যশোরে টিউবওয়েল গুলোতে পানি নাই, জনদুর্ভোগ চরমে
যশোরে ভুস্তরের পানির সংকট দেখা দিয়েছে। অস্বাভাবিক ভাবে নিচে নেমে গেছে পানির স্তর। ইতোমধ্যে অনেক টিউবওয়েলে পানি উঠা বন্ধ হয়ে গেছে। আর যেসব টিউবওয়েলে পানি উঠছে তার পরিমাণ খুবই কম।
সংশ্লিষ্টরা বলছেন, অপরিকল্পিতভাবে স্যালো দিয়ে পানি তোলা এবং যত্রতত্রভাবে পুকুর-খালবিল ভরাট হবার কারণে এই পরিস্থিতির সৃষ্টি হচ্ছে। সামনে বৃষ্টিপাত না হলে পরিস্থিতির আরও অবনতি হবে।
এদিকে যশোর শহরের বেজপাড়া এলাকার বাসিন্দা কামাল আহমদের বাড়ির টিউবওয়েলে একমাস ধরে পানি উঠছেনা।পাশের বাড়ির সাবমার্সিবল কল থেকে তিনি প্রতিদিন খাবার পানি সংগ্রহ করে থাকেন। পৌরসভার বারান্দিপাড়া এলাকার বাসিন্দা জাকির হোসেনও একই অভিযোগ করেন। তারা জানান, শুধূ নিজেদের টিউবওয়েলে পানি উঠছেনা। পৌরসভার সরবরাহকৃত কলেও পানি পাচ্ছিনা। বেশিরভাগ সময়ে পানি আসেনা।আবার আসলে গতি খুবই কম।শুধু ওই দুইজনের বাড়ির টিউবওয়েলে নয়, জেলার বেশিরভাগ টিউবওয়েলে পানি উঠছেনা। পানির জন্য চলছে হাহাকার।
এ ব্যাপারে যশোর বিএডিসির (সেচ) নির্বাহী প্রকৌশলী মো: মাহাবুব আলম জানান, জানুয়ারি মাস থেকে ভূগর্ভস্থ পানির স্তর নামতে শুরু করে।এপ্রিল মাসে পানির স্তর সর্বোচ্চ নিচে নেমে যায়। তবে এবার একটু আগেভাগেই মার্চ মাস থেকেই ভূগর্ভস্থ পানির স্তর নিচে নেমে গেছে। সাধারণত বছরে গড় বৃষ্টিপাত হয় ২০৩ সেন্টিমিটার। তুলনামূলক কম বৃষ্টিপাত হওয়ায় পানির স্তর নামছে।বর্তমানে পানির স্তর ২৬ ফুট ৯ ইঞ্চি নীচে নেমে গেছে। ২০২০ সালে ২৫ ফিটে নেমেছিল। একারণে টিউবওয়েলে পানি ওঠা বন্ধ হয়ে গেছে।
যশোর বিএডিসির (সেচ) তত্ত্বাবধায়ক প্রকৌশলী মো: আবদুল্লাহ আল রশিদ জানান, কৃষিকাজের সেচের কারণেও ভূগর্ভস্থ পানির স্তর নিচে নেমে যায়। এখন চলছে বোরো ধানের মৌসুম। ভূগর্ভ থেকে গভীর নলকূপ ও স্যালো মেশিনে অপরিকল্পিভাবে পানি উঠানো হয়। বৃষ্টি শুরু হলে পানির স্তর স্বাভাবিক হয়ে যাবে। তিনি জানান, সাধারণত পানির স্তর স্বাভাবিক থাকে ১৫ থেকে ২০ ফুটের মধ্যে।
বিএডিসি অফিস (সেচ) সূত্রে জানা যায়, জেলায় গভীর নলকূপের সংখ্যা এক হাজার ৫শ’ ৬৭টি। এসব নলকূপ দিয়ে ২৫ হাজার ২২৩ হেক্টর জমিতে পানি দেয়া হয়। অন্যদিকে স্যালো টিউবওয়েলের সংখ্যা ৬৩ হাজার ৭৯৩টি। এসব স্যালো টিউবওয়েল দিয়ে একলাখ ২৩ হাজার ৪শ’ ৮২ হেক্টর জমিতে পানি দেয়া হয়।
কর্মকর্তারা জানান, আমাদের দেশে বোরো ধান চাষের সময় অনেক পানি অপচয় হয়। এক কেজি ধান উৎপাদন করতে আমাদের দেশে পানি লাগে ৩ থেকে সাড়ে ৩ হাজার লিটার। উন্নত ধান উৎপাদনকারী দেশ থাইল্যান্ড ও ভিয়েতনামে এর অর্ধেক পানি খরচ হয়। এসব দেশে এক কেজি ধান উৎপাদন করতে পানি খরচ হয় এক থেকে দেড় হাজার লিটার। কৃষিকাজে উন্নত প্রযুক্তি ব্যবহার করে তারা পানি অপচয় রোধ করে। বারিড পাইপের মাধ্যমে মাটির নিচ থেকে থাইল্যান্ড ও ভিয়েতনামে জমিতে পানি দেয়া হয়। আমাদের দেশে জমিতে নালা কেটে পানি দেয়া হয়। ফলে অর্ধেক পানি মাটিতে চুষে নেয়। পানির অপচয় রোধ করতে ইতোমধ্যে বিএডিসির উদ্যোগে পরীক্ষামূলকভাবে যশোর জেলার বেশ কয়েকটি উপজেলায় উন্নত প্রযুক্তির বারিড পাইপের মাধ্যমে জমিতে পানি দেয়া হচ্ছে। এতে যেমন পানির অপচয় রোধ করা সম্ভব হচ্ছে, তেমনি জমিতে কম সময়ে দ্রুত পানি পৌঁছে যাচ্ছে। বোরো ধান চাষের কাজে অনেক পানি অপচয়ের ফলে প্রতিবছরে এসময় তীব্র খাবার পানির সংকট দেখা দেয়।
শার্শা উপজেলার শালকোণা গ্রামের সাহেব আলী জানান, বোরো ধান মূলত সেচনির্ভর। প্রচুর পানির প্রয়োজন হয়। বৃষ্টি না থাকায় পুরোটাই ডিজেল চালিত স্যালো দিয়ে ক্ষেতে পানি দিয়েছি। এতে বিঘায় ২ হাজার টাকার মত খরচ হয়ে থাকে। শুষ্ক মৌসুমে পানির সংকট রোধ করতে জনস্বাস্থ্য প্রকৌশল অধিদফতর যশোর অফিস জেলার বিভিন্ন অঞ্চলে কাজ করে যাচ্ছে। তারা শহর ও শহরতলীতে স্বল্পমূল্যে গভীর নলকূপ বসিয়ে খাবার পানি সংকট মোকাবিলার চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে।
জনস্বাস্থ্য প্রকৌশল অধিদফতর যশোরের নির্বাহী প্রকৌশলী মো: জাহিদ পারভেজ জানান, জেলায় আমাদের ১৯ হাজার ৭৯৬টি অগভীর নলকূপ রয়েছে। এখন পানির স্তর নেমে যাবার কারণে পানি কম উঠছে। আবার অনেক কলে পানি উঠছে না। যেসব এলাকায় পানির সংকট দেখা দেয়, ওইসব এলাকায় ৭ হাজার টাকার বিনিময়ে গভীর নলকূপ বসিয়ে খাবার পানিসহ গৃহস্থালির কাজে পানির ব্যবস্থা করা হয়। শুষ্ক মৌসুমে পানির সংকট মোকাবিলার জন্য গভীর নলকূপ বসিয়ে পানির সংকট মোকাবিলা করা হয়।
যশোর পৌরসভার সচিব মো: আজমল হোসেন জানান, তাদের অধীনে ২৩০টি হস্তচালিত নলকূপ ও ২৯টি গভীর নলকূপ রয়েছে। প্রতিদিন পানির চাহিদা রয়েছে ২ কোটি লিটার। যার সবটাই সরবরাহ করা হচ্ছে। তবে পানির স্তর নেমে যাবার কারণে অনেক কলে পানি উঠছেনা।বিশেষ করে বাড়ির কলে পানি পাওয়া যাচ্ছে না।তবে যশোর পৌরসভায় ডিজিটাল মিটার স্থাপন হবার কারণে কখন টাকা শেষ হয়ে যাচ্ছে বোঝা যাচ্ছে না। এতে অনেক সময় বিদ্যুৎ লাইন না থাকার কারণে গ্রাহকরা পানি পাচ্ছে না। বিষয়টি আমরা সমাধানের চেষ্টা করছি।
এ ব্যাপারে যশোর সরকারি মাইকেল মধুসূদন কলেজের (এমএম কলেজ) ভূগোল বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক ছোলজার রহমান জানান, প্রতিবছর অপরিকল্পিতভাবে পানি উঠানো হচ্ছে, সেই পরিমাণ পানি ভূগর্ভে পৌঁছাচ্ছে না। আবার বৃষ্টিপাত কম হচ্ছে প্রতিবছর। যেকারণে পানির স্তর নেমে যাচ্ছে। এটারোধ করা প্রয়োজন। কৃষি কাজে পরিকল্পিতভাবে পানির ব্যবহার করতে না পারলে সামনে পরিস্থিতির অবনতি হবে।