শহীদ বুদ্ধিজীবীর বোনের সাথে পপুলার ডায়াগনস্টিকের বর্বর আচরণ

  • স্টাফ করেসপন্ডেন্ট, বার্তা২৪.কম, ঢাকা
  • |
  • Font increase
  • Font Decrease

ছবি: সংগৃহীত

ছবি: সংগৃহীত

পেশাগত নৈতিকতা ও বিধিনিষেধের তোয়াক্কা না করে স্রেফ ব্যবসায়িক মুনাফার লোভে রাজধানীর শীর্ষ ক্লিনিক ও ডায়াগনস্টিক কেন্দ্রগুলোতে এক শ্রেণীর বিবেক বর্জিত চিকিৎসক ও স্বাস্থ্যকর্মী অসহায় রোগীদের জিম্মি করে অর্থ উপার্জনের বেপরোয়া খেলায় মেতেছে। এর বিরুদ্ধে প্রতিকার চাইতে গেলে সুরাহার পরিবর্তে মিলছে দায়সারা ব্যাখ্যা ও পাল্টা হুমকি।

অনুসন্ধানে জানা গেছে, এন্ডোস্কপির মতো সংবেদনশীল পরীক্ষার ক্ষেত্রে রোগীদের কাছ থেকে লিখিত সম্মতিপত্র পাওয়ার বাধ্যবাধকতা থাকলেও এক শ্রেণীর ক্লিনিকে এসবের তোয়াক্কা না করে ‘ধর তক্তা মার পেরেক’ পদ্ধতিতে রোগীদের জোর করে শুইয়ে দেয়া হয় পরীক্ষার টেবিলে। অযত্ন আর তাড়াহুড়োর মধ্যে নাম-কা-ওয়াস্তে পরীক্ষা করিয়ে বের করে দেয়া হয় তাদের।
সম্প্রতি গত ২১ অক্টোবর এ জাতীয় একটি ঘটনার অভিযোগ করেন শহীদ বুদ্ধিজীবী জহির রায়হান ও শহীদুল্লাহ কায়সারের বোন বর্তমানে যুক্তরাষ্ট্র প্রবাসী শিক্ষক ও সমাজকর্মী ৭৫ বছর বয়সী শাহেনশাহ বেগম। অশ্রুবিজড়িত কণ্ঠে নিজের ভয়ানক অভিজ্ঞতার বিবরণ দিয়ে তিনি আক্ষেপ জানিয়ে বলেন, শিক্ষিত মানুষের সাথেই যখন নির্বিবাদে এ জাতীয় আচরণ করা হচ্ছে, তখন না জানি কি ভয়াবহ অভিজ্ঞতার মধ্য দিয়ে প্রতিনিয়ত যেতে হচ্ছে এ দেশের শিক্ষা বঞ্চিত অসহায় মানুষগুলোকে।

বিজ্ঞাপন

জানা গেছে, রাজধানীর শীর্ষ চিকিৎসাকেন্দ্র পপুলার ডায়াগনস্টিক সেন্টারের চিকিৎসক ডা. আমিনুল হকের কাছে চিকিৎসাধীন থাকা অবস্থায় ডাক্তার শাহেনশাহ বেগমকে এন্ডোস্কপি করার নির্দেশ দেন। সে মতে ওইদিন সকালে তিনি শান্তিনগরে ডায়াগনস্টিক সেন্টারে গেলে সেখানে কর্তব্যরত ডাক্তার ও অ্যাটেন্ড্যান্টদের চরম দুর্ব্যবহারের মুখে পড়েন তিনি।

নিয়ম অনুযায়ী বয়ষ্ক মানুষের ক্ষেত্রে যারা অতি সংবেদনশীল তাদের হাল্কা তন্দ্রাচ্ছন্ন করে ও আলগা দাঁত খুলে এই পরীক্ষাটি করানোর কথা। পাশাপাশি, চিকিৎসকের দায়িত্ব পরীক্ষাটি করানোর আগে রোগীকে গোটা প্রক্রিয়াটি সম্পর্কে অবহিত করা ও তার সম্মতি নেয়া। অথচ সেবা বিধির তোয়াক্কা না করে, রোগীর পূর্বাপর ইতিহাস না জেনে, তার অনুমতি না নিয়েই ক্লিনিকের কর্মীরা হৃদযন্ত্র ও চোয়ালের জটিলতায় ভুগতে থাকা বয়োবৃদ্ধ এই রোগীকে টানাহেঁচড়া করে এন্ডোস্কোপির টেবিলে শুইয়ে দেন। নেননি কোনো লিখিত সম্মতিপত্র। এমনকি চিকিৎসা বিধিমালায় নারী রোগীদের ক্ষেত্রে একজন স্বজনের সেখানে উপস্থিত রাখার বিধান থাকলেও সেখানে দায়িত্বে থাকা ডা. ফয়েজ আহমেদ খন্দকার ও তার সহযোগী ওই কর্মীরা উল্টো রোগীর স্বজনকে ধমক দিয়ে রুম থেকে বের করে দেন। এরপর কোনো ধরনের অ্যানেস্থেশিয়া ছাড়াই জোরপূর্বক তাকে দুই হাত ও দুই পা শক্তভাবে চেপে ধরে মুখের মধ্যে এন্ডোস্কোপির নল ঢুকিয়ে দেয়া হয় এবং খাদ্যনালীর মধ্যে প্রবেশ করানো হয়। এ সময় মুখগহ্বরে আলগা দাঁত ও দেহের অভ্যন্তরে নাজুক অঙ্গপ্রত্যঙ্গের মধ্য দিয়ে বেপরোয়া নল চালনার কারণে তীব্র যন্ত্রণায় রোগী আর্তনাদ করতে থাকলেও বিন্দুমাত্র তোয়াক্কা করেনি কিংবা তাকে ছাড় দেয়নি ‘অর্থলিপ্সু’ এসব ‘নামধারী’ স্বাস্থ্যকর্মী।

বিজ্ঞাপন

এ বিষয়ে পরবর্তীতে শাহেনশাহ বেগম তার চিকিৎসক পপুলার সেন্টারে ডা. আমিনুল হকের কাছে অভিযোগ জানাতে গেলে তিনি প্রতিকারের বদলে উল্টো তাকে বলেন, এশিয়া সাবকন্টিনেন্টেই কোথাও জেনারেল অ্যানেস্থেশিয়া দিয়ে এন্ডোস্কপি করা হয় না। এই ম্যানুয়াল পদ্ধতিতেই এন্ডোস্কোপি করা হয়ে থাকে। এখানে এটাই নিয়ম।

এন্ডোস্কপি জাতীয় পরীক্ষা করানোর ক্ষেত্রে রোগীর সম্মতি প্রদানের অধিকারের কথা জানতে চাইলে দীর্ঘদিনের পেশাগত চর্চায় অভিজ্ঞ এ চিকিৎসক বিস্ময়করভাবে জানান, এ ধরনের কোনো বিধির কথা জানা নেই তার। উপরন্তু তিনি তার রোগীকে ধমক দিয়ে বলেন, চল্লিশ জন রোগী দেখতে হবে তাকে। অতএব এ জাতীয় ফালতু বিষয়ে সময় নষ্ট করার মতো সময় নেই তার হাতে!
এ বিষয়ে প্রশাসনিক ম্যানেজারের কাছে অভিযোগ জানাতে বলার পর তার কক্ষের সামনে দীর্ঘসময় অপেক্ষায় থাকার পরও কাউকে পাওয়া যায়নি। পরবর্তীতে পারিবারিক চিকিৎসক ডা. রুবাইয়াত রহমান এ বিষয়ে সুস্পষ্ট ভাষায় জানান, এসব বিষয়ে বিশ্বস্বাস্থ্য সংস্থাসহ সরকার ও অন্যান্য তদারকি সংস্থার সুস্পষ্ট নির্দেশনা রয়েছে। একজন চিকিৎসক তার পেশাগত দায়িত্ব পালন শুরুর আগেই এসব বিষয়ে তাকে যথাযথ প্রশিক্ষিত করে তোলা হয় ও তা পালনের অঙ্গীকার করানো হয়। এ জাতীয় সংবেদনশীল পরীক্ষার অবশ্যই রোগীর কিংবা তার স্বজনের কাছ থেকে লিখিত সম্মতিপত্র নিতে হবে। এছাড়া, নারী রোগীর ক্ষেত্রে পরীক্ষা চলাকালীন বিধি অনুসারেই রোগীর একজন স্বজন সেখানে উপস্থিত থাকতে পারবেন।

জানা গেছে, এ জাতীয় পরীক্ষার ক্ষেত্রে ফি কমপক্ষে তিন হাজার টাকা হিসেবে ক্লিনিকের লোকগুলোর মূল লক্ষ্য থাকে। কম সময়ে যতো বেশি রোগীকে পরীক্ষা করিয়ে নেয়া যায় ততই লাভ। ফলে প্রশাসনের নাকের ডগায় বসে ও তাদের প্রশ্রয়ে বছরের পর বছর এ অনাচার চালিয়ে যেতে পারছে হাসপাতাল ব্যবসায়ীরা। এ বিষয়ে এখনই নজরদারি ও ব্যবস্থা না নিলে আগামী দিনে ওই ডাক্তারের নিজের স্বজনরাই যে অন্য কোথাও এ জাতীয় বর্বরতার মুখে পড়ে ভোগান্তির শিকার হবেন না, সে নিশ্চয়তাই বা কে দিতে পারে।