চট্টগ্রামে বন্যায় প্রাণহানি ২০, ক্ষতি ৩০০ কোটি টাকার বেশি

  • সীরাত মঞ্জুর, স্টাফ করেসপন্ডেন্ট, চট্টগ্রাম
  • |
  • Font increase
  • Font Decrease

চট্টগ্রামে বন্যায় প্রাণহানি ২০, ক্ষতি ৩০০ কোটি টাকার বেশি

চট্টগ্রামে বন্যায় প্রাণহানি ২০, ক্ষতি ৩০০ কোটি টাকার বেশি

 

চট্টগ্রাম টানা কয়েক দিনের বৃষ্টি ও পাহাড়ি ঢলে সৃষ্ট বন্যার পানিতে ডুবে ২০ জনের প্রাণহানি ঘটেছে। এর মধ্যে শুধু ১০ জন মারা গেছে সাতকানিয়া উপজেলায়। এসময় মহানগরসহ ১৪ উপজেলায় ঘর-বাড়ি, সকড়, ব্যবসাসহ বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের সব মিলিয়ে ৩০০ কোটি টাকার বেশি ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে বলে জানিয়েছে জেলা ত্রাণ ও পুনর্বাসন বিভাগ।

বিজ্ঞাপন

বৃহস্পতিবার (৩ আগস্ট) থেকে শুরু ভারি বর্ষণে তলিয়ে যায় নগরীর নিম্নাঞ্চলসহ বেশির ভাগ এলাকা। খোদ চট্টগ্রাম সিটি মেয়রের বাড়িও ডুবেছিল টানা তিন দিন। সেই পানি চারদিন পর সোমবার (৭ আগস্ট) থেকে কমতে শুরু করে নগরে। তবে এইদিন রাতের বৃষ্টি ও পাহাড় ঢলে বিপরীত পরিস্থিতি সৃষ্ট হতে থাকে দক্ষিণ চট্টগ্রামের কয়েকটি উপজেলায়।

পরেদিন মঙ্গলবার থেকে সাতকানিয়া, লোহাগাড়া ও চন্দনাইশের ইউনিয়নগুলোর একের পর এক ঢুবে যায়। এদিক সাতকানিয়া সব এলাকায় পাহাড়ি ঢলে ভয়াবহ রূপ নেয় বন্যা। যা ওই এলাকায় মানুষ আগে কখনো দেখেনি। একেরপর পর তলিয়ে নিয়ে যায় ঘর-বাড়ি, রাস্তা-ঘাট, ব্যবসা প্রতিষ্ঠানসহ সরকারি বেসরকারি বিভিন্ন স্থাপনা। এ থেকে রক্ষা হয়নি সরকারের চলমান অগ্রাধিকারভিত্তির প্রকল্প দোহাজারী-কক্সবাজারের রেললাইনও। শুধু কি তাই! পুরোপুরি বন্ধ হয়ে যায় চট্টগ্রাম-কক্সবাজার সড়কের গাড়ি চলাচল। যা দুদিন পর বৃহস্পতিবার (১০ আগস্ট) থেকে স্বাভাবিক হয়।

বিজ্ঞাপন

এই বন্যায় টানা ৩ দিনের বেশি পানির নিচে ছিল পুরো সাতকানিয়াসহ লোহাগাড়া ও চন্দনাইশের বেশিরভাগ এলাকা। ফলে বিছিন্ন হয়ে পড়ে মোবাইল নেটওয়ার্ক ব্যবস্থা। টানা ৪ দিন বন্ধ থাকে বিদ্যুৎ। যা ধীরে ধীরে স্বাভাবিক হলেও এখনো পানিবন্দি রয়েছে কয়েকহাজার পরিবার।

★বন্যায় যে ২০ জনের প্রাণহানি:

চট্টগ্রামে বন্যায় ও পানিতে ডুবে সাতকানিয়া উপজেলায় ১০ জন, লোহাগাড়ায় ৪ জন, চন্দনাইশ ৩ জন, বাঁশখালীতে ১ জন, রাউজানে ১ ও মহানগরে ১ জনের মৃত্যু হয়েছে।

সাতকানিয়ায়: পৌরসভার কামাল উদ্দিনের কলেজ পড়ুয়া ছেলে মো. সাকিব (১৭), পৌরসভার গোয়াজর পাড়ার আবদুর রাজ্জাকের ছেলে মো. ইদ্রিস (৫৯), পৌরসভার ডা. সৈয়দ আহম্মদের ছেলে বদিউল আলম (৬২), চরতী ইউনিয়নের মো. সেলিমের মেয়ে জান্নাতুল ফেরদৌস (৪), একই ইউনিয়নের কবির আহমদের ছেলে আবদুর রহিম (৪৫), ওই ইউনিয়নের মো. সেলিমের ছেলে মো. শহিদুল ইসলাম (৩), নলুয়া ইউনিয়নের মনিন্দ্র লাল কারণের স্ত্রী শোভা কারণ (৯০), সোনাকানিয়া ইউনিয়নের ফজল করিমের ছেলে হেলাল (৪৫), কাঞ্চনা ইউনিয়নের মো. আরিফের মেয়ে সানজিদা আক্তার (৪) ও কালিয়াইশ ইউনিয়নের ফজল আহমদের ছেলে ইদ্রিস (৫৫)।

লোহাগাড়া: আমিরাবাদ ইউনিয়নের জুলফিকার আলী ভুট্টুর ছেলে জুনায়েদুল ইসলাম জারিফ (২২), একই ইউনিয়নের সামশুল ইসলামের ছেলে মো. সাকিব (২০) এবং পদুয়া ইউনিয়নের কালু মিয়ার ছেলে আশহাব মিয়া (৫৫) ও একই ইউনিয়নের রহিম বক্সের ছেলে আবদুল মাবুদ (৫০)।


চন্দনাইশ: দোহাজারী পৌরসভার জামিজুরী এলাকা থেকে আনাছ (১০) ও তার দাদা আবু সৈয়দের (৮৩) ও ধোপাছড়ি ইউনিয়নের শামসু মিয়ার ছেলে খোকন (২৮।

বাঁশখালীর: পশ্চিম বৈলগাও এলাকার রফিকুল আলমের ছেলে মিছবাহ (৩)।

এর আগে গত ৭ আগস্ট পানিতে ডুবে থাকা নালায় তলিয়ে যাওয়া নিপা পালিত (২০) নামে এক কলেজছাত্রীর মরদেহ উদ্ধার করা হয়। এরপর ৯ আগস্ট রাউজান উপজেলার হালদার নদীর শাখা খালে তলিয়ে যাওয়া শাহেদ হোসেন বাবু (৩৮) নামে একজনের মরদেহ উদ্ধার করা হয়।

তবে এখনো বন্যায় তলিয়ে গিয়ে এখনো নিখোঁজ রয়েছে একজন। তিনি সাতকানিয়ার পশ্চিম ঢেমশা এলাকার মো. ইমরান মোল্লা।

এসব তথ্য নিশ্চিত করে চট্টগ্রাম জেলা ত্রাণ ও পুনর্বাসন কর্মকর্তা সাফুল্লাহ মজুমদার বার্তা২৪.কমকে বলেন, রোববার পর্যন্ত বন্যায় চট্টগ্রাম সিটিসহ পাঁচ উপজেলায় ২০ জনের জনের মৃত্যু হয়েছে। এখনো একখন নিখোঁজ রয়েছে। বন্যায় মহানগরসহ ১৪ উপজেলায় রাস্তা-ঘাট, ঘর-বাড়ি, বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান সবমিলিয়ে ৩০০ কোটি টাকার বেশি ক্ষতি হয়েছে। এটি আর বাড়তে পারে। তাছাড়া ক্ষতিগ্রস্থ হয়েছে প্রায় ২ লক্ষ ৩ হাজার ৭২টির পরিবার। এখনো পানিবন্দি রয়েছে কয়েকহাজার পরিবার। তবে ধীরে ধীরে কমে যাচ্ছে।

এটি আমাদের একটি সম্ভাব্য তথ্য। উদ্ধার কার্যক্রম এখনো চলমান। ক্ষতি পরিমাণ আরও বাড়তে পারে বলেও জানান তিনি।


★দোহাজারী-কক্সবাজার রেললাইনে ক্ষতি:

বন্যায় শুধু দক্ষিণ চট্টগ্রামের ঘরবাড়ি নয়, সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে নির্মাণাধীন দোহাজারী-কক্সবাজার রেললাইন। ট্রেন চলাচল শুরুর আগেই এখানে লাইনের বিভিন্ন অংশে দেবে গেছে। এমন কি পানির স্রোতে তলিয়ে সরে গেছে লাইনের নিচে থাকা মাটি পাথর।

খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, সাতকানিয়ার কেরানিহাট ও তেমুহনী কেঁওচিয়া এলাকার দুই কিলোমিটার রেললাইনের অন্তত ২০ স্থানে দেবে গেছে। এসব এলাকায় রেললাইনের উপর দিয়ে দুই দিনের বেশি প্রবল স্রেতে হাটুঁ পরিমাণ পানি প্রবাহিত হয়েছে। অথচ আগামী সেপ্টেম্বর থেকে এই লেন দিয়ে ট্রেন কক্সবাজার যাওয়ার কথা ছিল। সরকারের অগ্রাধিকারভিত্তিক এ প্রকল্পে এ পর্যন্ত ৮৭ শতাংশ কাজ শেষ হয়েছে।

আকস্মিক এমন বন্যার জন্য চট্টগ্রাম-কক্সবাজার রেললাইন তৈরিকে দোষছেন স্থানীয়রা। তাদের দাবি, রেললাইনে তৈরির ফলে এই অঞ্চলের বেশ কয়েকটি উপজেলার মাঝামাঝি কৃত্রিম বাঁধের সৃষ্টি হয়েছে। আর তাতে বিঘ্ন ঘটছে পানি প্রবাহের।

রেললাইনকে বন্যার একমাত্র কারণ হিসেবে মানতে নারাজ সাতকানিয়া উপজেলা চেয়ারম্যান এম. এ মোতালেব। তার মতে গেল তিন দশকে এবার সবচেয়ে ভয়াবহ বন্যা হলেও এর সবচেয়ে বড় কারণ অতিবৃষ্টি, পাহাড়ি ঢল ও ওই অঞ্চলের নদীগুলোতে ধারণক্ষমতার বেশি পানি প্রবাহ। তবে রেললাইনকে দায়ি করার বিষয়টিও খুব বেশি অযৌক্তিক নয় বলে মত তার।

তিনি বলেন, বন্যার কারণ হিসেবে রেললাইনকে ১৫ থেকে ২০ শতাংশ দায়ি করা যেতে পারে। তবে সবচেয়ে বড় কারণ অতিবৃষ্টি। আমি পুরো জীবনেও এৃন বৃষ্টি দেখিনি। পাশ্ববর্তী হাঙর নদী, ডলু নদী ও শঙ্খতে ধারণ ক্ষমতার চেয়ে বেশি পানি প্রবাহিত হওয়ায় নদী তীর ভেঙে পানি লোকালয়ে চলে এসেছে। তাই এই বন্যাটা হয়েছে।


রেললাইনের কারণে বন্যার বিষয়টি সঠিক নয় বলে দাবি প্রকল্পটির পরিচালক মফিজুর রহমানের। তখন তিনি বলেন, রেললাইনের দুপাশে কিন্তু পানি সমান। দুপাশে পানি সমান থাকা মানে প্রয়োজনীয় কালভার্ট রয়েছে। রেললাইনের কারণে এক পাশের পানি আটকাতে পারে, উভয় পাশের পানি তো আর আটকাবে না৷ মূলত পানি প্রবাহের চেয়ে বৃষ্টি বেশি হচ্ছে। তাই পানি বঙ্গোপসাগরে গিয়ে সারতেছে না। বৃষ্টি বন্ধ হলে পানি থাকবে না।

তবে নবনির্মিত রেললাইন বন্যার একটা কারণ হলেও এর পেছনে আরও কিছু কারণ থাকতে পারে বলে মনে করছেন চুয়েটের নগর ও অঞ্চল পরিকল্পনা বিভাগের বিভাগীয় প্রধান অধ্যাপক ড. আসিফুল হক।

তিনি বার্তা২৪.কমকে বলেন, মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশনা রয়েছে যেন জলাধারে সড়ক নির্মাণের সময় ফ্লাইওভারের মত করে নির্মাণ করা হয়। এতে পানি প্রবাহ স্বাভাবিক থাকবে। আসলেই এটা, যতবেশি কালভার্ট, পানি প্রবাহ তত স্বাভাবিক। তাতে সড়ক বা অন্য কোনো স্থাপনাও ঠিক থাকবে। তবে স্টাডি না করে এটাকেই একমাত্র কারণ বলা যাবে না। আরো অনেক কারণ থাকতে পারে।

জলাধার ভরাট, নদীর গভীরতা হ্রাসও এই বন্যার অন্যতম কারণ হতে পারে বলে জানান এই অধ্যাপক।


★যথাসময়ে রেল চালুতে প্রভাব ফেলবে না:

বন্যার এ ক্ষয়ক্ষতি যথাসময়ে ট্রেন চালুর ক্ষেত্রে কোনো প্রভাব ফেলবে না বলে জানিয়েছেন প্রকল্প পরিচালক মফিজুর রহমান। তিনি বলেন, বন্যার কারণে সাতকানিয়া উপজেলার তেমুহনী মৌজায় আধ-কিলোমিটারের মতো অংশে ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে। বিশেষ করে পানির ঘূর্ণির কারণে রেললাইনের নিচের মাটি ক্ষয়ে গেছে। এগুলো ঠিক করার জন্য আলাদা টিম কাজ করবে। মূল প্রকল্পের সঙ্গে এটি সম্পৃক্ত নয়। প্রকল্পের কাজও চলবে আবার একইসঙ্গে মেরামতও চলবে। সুতরাং যথাসময়ে প্রকল্পের কাজ শেষ হবে।

রেললাইনে বন্যার বিষটি স্বাভাবিক উল্লেখ করে তিনি বলেন, সিলেট অঞ্চলে প্রায় সময় বন্যা হয়। ওই রোডে ট্রেন চলে না? তাছাড়া কক্সবাজার অংশে জলোচ্ছ্বাস হবে এই চিন্তা থেকে রেললাইন এমনিতে উঁচু করা হয়েছে। এটি মাটি থেকে প্রায় ২০ ফুট উঁচু। তবে সাতকানিয়া-লোহাগাড়া অংশে এবার পাহাড়ি ঢল নেমেছে। এরকম পানি স্বরণকালে হয়নি। প্রকল্পের ফিজিবিলিটি স্টাডির সময় অতীত অভিজ্ঞতার আলোকে সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়।

এখন যেহেতু এই পরিস্থিতি সৃষ্টি হয়েছে প্রয়োজনে রেললাইনের বিশেষ অংশ আরও উঁচু হবে বলে জানান প্রকল্প পরিচালক।


জানা গেছে, দোহাজারী থেকে রামু হয়ে কক্সবাজার পর্যন্ত ১০০ কিলোমিটার রেলপথ নির্মাণ প্রকল্প ২০১০ সালের ৬ জুলাই একনেকে অনুমোদন পায়। প্রকল্পের মেয়াদ শেষ হওয়ার কথা ২০২২ সালের ৩০ জুন পর্যন্ত। পরে এক দফা বাড়িয়ে প্রকল্পের মেয়াদ করা হয় ২০২৪ সালের ৩০ জুন পর্যন্ত। এতে ব্যয় ধরা হয়েছে ১৮ হাজার ৩৪ কোটি ৪৮ লাখ টাকা। প্রকল্পে ঋণ সহায়তা দিচ্ছে এশীয় উন্নয়ন ব্যাংক (এডিবি)। প্রকল্পের মেয়াদ বাড়লেও ব্যয় বাড়েনি।

২০১৬ সালের ২৭ এপ্রিল প্রকল্পটি ‘ফাস্ট ট্র্যাক প্রকল্প’ হিসেবে অন্তর্ভুক্ত হয়। রেলপথটি নির্মিত হলে মিয়ানমার, চীনসহ ট্রান্স এশিয়ান রেলওয়ের করিডোরে যুক্ত হবে বাংলাদেশ।

প্রথম পর্যায়ে দোহাজারী থেকে রামু হয়ে কক্সবাজার পর্যন্ত নির্মাণ করা হচ্ছে ১০০ কিলোমিটার রেলপথ। যার প্রায় ৮০ ভাগের বেশি কাজ শেষ হয়েছে। দ্বিতীয় পর্যায়ে রামু থেকে মিয়ানমারের কাছে ঘুমধুম পর্যন্ত ২৮ দশমিক ৭২৫ কিলোমিটার নতুন সিঙ্গেল লাইন ডুয়েল গেজ ট্র্যাক নির্মিত হবে।