বিএসআরএম’র কারখানা এখন কেন বন্ধ চান ইঞ্জিনিয়ার মোশাররফ?
মীরসরাইয়ে পানির স্তর নিচে নেমে যাওয়ায় দেখা দিয়েছে সুপেয় পানি সংকট। কিছু স্থানীয় বাসিন্দার অভিযোগ, বাংলাদেশ স্টিল রি-রোলিং মিলস (বিএসআরএম) গভীর নলকূপ বসিয়ে ভূ-গর্ভস্থ পানি উত্তোলনের ফলে এলাকার মানুষ পানি পাচ্ছে না। তাই কোম্পানিটির কার্যক্রম বন্ধের দাবি জানিয়েছেন তারা। যদিও বিএসআরএম তাদের উপর ঢালাওভাবে দোষারোপ করার বিষয়ে প্রতিবাদ জানিয়ে বক্তব্য প্রদান করেছে।
এদিকে, বিএসআরএম’র উপর দোষারোপের বিষয়ে উসকানি দিয়ে এলাকাবাসীর দাবিতে সমর্থন জানিয়েছেন আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় সভাপতিমণ্ডলীর সদস্য ও মীরসরাইয়ের এমপি ইঞ্জিনিয়ার মোশাররফ হোসেন। গত রোববার (৩০ মে) দুপুরে জোরারগঞ্জে বিএসআরএম কারখানার সামনে আয়োজিত এক সমাবেশে বক্তব্য দেন তিনি।
সমাবেশে বলেন, ‘এক-দুই বছরের মধ্যে এই কারখানা বঙ্গবন্ধু শিল্প নগরীতে স্থানান্তর করতে হবে। না হয় জনগণ ফ্যাক্টরি গুঁড়িয়ে দেবে।’
কিন্তু, ২০১৮ সালে বিএসআরএম’র কারখানার উদ্বোধন অনুষ্ঠানে স্বতঃস্ফূর্ত অংশ নিয়ে এখন সেই কারখানাই বন্ধ করতে বলছেন ইঞ্জিনিয়ার মোশাররফ হোসেন। তার এমন দ্বিমুখী আচরণের কারণে মোশাররফ হোসেনের ‘নীতি-নৈতিকতা’ নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে বিভিন্ন মহলে।
জানা যায়, মীরসরাইয়ের সোনাপাহাড় এলাকায় ২০১৮ সালে বিএসআরএম স্টিল মিলের তৃতীয় বিলেট কারখানার আনুষ্ঠানিক উদ্বোধন করা হয়। ওই অনুষ্ঠানে উপস্থিত থেকে তৎকালীন গৃহায়ন ও গণপূর্তমন্ত্রী ইঞ্জিনিয়ার মোশাররফ হোসেন বিএসআরএম’র সবচেয়ে বড় কারখানাটির উদ্বোধন করেন।
ওই সময়ে কোন ধরনের আপত্তি করেননি তিনি। বরং বিএসআরএম’র কার্যক্রমের ব্যাপক প্রশংসাও করেছিলেন। উদ্বোধন অনুষ্ঠানে মোশাররফ হোসেন বলেছিলেন, অবকাঠামো উন্নয়নে স্টিলের ব্যাপক গুরুত্ব রয়েছে। স্টিল ছাড়া এখন উন্নয়ন কার্যক্রমের কথা ভাবাই যায় না। এজন্য স্টিল হতে হবে বিশ্বমানের।
চট্টগ্রামের মীরসরাই একটি গুরুত্বপূর্ণ অর্থনৈতিক অঞ্চল। এখানে দেশের বৃহৎ বৃহৎ শিল্পগ্রুপের নানা ধরনের শিল্প কারখানা রয়েছে। বিদেশি বিনিয়োগকারীরা প্রচুর পরিমানে বিনিয়োগ করে থাকেন এসব শিল্পী প্রতিষ্ঠানে। এমন অর্থনৈতিক অঞ্চল নিয়ে ইঞ্জিনিয়ার মোশাররফ হোসেনের ব্যবসায়ী বিরোধী মনোভাব বিদেশি বিনিয়োগকারীদের বিনিয়োগে নিরুৎসাহিত করবে। সেই সঙ্গে বিদেশে বাংলাদেশের বাণিজ্যনীতিও প্রশ্নের মুখে পড়বে বলে জানান অর্থনৈতিক বিশ্লেষকরা।
পানি সংকটের জন্য বিএসআরএমকে দুষলেও প্রশাসনিক কর্তাব্যক্তিরা বলছেন ভিন্ন কথা।
তারা জানান, পানির স্তর নেমে যাওয়া শুধু মীরসরাইয়ের সমস্যা নয়, এটি সারাদেশের সমস্যা। পানির স্তর স্বাভাবিকের চেয়ে অনেক বেশি নিচে নেমে গেছে, এটি প্রাকৃতিক কারণেও হয়ে থাকতে পারে। গরম বেশি হওয়ায় এটি হচ্ছে। বর্ষা আসলে পানির সমস্যা দূর হয়ে যাবে।
মীরসরাইয়ের পানি সংকটের বিষয়ে বিএসআরএম’র জানায়, বিএসআরএম পানির কোনো সংকট সৃষ্টি করছে না। কেউ যদি এই অভিযোগ দেন তাহলে তারা বিএসআরএম-এর ভালো দেখতে পারেন না। তাছাড়া আরও অনেকেই ডিপ টিউবওয়েল ব্যবহার করে, শুধু বিএসআরএমের নাম কেন আসছে? এর কোনো যৌক্তিকতা থাকতে পারে না।
এছাড়া বিএসএআরএম কর্তৃপক্ষ মীরসরাইয়ে পানি সংকটের বিষয়ে সোমবার (৩১ সে) আনুষ্ঠানিভাবে তাদের বক্তব্য জানিয়েছে। বিএসআরএম’র বক্তব্য হুবহু তুলে ধরা হলো।
বিএসআরএম জানিয়েছে, মীরসরাইয়ে পানির সংকট শীর্ষক সংবাদ তাদের দৃষ্টিগোচর হয়েছে। এ প্রসঙ্গে বিএসআরএম কর্তৃপক্ষের বক্তব্য হচ্ছে, ১) শিল্প কারখানার জন্য পানি একটি অপরিহার্য উপাদান। মীরসরাইয়ে বিএসআরএমের একাধিক শিল্প কারখানা স্থাপিত হয়েছে এবং সেগুলোর পানির উৎস হিসেবে কয়েকটি ডিপ টিউবওয়েল রয়েছে। প্রসঙ্গক্রমে উল্লেখ্য, সিটি কর্পোরেশনের বাইরে ডিপ টিউবওয়েলের জন্য স্থানীয় কর্তৃপক্ষের অনাপত্তি পত্রের বাধ্যবাধকতা না থাকলেও শুধুমাত্র আইনের প্রতি সর্বোচ্চ শ্রদ্ধাশীল হয়েই আমরা এ ব্যাপারে অনাপত্তিপত্র গ্রহণ করি। ২) আমাদের কারখানাগুলোতে পানি রিসাইক্লিং পদ্ধতি বিরাজমান এবং পানির ব্যবহারেও আমরা অত্যন্ত মিতব্যয়ী। কারখানাগুলোর জন্য ছাড়পত্র গ্রহণের সময় পরিবেশ অধিদপ্তরের বিভিন্ন অপরিহার্য ফর্ম পূরণের সময়ে আমরা পানির উৎস হিসেবে ডিপ টিউবওয়েলের উল্লেখ করেছিলাম। উপরন্তু বৃষ্টির পানি বা প্রাকৃতিক ভাবে পানি সংগ্রহের জন্য তিন একর জমির উপর আমাদের পানির রিজার্ভার রয়েছে। উক্ত রিজার্ভারের পানিও রিসাইক্লিং পদ্ধতিতে কারখানায় ব্যবহার হয়।
৩) ডিপ টিউবওয়েল ছাড়াও পানির সম্ভাব্য বিকল্প উৎস হিসেবে ফেনী নদী থেকে পানি আনার ব্যাপারে আমাদের চেষ্টা অব্যাহত আছে এবং এ বিষয়ে বাংলাদেশ পানি উন্নয়ন বোর্ডের সাথে চুক্তিও স্বাক্ষরিত হয়েছে। পাইপ সংযোজনের ব্যাপারে রেলওয়ে মন্ত্রণালয় থেকে অনুমোদন পেলেই দ্রুততম সময়ে কাজ শুরু হবে। বর্তমানে আমরা ফেনী নদী থেকে ওয়াটার বাউজারের মাধ্যমে কলকারখানার উৎপাদন প্রক্রিয়ার জন্য পানি সংগ্রহ করছি। ৪) অগভীর নলকূপের পানির প্রাপ্যতার কোনো সংকট হয়ে থাকলে তা সাম্প্রতিক খরা, অনাবৃষ্টি ও একই পানির স্তরের কাছাকাছি অসংখ্য অগভীর নলকূপ স্থাপনের কারণেও হতে পারে। সুতরাং ঢালাওভাবে বিএসআরএমের উপর দোষারোপ করা এই সমস্যার সমাধান হতে পারে না। ৫) বিএসআরএম ছাড়াও মীরসরাই-সীতাকুণ্ড এলাকায় অসংখ্য শিল্প-কলকারখানা রয়েছে যেগুলো শুধুমাত্র ভূ-গর্ভস্থ পানির উপর নির্ভরশীল। ৬) মীরসরাই উপজেলার আর্থ-সামাজিক ও জীবনযাত্রার মান উন্নয়নের জন্য বিএসআরএম ভূমিকা রেখে চলেছে। ৭) উপরন্তু বিএসআরএম গ্রুপ অব কোম্পানিজ দেশের স্টিল সেক্টরে সর্বোচ্চ পরিমাণ রাজস্ব প্রদানকারী প্রতিষ্ঠান যার উপর ভিত্তি করে প্রশাসনিক ও রাজস্ব ব্যয় পরিচালিত হয়। গত অর্থবছরে (বর্ষ ২০১৯-২০) আমরা রাষ্ট্রীয় কোষাগারে প্রায় ২১০০ কোটির অধিক টাকা জমা দিয়েছি। শুধুমাত্র বিদ্যুৎ বিল বাবদ আমরা প্রতিমাসে গড়ে প্রায় ১০০ কোটি টাকার বেশি পরিশোধ করে আসছি। বিগত ৬৯ বছরের আমাদের এ বিরামহীন সততার পদচারণা প্রশংসার দাবি রাখে।
বিএসআরএম কর্তৃপক্ষ, নিরবচ্ছিন্ন উৎপাদন প্রক্রিয়া চলমান রাখার নিমিত্তে বরাবরের মতো স্থানীয় জনপ্রতিনিধি, গণমাধ্যম ও অত্র এলাকার জনসাধারণের সহযোগিতা কামনা করছে।