একুশের নতুন চেতনা
‘সোনার কেল্লা’ চলচ্চিত্রে ফেলুদার যোধপুর যাওয়ার পথে জটায়ুর সাথে আলাপের দৃশ্যটি মনে আছে? সংলাপগুলি খানিকটা এরকম ছিল-
"তো আপ কাহা তক যা রহে হ্যায়?
-যোধপুর।
“ম্যায় ভি যোধপুর জা রহা হু। রাজস্থান কা পটভূমিকামে এক কাহানি লিখনা চাহতা হু। রহস্য-রোমাঞ্চ কাহানি। অব তক সাত্তাইশ কাহানি লিখি হ্যায়। অল পাবলিশড। ইয়ে হ্যায় মেরা সাম্প্রতিকতম্ উপন্যিয়াস। দুর্ধষ দুশমন। আপ ক্যায়া বাংলা পড়নে জানতে হো?”
-হাঁ। বোলনা ভি জানতা হু।
“তো কাহা শিখে?”
-কলকাত্তা। আপনি হিন্দি চালিয়ে যেতে পারেন। বেশ লাগছে।
“আরে দুররররর মশাই। আমি গড়পারের লোক। হিন্দি কি কেউ সাধে বলে নাকি?"
শৈশবের নিছক হাসিখেলার অনুভূতির মধ্যে দিয়ে এই দৃশ্য আমরা বয়ে বেড়াচ্ছি আজীবন। কখনো তা রূঢ় বাস্তবের জমিতে অবস্থান করেও। আপোষ করে বদলে ফেলছি কথা বলার চলন। বলতে বলতে শিখতে চাইছি বদলে যাওয়া ভাষার নতুন কোনো এক কাঠামো যা ক্রমশ ভুলিয়ে দেবে আমাদের স্মৃতি সত্তা এবং ভবিষ্যৎ। তবে কি লড়াইটা শুধুই ভাষার আগ্রাসনের বিরুদ্ধে?
শ্রদ্ধেয় শঙ্খ ঘোষ লিখেছিলেন,- ‘বাংলাদেশ একদিন গান বেঁধেছিল ‘ওরা আমার মুখের ভাষা কাইড়্যা নিতে চায়’। অলক্ষে আমাদেরও মুখের ভাষা কেড়ে নিচ্ছে কেউ, সেকথা যদি কিছুটা উপলব্ধি করি, এবং আমাদের সামান্যতম চেষ্টাকেও তার প্রতিরোধে যদি নিযুক্ত করি, একমাত্র তখনই একুশে ফেব্রুয়ারির মতো কোনো প্রতীকদিন-উদযাপন করবার তাৎপর্য দেখা দিতে পারে। তার অভাবে, সবটাই হয়ে উঠবে নিছক অলঙ্কার’।
কবি শব্দের জন্ম দেন যা একদিন চেতনা হয়ে উঠবে। অশ্বত্থ আর বট পাকুরের গায়ে চিহ্নিত ইতিহাসের বলিরেখা মুছে দেবে দেশ কালের বেড়াজাল। কেউ দেখাবে পথ। কেউ চলবো হাতে হাত রেখে।
আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবসে এমনই কিছু শব্দের অনুরণন ধ্বনিত হতে শোনা গেল কলকাতার দমদম মতিঝিল কলেজে। কলেজের অধ্যাপিকা ড. ময়ূরাক্ষী গঙ্গোপাধ্যায়ের উদ্যোগে অধ্যক্ষ, ছাত্র ছাত্রী, অধ্যাপক এবং সকল কর্মীরা আরও একবার শপথ নিলেন মাতৃভাষার পক্ষে। তবু শপথ ভুলে গেছে যুদ্ধক্ষেত্র। ভাষা এবং শব্দ দানবের হাহাকারে জর্জরিত প্রদেশ থেকে তাই এবারের ডাক নতুন চেতনার প্রতি। অধ্যাপিকা গঙ্গোপাধ্যায়ের ভাষায়,- ‘একুশে ফেব্রুয়ারির রক্তাক্ত সংগ্রাম এবং মাতৃ-ভাষার প্রতি ভালবাসা ও দায়বদ্ধতাকে স্মরণে রেখে আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস পালন করা উচিত। এর মধ্যে দিয়েই শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বৃহত্তর সমাজের কাছে একাধারে মাতৃভাষা ব্যবহারের প্রতি দৃষ্টি আকর্ষণ করতে সমর্থ হবে তেমনি ভাষা আগ্রাসনের প্রতি সচেতনতা বৃদ্ধির মধ্যে দিয়ে আমাদের ছাত্র-ছাত্রীরা অন্য ভাষার প্রতি শ্রদ্ধা জানাতে শিখবে। ব্যক্তিগত ভাবে আমার মনে হয়, ভাষা দিবস পালনের মধ্যে দিয়ে ভাষা ব্যবহার এবং কথার বলার অধিকার সম্পর্কিত গনচেতনার ইতিহাসের সাথে বর্তমান প্রজন্মের পরিচিত হওয়া প্রয়োজন। এই চেতনা তাদের সার্বিক বিকাশের পক্ষে গুরুত্বপূর্ণ’।
একুশ জানে না মাথা নত করতে। একুশের রক্তাক্ত ইতিহাস ব্যক্তিগত চেতনার মাধ্যমে পৌঁছে যাক সমষ্টির অবচেতনে, কোনো এক নতুন একুশের দিকে। একটা মুক্ত এবং সুন্দর পৃথিবীর অপেক্ষায় আমরা।