৬১ শতাংশ সেতুর কাজ সম্পন্ন, দেড় কিলোমিটারে বসছে স্প্যান
প্রমত্তা ও উত্তাল যমুনার বুকে বসানো হয়েছে ভারি ভারি যন্ত্র। তারমাঝেই সারিবদ্ধভাবে নদীতে মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়ে আছে প্রতিটি দৃশ্যমান পিলার। উত্তাল এই যমুনা নদীর ওপর দেশের দ্বিতীয় বৃহতম বঙ্গবন্ধু সেতুর ৩০০ মিটার উজানে নির্মাণ করা হচ্ছে আরেকটি বৃহত্তর বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব রেলওয়ে সেতু। সেতুকে ঘিরে যমুনার নদীর টাঙ্গাইলের ভূঞাপুর ও সিরাজগঞ্জের ২ প্রান্তে দিন-রাত বিরতহীনভাবে কাজ করছেন দেশি-বিদেশি শতশত প্রকৌশলী ও নিমার্ণ শ্রমিকরা। দেশের অন্যতম এই বৃহৎ মেগা প্রকল্প বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব রেলওয়ে সেতুর কাজ ইতোমধ্যে ৬১ শতাংশ সম্পন্ন হয়েছে। দ্রুত গতিতে কাজ চলমান থাকলেও শুকনো মৌসুম থাকায় কাজে ধীরগতি। যার ফলে, কাজ শেষ করতে অতিরিক্ত ৩-৪ মাস বেশি সময় লাগতে পারে বলে প্রকল্প সূত্র থেকে জানা যায়।
এদিকে, ইতিমধ্যে যমুনা নদীর টাঙ্গাইলের ভূঞাপুর অংশে ৭৫ শতাংশ এবং সিরাজগঞ্জ অংশে ৪৬ শতাংশ কাজ সম্পন্ন করেছে নির্মাণাধীন ঠিকাদারী প্রতিষ্ঠান। ঢাকা ও উত্তরবঙ্গের ২২টি জেলার সঙ্গে ট্রেন চলাচল সহজ করতে যমুনা নদীর ওপর পৃথক রেল সেতু নির্মাণ করা হচ্ছে, যা আন্ত:এশিয়া রেল যোগাযোগে মাইলফলক হিসেবে কাজ করবে। ডুয়েলগেজের এ সেতুতে ঘণ্টায় সর্বোচ্চ ২৫০ কিলোমিটার গতিতে ট্রেন চালানো যাবে। তবে, শুরুতে (উদ্বোধনের ১ বছর) সাধারণত ঘণ্টায় ১০০ থেকে ১২০ কিলোমিটার গতিতে ট্রেন চলাচল করবে।
দেখা যায়, যমুনা নদীর ওপর নির্মিত বঙ্গবন্ধু সেতুর পাশে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব রেলওয়ে সেতুর কাজ চলছে। শতশত দেশি-বিদেশি প্রকৌশলী ও নির্মাণ শ্রমিকরা কাজের দায়িত্ব পালন করছেন। কেউ পাইলিংয়ের কাজ করছেন, কেউ স্পেনের কাজ করছেন। আবার কাউকে ঢালাইয়ের কাজ করতে দেখা গেছে। বঙ্গবন্ধু রেলওয়ে সেতুর ৫০টির মধ্যে ৩১টি পিলারের কাজ শেষ হয়েছে এবং ১৬ টি পিলারে ইতিমধ্যে দেড় কিলোমিটারের বেশি স্প্যান বসানো ও ২৬ টি পিলারে স্প্যান বসানোর উপযোগী করা হয়েছে। বাকি পিলারের বিভিন্ন স্তরের ঢালাইয়ের কাজ চলমানসহ অন্যান্য কাজ চলমান রয়েছে। অন্যদিকে, যমুনা নদীতে পানি কম থাকায় সেতু নিমার্ণ কাজে ধীরগতি লক্ষ্য করা যায়।
বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব রেলওয়ে সেতুর প্রকল্প পরিচালক (পিডি) আল ফাত্তাহ মো. মাসুদুর রহমান জানান, বর্তমানে বঙ্গবন্ধু সেতু দিয়ে ৩৮টি ট্রেন চলাচল করে। নতুন রেল সেতু চালু হলে মালবাহীসহ ৮৮টি ট্রেন চলাচল করার পাশাপাশি বিভিন্ন দেশের সঙ্গে ট্রেন চলাচলের আন্তঃসংযোগ সৃষ্টি হবে। দ্রুত কাজ শেষ করার লক্ষ্যে সাইটের কর্মীরা রাত-দিন পরিশ্রম করছেন। সেতুর ৫০টি পিলারের মধ্যে ৩১টি পিলারের কাজ শেষ হয়েছে। এ পর্যন্ত ৬১ শতাংশ কাজ বাস্তবায়িত হয়েছে। নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যে কাজ শেষ করার কথা থাকলেও শুকনো মৌসুম থাকায় কাজে ধীরগতিতে চলছে। এ কারণে আরও অতিরিক্ত ৩-৪ মাস সময়ের প্রয়োজন হতে পারে বলে ধারণা করছি।
প্রকল্প সূত্র থেকে জানা যায়, ২০১৬ সালের নকশা প্রণয়নের পর প্রকল্পের ব্যয় ধরা হয়েছিল ৭ হাজার ৪৭ কোটি টাকা। পরে ডিসেম্বরে প্রকল্পে চূড়ান্ত নকশা প্রণয়নসহ বঙ্গবন্ধু রেল সেতুর নির্মাণ ব্যয় ধরা হয় ৯ হাজার ৭৩৪ কোটি ৭ লাখ টাকা। জাপান আন্তর্জাতিক সহযোগিতা সংস্থা (জাইকা) দেশের বৃহত্তম এ রেল সেতু নির্মাণে ৭ হাজার ৭২৪ কোটি ৩৩ লাখ টাকা ঋণের আশ্বাস দেয়। প্রথম দফা ডিপিপি সংশোধনের পর সেতুর নির্মাণব্যয় ৭ হাজার ৪৭ কোটি টাকা থেকে বেড়ে ১৬ হাজার ৭৮০ কোটি ৯৬ লাখ টাকায় দাঁড়ায়।
এরমধ্যে জাইকা ঋণ দেওয়ার কথা ১২ হাজার ১৪৯ কোটি ২০ লাখ টাকা। যদিও সম্ভাব্যতা যাচাইয়ের পর প্রকল্পের ব্যয় প্রাক্কলন করা হয়েছিল ৮ হাজার ৪৬৪ কোটি ২১ লাখ টাকা। এ হিসাবে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব রেল সেতুর নির্মাণ ব্যয় প্রায় দ্বিগুণ হয়েছে। আইএমইডির প্রতিবেদনে প্রকল্পের ব্যয় বেড়ে যাওয়ার কারণ বিশ্লেষণ করে বলা হয়েছে, প্রকল্পের মূল ডিপিপিতে জমি অধিগ্রহণ ও আনুষঙ্গিক খাতে কোনো ব্যয় ধরা ছিল না। তবে, সেতু কর্তৃপক্ষ (বাসেক) জমি ব্যবহারে পরবর্তীতে রেলওয়ে সমঝোতা স্মারক সই করে। এতে ১৮৭ একর জমি স্থায়ীভাবে ব্যবহার ও ২৬৩ একর জমি অস্থায়ীভাবে ব্যবহারে বাসেককে (সেতু কর্তৃপক্ষ) ৩৪৬ কোটি ৬৬ লাখ টাকা দিতে সম্মত হয় বাংলাদেশ রেলওয়ে। এছাড়া মাটির কাজে ১৬৮ কোটি ২০ লাখ টাকা ও রেল ট্র্যাক নির্মাণে ৫৮ কোটি ৫ লাখ টাকা ব্যয় বেড়ে যায়। সম্ভাব্যতা যাচাই ও খসড়া নকশায় সেতুর পিলারের সংখ্যা ৪১টি ধরা হয়েছিল। চূড়ান্ত নকশায় তা বাড়িয়ে ৫০টি করা হয়েছে।
এরপর খসড়া নকশায় পাইলের গভীরতা ২৭ দশমিক ৭৯ মিটার ধরা হয়েছিল। চূড়ান্ত নকশায় গভীরতা বাড়িয়ে ৩৭ মিটার ধরা হয়েছে। খসড়া নকশায় স্প্যানের দৈঘর্য ১২০ মিটার ধরা হয়েছিল। পরে কমিয়ে ১০০ মিটার করা হয়েছে। সব মিলিয়ে মূল সেতু, রেলওয়ে ট্র্যাক, এমব্যাংকমেন্ট, স্টেশন বিল্ডিং ও সাইট অফিস ইত্যাদি নির্মাণে ৫ হাজার ২১৩ কোটি ২০ লাখ টাকা ব্যয় বাড়ে। এর বাইরে সিগনালিং ও টেলিকমিউনিকেশন খাতে ব্যয় বেড়েছে ৩ কোটি ৬ লাখ টাকা। পরিদর্শন বাংলো ও জাদুঘর নির্মাণ প্রকল্পে নতুন করে যুক্ত করা হয়েছে। এ খাতে ব্যয় হবে ৬৯ কোটি ৭২ লাখ টাকা। তবে পরামর্শক খাতে প্রায় ৯০ কোটি টাকা ব্যয় কমেছে। আনুষঙ্গিক খাতে ব্যয় বেড়েছে ৫৪ কোটি ৫০ লাখ টাকা, সাধারণ প্রয়োজনীয় খাতে ১ হাজার ৩৩২ কোটি ৯৮ লাখ টাকা, পরিবেশগত সেফগার্ড খাতে ২২ কোটি ৯৫ লাখ টাকা আনুষাঙ্গিক খরচ ধরা হয়।
আইএমইডি বলছে, ডিপিপিতে প্রথমে প্রকল্পটি ৯০ মাসের মধ্যে বাস্তবায়নের সময় বেঁধে দেওয়া হয়। সে অনুযায়ী ২০২৩ সালের ডিসেম্বরে প্রকল্পের কাজ শেষ করার লক্ষ্য নির্ধারণ করা হয়েছিল। তবে কাজ শুরু করতে দেরি হওয়ায় প্রকল্পের মেয়াদ আরও ২৪ মাস বাড়িয়ে ২০২৫ সালের ডিসেম্বরে প্রকল্পের কাজ শেষ করার নতুন লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছে। এটাও প্রকল্পের অন্যতম দুর্বল দিক। রেলের সড়ক বাঁধ নির্মাণে যথাযথ ও অনুমোদিত পদ্ধতি ব্যবহার করা হয়নি। এটাও প্রকল্পের অন্যতম দুর্বল দিক হিসেবে চিহ্নিত করা যায়।
তথ্যমতে, বঙ্গবন্ধু সেতুর উত্তর পাশে ৩০০ মিটার দূরে ৪ দশমিক ৮ কিলোমিটার দীর্ঘ ডুয়েলগেজ ডাবল লাইন রেল সেতু নির্মাণ করা হচ্ছে। এজন্য পৃথকভাবে নদী শাসন করতে হচ্ছে না। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব রেলওয়ে সেতুর উভয় দিকে ৫৮০ মিটার ভায়াডাক্ট (সংযুক্ত উড়ালপথ) থাকবে। যমুনা ইকো পার্কের পাশ দিয়ে এটা বিদ্যমান বঙ্গবন্ধু সেতুর পশ্চিম অংশের রেলপথের সঙ্গে যুক্ত হবে। এ জন্য ৬ দশমিক ২ কিলোমিটার সংযোগ রেলপথ নির্মাণ করতে হচ্ছে। পাশাপাশি ৩টি স্টেশন বিল্ডিং, ৩ টি প্লাটফর্ম ও শেড, ৩টি লেভেল ক্রসিং গেট ও ৬ টি কালভার্ট নির্মাণ করা হবে। রেল সেতুর পূর্ব পাশে লুপ লাইনসহ প্রায় সাড়ে ১৩ কিলোমিটার, ১৩টি কালভার্ট ও ২টি সংযোগ স্টেশন নির্মাণ করা হবে।
বঙ্গবন্ধু সেতুতে ট্রেন চালানো ঝুঁকিপূর্ণ হওয়ায় পারাপারের সময় গতি অনেক কমিয়ে দেওয়া হয়। সেতুর ওপর দিয়ে ব্রডগেজ পণ্যবাহী ট্রেন চলাচল নিষিদ্ধ রয়েছে। এটা অভ্যন্তরীণ ও আন্তর্জাতিক রেল যোগাযোগের ক্ষেত্রে বড় প্রতিবন্ধকতা করে। এ জন্যই বঙ্গবন্ধু সেতুর উত্তর পাশে পৃথক রেল সেতু নির্মাণের উদ্যোগ নেওয়া হয়। এর পরিপ্রেক্ষিতে প্রকল্প অনুমোদনের পর ২০১৭ সালের মার্চে পরামর্শক নিয়োগ করা হয়। ২০১৮ সালের সেপ্টেম্বরে বিস্তারিত নকশা প্রণয়ন শেষ হয়। দুই অংশের জন্য ২০২০ সালের মাঝামাঝি সময়ে ঠিকাদার নিয়োগের চুক্তি সই হয়। বর্তমান প্রকল্পে রেলপথের পাশাপাশি সেতুর গ্যাস সঞ্চালন লাইন নির্মাণ করা হবে। স্টিল অবকাঠামোয় প্রযুক্তি ব্যবহার করা হচ্ছে। নির্মাণাধীন বঙ্গবন্ধু রেলওয়ে সেতু দিয়ে সাধারণ ট্রেন ছাড়াও দ্রুতগতির (হাইস্পিড) ট্রেনও চালানোর উপযুক্ত করে নির্মাণ করা হচ্ছে।