করোনায় অস্তিত্ব সংকটে তাঁতশিল্প
করোনার দ্বিতীয় ঢেউয়ে সংক্রমন রোধে সর্বাত্তক লকডাউনে টাঙ্গাইলের ঐতিহ্যবাহী তাঁতশিল্প অস্তিত্ব সংকটে পড়েছে। করোনার প্রথম ঢেউ এবং গেল বন্যায় ক্ষয়ক্ষতি কাটিয়ে উঠতে না উঠতেই করোনাভাইরাসের দ্বিতীয় ঢেউ শুরু হওয়ায় তাঁতশিল্পের মালিক শ্রমিক দিশেহারা।
বর্তমানে ক্ষতিগ্রস্ত প্রান্তিক তাঁতিদের একটি বড় অংশ জীবিকার প্রয়োজনে পৈত্রিক পেশা বদলাতে গিয়ে অনেক সময় খাপ খাওযাতে পারছেন না।
তাঁতশিল্পের সঙ্গে সরাসরি জড়িত তাঁত মালিক ও শ্রমিকরা জানায়, শাড়ি ব্যবসার জন্য পয়লা বৈশাখ, ঈদুল ফিতর, ঈদুল আযহা ও দুর্গাপুজা প্রধান মৌসুম। করোনার প্রথম ধাপ, গেল বছরের বন্যা, ঈদ, পুজা, পহেলা বৈশাখে শাড়ি তৈরি করেছিলেন। অথচ করোনার কারণে বিক্রি হয়নি সেগুলো মজুদ করে রেখেছিল। এবারও সেগুলো বিক্রি হচ্ছেনা।
ঈদুল ফিতর ও ঈদুল আযহার জন্য নতুন শাড়ি বানানো বা চাহিদা নিরূপন করা হয়নি। ঈদুল ফিতরে সবচেয়ে দামি শাড়ি তৈরি ও বেশি শাড়ি বিক্রি হয়।
চরহুগড়া গ্রামের তাঁত মালিক আছিরুদ্দীন আমাদের সময়কে বলেন, ‘স্বাভাবিক সময়ের তুলনায় লাভ-লোকসান তো পরের হিসাব এ শিল্পের অস্তিত্ব রক্ষা হবে কিনা তা নিয়েই আমরা শঙ্কিত। আমার বাপের সময় ৮০টি তাঁত ছিল গত দশ বছরে কমতে কমতে এখন আমাদের বাড়ীতে ১২টি তাঁত চালু আছে।’
বাংলাদেশ তাঁত বোর্ড (বাতাঁবো) সূত্রে জানা গেছে, টাঙ্গাইলের ঐতিহ্যবাহী তাঁত শিল্পের উন্নয়ন ও প্রসারের জন্য জেলার কালিহাতীর বল্লায় (ঘাটাইল, মধুপুর, ধনবাড়ী, গোপালপুর, কালিহাতী ও ভূঞাপুর উপজেলার জন্য একটি এবং সদর উপজেলার বাজিতপুরে দেলদুয়ার, বাসাইল, মির্জাপুর, নাগরপুর, সখীপুর ও সদর উপজেলার জন্য একটি) বাংলাদেশ তাঁত বোর্ডের দুইটি বেসিক সেণ্টার রয়েছে।
বাতাঁবো’র বাজিতপুর ও বল্লা এ দুইটি বেসিক সেণ্টারের নিয়ন্ত্রণে ৪৯টি প্রাথমিক তাঁতি সমিতি এবং ৪টি মাধ্যমিক তাঁতি সমিতি রয়েছে। এসব সমিতির চার হাজার ৩৯১টি তাঁত ফ্যাক্টরি মালিকের ২৭ হাজার ৯৩১টি তাঁত চালু বা সচল এবং দুই হাজার ৬৭৩টি তাঁত আগে থেকেই বন্ধ বা অচালু রয়েছে। করোনা ভাইরাসের প্রথম ঢেউয়ে গত বছরের ২৬ মার্চ থেকে সরকারি নির্দেশনায় কল-কারখানা-ফ্যাক্টরি বন্ধ ঘোষণা করায় চালু তাঁত ফ্যাক্টরিগুলোও বন্ধ হয়ে যায়। ফলে জেলার তাঁতশিল্পে প্রতিদিন গড়ে এক কোটি ৮৭ লাখ ৫৬ হাজার ৪০০ টাকা ক্ষতি হয়।
বাতাঁবো’র টাঙ্গাইল সদর উপজেলার বাজিতপুর বেসিক সেণ্টার সূত্রে জানা গেছে, এ সেন্টারের ৩২টি প্রাথমিক তাঁতি সমিতি ও তিনটি মাধ্যমিক সমিতির দুই হাজার ২৬৭ তাঁত মালিকের মোট ১২ হাজার ৪২৯টি তাঁত রয়েছে। এরমধ্যে দুই হাজার ৬৭৩টি তাঁত আগে থেকেই বন্ধ বা অচালু এবং ৯ হাজার ৭৫৬টি তাঁত চালু ছিল। মূলত এ বেসিক সেন্টারের তাঁতগুলোতে মিহি সুতার ঐতিহ্যবাহী টাঙ্গাইল শাড়ি তৈরি হয়ে থাকে।
বল্লা(কালিহাতী) বেসিক সেন্টার সূত্র মতে, এ সেন্টারের ১৭টি প্রাথমিক তাঁতি সমিতি ও একটি মাধ্যমিক তাঁতি সমিতির অধীনে দুই হাজার ১২৪টি তাঁত ফ্যাক্টরি মালিকের ১৮ হাজার ১৭৫টি তাঁত রয়েছে। এ বেসিক সেন্টারের তাঁতগুলোতে অপেক্ষাকৃত মোটা সুতার শাড়ি উৎপাদিত হয়ে থাকে।
শাড়ি প্রস্তুতকারক ও ব্যবসায়ী মলয় চন্দন জানান, করোনার প্রথম ঢেউয়ের সঙ্গে বন্যা তাঁত শিল্পের ব্যাপক ক্ষতি করেছিল। কিন্তু করোনার দ্বিতীয় ঢেউয়ে এ শিল্প টিকে থাকবে কিনা তা নিয়ে সংশয় আছে। এ শিল্পকে বাঁচিয়ে রাখতে সরকারি প্রণোদনার পাশাপাশি তাঁত শাড়ির বাজার তৈরিতেও সরকারের ভূমিকা প্রয়োজন।
টাঙ্গাইল শাড়ি ব্যবসায়ী সমিতির সভাপতি ও যজ্ঞেশ্বর অ্যান্ড কোং এর মালিক রঘুনাথ বসাক জানান, করোনার প্রথম ঢেউয়ের সাথে বন্যা এবং করোনা মহামারির দ্বিতীয় ঢেউয়ের ভয়াবহ দুর্যোগে জেলার তাঁত শিল্পে স্থবিরতা নেমে এসেছে। এ শিল্পের সঙ্গে প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে জড়িত প্রায় দুই লাখ পরিবার এক প্রকার কর্মহীন হয়ে পড়েছে। তাদের জীবন-জীবিকার উপর এর প্রভাব পড়তে শুরু করেছে।
টাঙ্গাইল সদরের বাজিতপুর বেসিক সেন্টারের লিয়াজোঁ অফিসার মো. রবিউল ইসলাম জানান, তারা ক্ষুদ্র ও প্রান্তিক ১৩৮জন তাঁতিকে মাত্র ৫ শতাংশ সার্ভিস চার্জে ঋণ দিয়েছেন। আরও ৭৪ জনের ঋণ প্রস্তাবনা প্রকল্প পরিচালকের কাছে পাঠানো হয়েছে। শাড়ি উৎপাদন ও বাজারজাতকরণ কিংবা নতুন বাজার সৃষ্টিতে তাঁতিদেরকেই এগিয়ে আসতে হবে।
তিনি আর ও জানান, করোনা মহামারির শুরু থেকে তাঁতশিল্প ক্ষতির মুখে পড়েছে। এরমধ্যে গেল বন্যায়ও ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। করোনা ভাইরাসের দ্বিতীয় ঢেউ তাঁতশিল্পকে আবারও বিপদের মুখে ফেলেছে। করোনা পরবর্তী পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে এ শিল্প মহাসঙ্কটে পড়ার আশঙ্কা রয়েছে।