উপকূলীয় অঞ্চলে জনপ্রিয় হয়ে উঠছে টাওয়ার কৃষি
খুলনার উপকূলীয় দরিদ্র মানুষের জীবনমান ও পুষ্টি চাহিদা পূরণে কাজ করছে কৃষি সম্প্রসারণ অধিদফতর। এরই ধারাবাহিকতায় দরিদ্র ও আশ্রয়ণ কেন্দ্রের মানুষের মাঝে ব্যাপক চাহিদা ও আগ্রহ তৈরি করেছে টাওয়ার কৃষি। এমনটাই জানিয়েছেন, ‘ক্লাইমেট- স্মার্ট প্রযুক্তির মাধ্যমে খুলনা কৃষি অঞ্চলের জলবায়ু পরিবর্তন অভিযোজন’ প্রকল্প পরিচালক শেখ ফজলুল হক মনি।
প্রকল্প পরিচালক বার্তা২৪.কম-কে বলেন, জলবায়ুর অভিযোজন মোকাবিলায় খুলনা কৃষি অঞ্চলের (খুলনা, বাগেরহাট, সাতক্ষীরা ও নড়াইল) ২৮টি উপজেলা ও ২টি মেট্রোপলিটন এলাকার কৃষি উন্নয়নের কাজ করা হচ্ছে। তবে উপকূলীয় অঞ্চল খুলনায় সবজি চাষ সব মৌসুমেই ঝুঁকিপূর্ণ। শীত ও বসন্তকালে লবণাক্ততা, খরা ও বর্ষায় জমি কাদা ও জলমগ্ন হওয়ায় অধিকাংশ সবজিগাছ ক্ষতিগ্রস্ত হয়। এ ধরনের বিরূপ পরিস্থিতিতে সবজি চাষের জন্য ওয়ার্ল্ড ফিশ কৃষকদের বাড়ির উঠানে টাওয়ার পদ্ধতিতে সবজি চাষ শুরু করেছে।
বাগেরহাট ও সাতক্ষীরা জেলায় ইতিমধ্যে এ পদ্ধতিতে সবজি চাষ করে সুফল পাওয়া গেছে। এই বিশেষ পদ্ধতিটি অনেকের কাছেই জনপ্রিয় হয়ে উঠেছে। বসতবাড়ির উঠানে এ পদ্ধতিতে সবজি চাষ করা হলেও, পরিকল্পনা করে বিশেষ কৌশলে মাঠেও এ পদ্ধতিতে সবজি চাষ করা যেতে পারে। বিশেষ করে লতাজাতীয় সবজি চাষে মাঠের স্বল্প জলমগ্নতা ও লবণাক্ততায় সবজি চাষ করা সম্ভব। অনেকটা টাওয়ারের মতো আর একটি পদ্ধতিতে সবজি চাষও ইতিমধ্যে প্রসার লাভ করেছে।
টাওয়ার পদ্ধতিতে চাষের সুবিধা সম্পর্কে শেখ মনি বলেন, লবণাক্ত মাটিতেও সবজি চাষ, লবণাক্ততা, জলাবদ্ধতা, জলমগ্নতা, অতিবৃষ্টি, বন্যা, ঢল, খারা ইত্যাদি পরিস্থিতি সবজি চাষ করা যায়। অল্প জমিতে সবজি চাষ, আগাম বা নাবি সবজি চাষ, চাষের খরচ, সেচ ও সার কম লাগে, নিবিড় তদারকিতে নিরাপদ সবজি উৎপাদন করা যায়, বসতবাড়িতে এ পদ্ধতিতে সবজি চাষ করে পারিবারিক সবজির চাহিদার অনেকাংশ পূরণ করা যায়। অতিরিক্ত সবজি বাজারে বিক্রি করে পারিবারিক আয় বাড়ানো যায়।
তিনি বলেন, বিদেশে হাইড্রোপনিক্স বা জলচাষ পদ্ধতিতে এক ধরনের পিভিসি টাওয়ার ব্যবহার করা হয়। খাড়াভাবে তৈরি করা টাওয়ার বা স্তম্ভের চারপাশে গোলাকার বেশ কিছু ছিদ্র থাকে। সেসব ছিদ্রে বিভিন্ন সবজির চারা লাগিয়ে বড় করা হয়। স্তম্ভের গোড়ায় একটি বেস বা বাক্সেও মতো কাঠামো থাকে । এ ধরনের সবজি বাগান করাকে ভার্টিক্যাল গার্ডেনিং বা টাওয়ার গার্ডেনিং বলা হয়। এরূপ ধারণা থেকেই এ দেশে টাওয়ার বাগান করা শুরু হয়েছে। তবে কৌশলটি লবণাক্ত এলাকার জন্য বেশ কার্যকর।
এ পদ্ধতিতে বাঁশ ও গাছের ডাল দিয়ে বৃত্তাকার কাঠামো তৈরি করে তার ভেতরে মাটি দিয়ে ভরাট করে খাড়াভাবে উঁচু মাদার মতো তৈরি করা হয় ও সেই উঁচু জায়গায় সবজি গাছ লাগানো হয়। মাটি দিয়ে উঁচু বেদি বা স্তম্ভের মতো করা হয় বলে একে ‘টাওয়ার' নামে পরিচিত করানো হয়েছে । ঝালকাঠি ও বরিশালের অনেক নিচু জমিতে প্রাচীনকাল থেকে টাওয়ারের অনুরূপ একটি পদ্ধতিতে নিচু ধানের খেতে মিষ্টি কুমড়ার চাষ হয়ে আসছে যাকে বলে 'ঢুপ চাষ'। জমির পানি যখন শুকিয়ে আসে তখন সেসব জমির আগাছা-আবর্জনা পরিষ্কার করে জমির মধ্য স্থানে জড়ো করে ঢিবি বা গাদা করা হয়। এর উপরে অল্প মাটি দিয়ে চাপা দেয়া হয়। এসব আগাছা পচতে শুরু করে। এর মধ্যে কয়েকটি মিষ্টি কুমড়ার বীজ বুনে দেওয়া হয়। গাছ বড় হয়ে চুপ বা ঢিবি ছেয়ে ফেলে। ঢিবি ছাড়া জমির অন্যান্য নিচু অংশে অন্য ফসল চাষ করা হয়।
বসতবাড়ির খোলা উঠান টাওয়ার তৈরির আদর্শ স্থান। উঠানের একপাশে খোলামেলা বা দিনের বেশিরভাগ সময় রোদ পড়ে এমন স্থান টাওয়ার তৈরির জায়গা হিসেবে বেছে নিতে হবে। খোলা মাঠে টাওয়ার বানাতে চাইলে যেসব জমি বছরের বেশ খানিকটা সময় স্বল্প গভীরতায় জলমগ্ন ও লবণাক্ত থাকায় সেখানে সবজি চাষ করা যায় না সেরূপ জমিতে টাওয়ার তৈরি করে সবজি করা লাভজনক হতে পারে। এমনকি বন্যাপ্রবণ এলাকার জমিতেও উঁচু মাদা বা টাওয়ার তৈরি করে সবজি চাষ করা যায়। এরূপ এলাকার মাঠে এ পদ্ধতিতে সবজি চাষের জন্য সারি করে নির্দিষ্ট দূরত্বে টাওয়ার বা উঁচু মাদা তৈরি করতে হবে।
টাওয়ারের জন্য উপযোগী সবজি
গ্রীষ্মকালে অর্থাৎ খরিপ-১ মৌসুমে মিষ্টি কুমড়া, ঝিঙ্গা, করলা, ধুন্দুল, শসা, বরবটি, মাচার পুঁইশাক ইত্যাদি লতানো সবজির চাষ করা যায়। এছাড়া ঢেঁড়শ, বেগুন, মরিচ ইত্যাদির চাষ করা যায়। বর্ষাকালে বা খরিপ-২ মৌসুমে চাষ করা যায় চালকুমড়া, পুঁইশাক, গিমাকলমি ইত্যাদি। শীতকালে বা রবি মৌসুমে বেগুন, টমেটো, বাড়শিম, শিম, লাউ ইত্যাদি চাষ করা যায়। টাওয়ারের গায়ে মাঝে মাঝে ফুটো করে সেখানে গিমাকলমি, মুলাশাক, ধনিয়াপাতা, পুঁইশাক, মরিচ ইত্যাদির বীজ বোনা যেতে পারে।
টাওয়ারে গাছ লাগানোর পদ্ধতি
টাওয়ারের উপরে বীজ বা চারা লাগিয়ে সবজি চাষ করা যায়। বসতবাড়ির উঠোনে একটি টাওয়ার বানালে তার চারদিকে টাওয়ার থেকে ১.৫-২ মিটার দূরে চারটি শক্ত বাঁশের খুঁটি পুঁতে তার মাথায় বাঁশের ফ্রেম করে জিআই তার টেনে অথবা কঞ্চি বিছিয়ে মাঁচা করে দিতে হবে। মাঁচা অবশ্যই টাওয়ারের উপর থেকে কমপক্ষে ৫০-৬০ সেন্টিমিটার উঁচু হবে। অর্থাৎ টাওয়ার ৭৫-১০০ সেন্টিমিটার উঁচু হলে মাটি থেকে মাঁচার উচ্চতা হবে ১২৫-১৬০ সেন্টিমিটার।
প্রকল্প পরিচালক বলেন, প্রকল্প এলাকার ২০টি উপজেলার দরিদ্র মানুষের কাছে পৌঁছে দেয়া হয়েছে এই টাওয়ার কৃষি। এখনো প্রায় ৩০০টি টাওয়ার করে দেয়ার আবেদন রয়েছে। কিন্তু প্রয়োজনীয় অর্থ বরাদ্দ না থাকায় চাহিদা অনুযায়ী টাওয়ার কৃষির উপকরণসহ এ সুবিধা দেয়া যাচ্ছে না।
একাধিক টাওয়ার কৃষির কৃষাণীর সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, উপজেলা কৃষি কর্মকর্তার সহায়তায় টাওয়ার কৃষি করেছেন। একটি টাওয়ারে বেশ কয়েক রকমের সবজিচাষ করা যায়।
হেলেন নামের একজন বলেন, তিনি তার টাওয়ারে, লাউ, পুঁই শাক ও তিনটি বেগুন গাছ লাগিয়েছেন। নিজেদের প্রয়োজন মিটিয়ে অতিরিক্ত সবজি বিক্রি করে ছেলের স্কুলের লেখাপড়ার খরচও চলছে।