.) বলেছেন, নিজে ক্ষতিগ্রস্ত হওয়া এবং অন্যকে ক্ষতি করা কোনোটাই উচিত নয়। ধোঁকা, প্রতারণা ও ফাঁকিবাজি, ইসলামে মানবাধিকার লঙ্ঘন হিসেবে চিহ্নিত। কোনো মুসলমান সত্যের সঙ্গে মিথ্যার সংমিশ্রণ করতে পারে না। কোরআন শরিফে উল্লেখ রয়েছে, ‘হে মুমিনগণ! তোমরা সত্যের সঙ্গে অসত্যের মিশ্রণ ঘটাবে না। জেনেশুনে সত্য গোপন করো না।’ -সূরা বাকারা: ৪২
ব্যবসায়-বাণিজ্য তথা জীবনের প্রতিটি ক্ষেত্রে সততা রক্ষা করে চলা ফরজ। মন্দ জিনিস ভালো বলে চালিয়ে দেওয়া, ভালোর সঙ্গে মন্দের মিশ্রণ ঘটিয়ে ধোঁকা দেওয়া প্রতারণা। এ ধরনের প্রতারণার বিরুদ্ধে হাদিস শরিফে পরিষ্কার ঘোষণা, ‘যে ব্যক্তি ব্যবসা-বাণিজ্যে প্রতারণা করে, পণ্যে ভেজাল মেশায় সে আমার দলভুক্ত নয়।’ –সহিহ মুসলিম: ১০২
তেমনি জবাই করার সময় কষ্ট দেওয়া যাবে না। পশুপাখির প্রতি ইসলাম সর্বোচ্চ দয়া প্রদর্শন করেছে। এগুলোর প্রতি সদাচার করা এবং কষ্টানুভূতিকে সম্মান জানানো আবশ্যক। এ আদর্শের বাস্তবায়নে হজরত রাসূলুল্লাহ (সা.) পশুপাখি জবাই করার সময় কষ্ট দিতে নিষেধ করেন। জবাই করার জন্য টেনে-হেঁচড়ে নিয়ে শারীরিক কষ্ট দেওয়া যাবে না। জবাইয়ের দা-ছুরি ভোঁতা থাকলে হবে না। ছুরি-চাকু দেখিয়ে মানসিক কষ্ট দেওয়া যাবে না। এসবের কারণে তারা মৃত্যুর চেয়ে বেশি কষ্ট পায়।
শাদ্দাদ ইবনে আউস বলেন, হজর রাসূলুল্লাহ (সা.)-এর কাছ থেকে আমি দু’টি কথা শিখেছি। তিনি বলেন, ‘প্রত্যেক বস্তুর প্রতি দয়া প্রদর্শন করা আল্লাহতায়ালা আবশ্যক করেছেন। তাই কোনো জন্তু হত্যা করতে হলে উত্তমপন্থা গ্রহণ করো। জবাই করতে হলে উত্তমভাবে জবাই করো। ছুরি-চাকু ধারালো করো। জবাই করা পশুর জন্য সহজ করো।’ –সহিহ মুসলিম: ১৯৫৫
আরেক হাদিসে এসেছে, হজরত আবদুল্লাহ ইবনে আব্বাস বর্ণনা করেন, এক লোক একটি ভেড়া জবাই করার জন্য মাটিতে শোয়ায়। এরপর সে চাকুতে ধার দিতে শুরু করে। তা দেখে নবী করিম (সা.) বললেন, ‘তুমি কি তাকে কয়েকবার মারতে চাও? শোয়ানোর আগে কেন চাকু ধারাতে পারলে না? –আত তারগিব ওয়াত তারহিব: ২২৬৫
চমড়া ছাড়ানোর জন্য পশু জবাইয়ের পর তার প্রাণ বের হওয়া পর্যন্ত অপেক্ষা করা। প্রাণ থাকতে তার চামড়া ছাড়িয়ে কষ্ট না দেওয়া। জবাইয়ের পর পশুর শরীর থেকে রক্ত বের হয়ে যাওয়ার জন্য পর্যাপ্ত সময় দেওয়া। পশুর দেহের প্রাণস্পন্দন একেবারে থেমে যাওয়ার পর চামড়া ছাড়ানো শুরু করা। নিস্তেজ হওয়ার আগে চামড়া খসানো বা অন্য কোনো অঙ্গ কাটা মাকরূহ। -আল ইখতেয়ার: ৫/১২
মুফতি জাওয়াদ তাহের: সিনিয়র মুদাররিস, জামিয়া বাবুস সালাম, বিমানবন্দর, ঢাকা- ১২৩০