ব্রিটিশ আমলে কলকাতায় 'ভোট' ছিল 'খেলা'!

  • মায়াবতী মৃন্ময়ী, কন্ট্রিবিউটিং করেসপন্ডেন্ট, বার্তা২৪.কম
  • |
  • Font increase
  • Font Decrease

কলকাতায় ব্রিটিশ আমলের স্থাপনা।

কলকাতায় ব্রিটিশ আমলের স্থাপনা।

কলকাতা পৌরসভায় ভোটপর্ব সম্পন্ন হয়েছে। এখন ১৪৪ ওয়ার্ডে ফল প্রকাশের অপেক্ষা এখন। কিছুদিন আগেই কলকাতাসহ পুরো পশ্চিমবঙ্গে বিধানসভা ভোট হয়েছে। সামনেও নানা পর্যায়ের ভোট আসবে। কিন্তু ঔপনিবেশিক শাসকদের হাতে তৈরি শহর কলকাতার লোকজন ব্রিটিশ আমলে ভোট ব্যাপারটা শুনেছিলেন বটে, কিন্তু প্রথমে তার মর্ম অনুধাবণ করতে পারেন নি। ব্রিটিশ সাহেবদের ক্রিকেট খেলার মত এও এক খেলা বলে ভাবতেন মানুষ!

উনিশ শতকের মাঝামাঝি সময় থেকে গণতন্ত্র আর ভোটদানের মাধ্যমে নিজেদের ক্ষমতার প্রয়োগের ধারণা দেশীয় বুদ্ধিজীবীরা বুঝতে পারেন এবং জনগণকে বোঝাতে শুরু করেন। পরে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির কাছ থেকে খোদ মহারানী ভিক্টোরিয়া ভারতের শাসনভার নেবার পরে দেশ চালনার জন্য নির্দিষ্ট নিয়মকানুনের সঙ্গে ভোটাধিকারও বলবৎ হল। তখন থেকেই একটা ছিল নির্দিষ্ট সময় অন্তর ভোটগ্রহণের সূচনা হয়।

বিজ্ঞাপন

কলকাতা শহরে এই ভোট প্রথমে একমাত্র শাসক ইংরেজরাই দিতে পারতেন। কিন্তু নেটিভদের ক্রমাগত চাপে ১৮৭৪ সালে ইংরেজ সরকার পৌর আইন সংশোধন করে প্রথমবারের মতো ‘নেটিভ’ নাগরিকদের ভোটাধিকার দেয়। শুরু হয় নবগঠিত কলকাতা মিউনিসিপ্যাল করপোরেশনের নির্বাচনের তোড়জোড়। আর সেই প্রথম কলকাতার বাঙালি প্রথমবারের মত ভোটরঙ্গে অংশীদার হবার সুযোগ পায়।

প্রথমবারের সেই ভোট নিয়ে খবরের কাগজের শুকনো বিবরণ ছাড়া অন্য কিছু হয়তো জানাই যেত না, যদি না সেই বছরই বাংলায় দুটি আশ্চর্য পত্রিকা প্রকাশ পেত। একটির নাম ‘হরবোলা ভাঁড়’ ও অন্যটি ‘বসন্তক’। বিলাতী পাঞ্চ পত্রিকার অনুকরণে গড়ে ওঠা এই দুই পত্রিকার মূল রস ছিল ব্যাঙ্গ-বিদ্রুপ আর শ্লেষ। এককালে হুতোম যে নকশাধর্মী ফিচার লিখেছিলেন, একেবারে অবিকল তেমনই ঘরানায় পত্রিকাদুটি তাদের রচনা প্রকাশ করত।

বিজ্ঞাপন

শুরুতেই ‘এই অ্যাক নূতন’ বিষয় হিসেবে ভোটের অলীকরঙ্গে মেতে ওঠে তারা। ফলে একেবারে প্রথম ভোটেও ঠিক কী রকম পরিবেশ ছিল, তা ছবির মত পরিষ্কার। ১৮৭৪ সালের ডিসেম্বরে বসন্তকে প্রকাশিত ‘ইলেকশন’ নামে এক রচনায় প্রকাশ, "বেশিরভাগ মানুষের কোন ধারণাই নেই এই ভোট ব্যাপারটা ঠিক কী। তারা জনে জনে 'ভোট, ভোট কী মহাশয়?' জিজ্ঞাসা করিয়া বেড়াচ্ছে। মজা হয় ঠিক এর পরে। ভোট দেবেন কি না এই প্রশ্নে এক এক জন তাদের মত দেন।"

সেদিনের মতের সঙ্গে আজকের জনমানসের মতের খুব বেশি তফাৎ নেই। যেমন, “তিনি শুনিয়া কহিলেন, ‘আমি বিবেচনা করিব, এর পর যাহা হয় দেখা যাবে।’ অন্য আর একজনকে জিজ্ঞাসা করিলাম, তিনি উত্তর করিলেন ‘আমি ভোট দিব না, একজনও উপযুক্ত ব্যক্তি নহেন।’ অন্য লোকদিগকে জিজ্ঞাসা করিলাম, কেহ বলিলেন, 'ওহে ঠাকুর! ঘরের খেয়ে বনের মোষ তাড়াবে কেন? ঘরে গিয়ে হরিনাম করগে, পরকালের কায হবে।”

মজার ব্যাপার হলো, ভোটের জন্য প্রার্থীদের দুয়ারে দুয়ারে হত্যে দিয়ে পড়ে থাকা, মিথ্যে প্রতিশ্রুতির বান ডাকানো, এসবেরও শুরু কিন্তু সেই প্রথম ভোট থেকেই। বসন্তকের ১২ সংখ্যায় অদ্ভুত এক কার্টুন প্রকাশিত হয়, যার শিরোনামে লেখা ছিল ‘আমাদের গৌরে মুদি সবে বাটীটির দ্বারটি খুলিয়া কী দেখিলেন।’ ছবিতে খাটো ধুতি, খালি গায়ে টিকিওয়ালা গৌরে মুদি দেখছেন, তার বাড়ির দরজায় হত্যে দিয়ে পড়ে আছেন মান্যগণ্য ভোটপ্রার্থীরা। প্রত্যেকের হাতে নির্বাচনী প্রতিশ্রুতির অ্যাজেন্ডা। আর ভোটের দিন! সেদিন তো মহা রঙ্গ। ‘বৈকালে সংবাদ পাইলাম, যে মহা হুলস্থুল লাগিয়াছে, যাহারা এত দিন অভিমান করিয়া আসরে নাবেন নাই, তাহারা সকলে নাবিয়া কিসে ভোট পাওয়া যায়, ইহারই চেষ্টা করিতেছেন। কোনো স্থলে হুড়াহুড়ি, কোনো স্থলে মারামারি অবধি হইতেছে। কি সর্ব্বনাশ!
কমিশনার হবার লোভ বড় বালাই। তখন আর সযত্নে লালিত জাতপাতের বালাই থাকে না। উচ্চ বর্ণের বাবুও বুঝে যান তিলি বা জেলের ভোটটাও বামুনের ভোটের মতই জরুরি!

বেশ কিছুদিন পরে ১৮৯২ সালের পুরসভা ভোটের আগে ‘জন্মভূমি’ পত্রিকায় এক কৌতুক নকশা ছাপা হয়। তাতে তৈলিক ভবনে গিয়েছেন ভোটপ্রার্থী। তিনি মান্যগণ্য লোক। ভিক্ষা চাইছেন তিলির কাছে— ‘পাত্র মিত্র সঙ্গে করে যায় বাবু কলু-ঘরে/ গিয়ে পড়ে কলুর চরণে,/ দোহাই তোমার লাগে ভোট দাও আগে ভাগে/ কহি শুন কাতর বচনে”। তবে বাবু জানেন শুধু চোখের জলে মন ভেজানো মুশকিল। তাই জেলের বাড়ি গিয়ে তিনি সরাসরি লোভ দেখালেন। প্রতিশ্রুতি দিলেন ভোট দিলে তিনি তার কাছ থেকেই নগদ টাকায় কুড়ি মণ মাছ কিনে নেবেন: ‘ভোট দিয়া কিনে লও, জনম মতন।/পিতৃ-শ্রাদ্ধে বিশ মণ, মাছের বায়না।/লও মূল্য, গণি এবে, টাকা-পাই-আনা।’

পত্রিকায় ছড়ার সঙ্গে ছবিও ছাপা ছিল। ছবির পরিচয়ে লেখা আছে ‘পোলিং চক্র’। ছবিটি মারাত্মক। তাতে ভোটারকে চেয়ারে বসিয়ে দুইজন তার হাত টেনে ধরেছেন আর দুইজন পা। চশমা চোখে এক ব্যক্তি প্রায় জোর করেই তাকে মদ খাইয়ে নেশাগ্রস্ত করে তার ভোট পেতে উদ্যত। যাদের এই নেশাতেও কাজ দিত না তাদের জন্য থাকত দিব্যির ভয়। যেমন, “সবার ভোট কাড়িয়ে লইয়া আমাকে দিবে। কারণ আমি সর্বদলভূক্ত সবলোট (সাব লাটসাহেব)। ইহার কোন ব্যাতিক্রম করিবেন না, করিবেন না, করিবেন না, মাতার দিব্য! জগন্নাথক্ষেত্রের সুভদ্রার দিব্য! কালীঘাটের হালদারদের দিব্য! আর বাগবাজারের মদনমোহন খোলার ঘরের দিব্য!”

অর্থাৎ কলকাতা তথা বঙ্গদেশে ভোট দেওয়ার শুরুর আমল থেকেই ভোটারদের প্রভাবিত করার চর্চা শুরু হয়েছিল। তবে, কালে কালে তা আরও পুষ্ট এবং শক্তিশালী হয়েছে। ক্ষেত্র বিশেষে সহিংসতা, পেশী ও কালো টাকা ভর করেছে। পদ্ধতি ও পন্থার বদল হলেও ভোটের ক্ষেত্রে ছলে,বলে, কলে, কৌশলে ভোটারদের কব্জা করার ধারা কিংবা অপধারা অব্যাহতই রয়েছে!