'ইলা যেদ্দুর পারে এদ্দুর দিবো, এইডাতেই খুশি'
'শেখের বেটি আইছে আমরা খুশি, বাংলাদেশ স্বাধীন করছে ইলার বাহে, শেখে। ইলা যেদ্দুর পারে এদ্দুর দিবো। এইডাতেই আমরা খুশি।'
কথাগুলো বলছিলেন নরসিংদীর চর এলাকা গোপালদি থেকে সকাল সাতটায় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে দেখতে নরসিংদী আসা রাজু মিয়া। পেশায় কৃষক। নিজের যে জমি আছে তাতে কাজ করে সংসার চলে না। তাই অবসর সময়ে অন্যের জমিতে কাজ করেন কিছুটা বাড়তি আয়ের আশায়।
এই হতদরিদ্র রাজু মিয়াকে যখন জিজ্ঞেস করা হলো, ১৯ বছর পর প্রধানমন্ত্রী নরসিংদী আসছেন, কিছু চাওয়ার আছে কি না এমন প্রশ্নে তিনি বলেন, 'আমরা কর্ম কইরা ভাত খামু, দেশ স্বাধীন করছে এইডাই সারে। দেশ শাসন কইরা চললেই ভালা। আমরা খুশি।'
এমনই নানা বয়সের, নানা ধর্মের, নানা বর্ণের মানুষ এসে সকাল থেকে ভিড় জমিয়েছেন মুসলেহ উদ্দিন ভূঁইয়া স্টেডিয়ামের সামনে। আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর কড়াকড়িতে যদিও কাছে যাবার সুযোগ নেই তারপরও এই খেটে খাওয়া মানুষরা অধির আগ্রহে অপেক্ষা করছে প্রধানমন্ত্রীর।
হয়তো দূর থেকে, তারপরও নিজ চোখে একটু দেখতে চান জাতির পিতার কন্যাকে। কাছ থেকে শুনতে চান তার কথা। তাদের চাওয়া এইটুকুই।
গায়ে পুরাতন শার্ট সাথে লুঙ্গি, দাড়িতে সাদা রঙ ধরেছে আলাউদ্দিনের। তাড়াহুড়া করে হেঁটে যাচ্ছিলেন স্টেডিয়ামের দিকে। এত তাড়া কিসের জিজ্ঞেস করতেই বলেন, ‘প্রধানমন্ত্রী আসবেন, তিন দিন ধরেই খাওয়া দাওয়া নাই। সারাদিন কাজ করে সময় পাইনি তাই বাসায় গেছিলাম খাইতে। এইদিকে সাড়ে তিনটায় প্রধানমন্ত্রী চলে আসবেন সে জন্যই এতো তাড়াহুড়া।’
১৯ বছর পর প্রধানমন্ত্রী আসছেন নরসিংদীতে, কি চান তার কাছে?- এমন প্রশ্নে তিনি বলেন, ‘কিছু চাওয়ার নেই। যা চাইতাম তার চেয়েও বেশি তিনি আমাদের দিয়েছেন। এখন আমাদের দেয়ার পালা। সামনে নির্বাচন আসছে, সে নির্বাচনে তাকে আবার প্রধানমন্ত্রী বানাতে পারলেই আমি খুশি।’
আমাদের চাওয়া একটি পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয় ও একটি মেডিকেল কলেজ। প্রশ্নের জবাবে এমনটা জানালেন মুক্তিযোদ্ধা সফিকুল আলম। তিনি বলছিলেন, ‘আজকে আমাদের নেত্রী নরসিংদী আসাতে আমরা অত্যন্ত আনন্দিত। আমরা চাই আমাদের নেত্রী আগামী ইলেকশনেও যেন পাশ করেন। নরসিংদী জেলার পাঁচটি আসন থেকেই আমরা চেষ্টা করব তাকে পাশ করিয়ে আনতে।‘
সফিকুল আরও বলেন, ‘আমাদের চাওয়া পাওয়ার খুব বেশি কিছু নাই। কারণ আমরা অনেক কিছু পেয়েছি। যা পেয়েছি তাতেই আমরা আনন্দিত।’
স্টেডিয়ামের কাছেই রাস্তায় দেখা হয় একাদশ শ্রেণির প্রথম বর্ষে পড়া সাফওয়ান, আকিব, আমিরুল, ফাইয়াজ ও তানভির এই পাঁচ বন্ধুর সাথে। মাথায় জাতীয় পতাকা বেধে আসছেন প্রধানমন্ত্রীকে দেখতে। প্রধানমন্ত্রী আসায় ঈদ আনন্দ শুরু হয়েছে জানিয়ে তাদের একজন বলেন, পুরো জেলা জুড়েই একটা উৎসব আমেজ শুরু হয়ে গেছে।
নরসিংদীতে এই প্রথম প্রধানমন্ত্রী আসছেন, তাই অনেক খুশি বলে জানাচ্ছিলেন তানভীর। পাশ থেকেই আমিরুল সে কথা ঠিক করে দিয়ে বলেন, ‘শুনেছি প্রধানমন্ত্রী আগেও ২০০৪ সালে নরসিংদী এসেছিলেন। তবে তখন আমরা দেখিনি। আমাদের জন্মও হয়নি। কিন্তু এখন যখন আসছে, তখন তার আগমনে আমরা অনেক খুশি। এই শহরের মানুষ খুশি।’
প্রধানমন্ত্রীর কাছে তাদের কোনো চাওয়া-পাওয়া আছে কিনা জানতে চাইলে তারা জানায়, ‘আমাদের এই শহর এখন অনেক উন্নত, রাস্তাঘাট সব দিক দিয়েই অনেক উন্নয়ন করেছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। তার কাছে আমাদের চাওয়া-পাওয়ার কিছুই নেই। তবে তিনি যদি আমাদের একটি পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয় ও একটি মেডিকেল কলেজ উপহার দেন তাহলে আমাদের সকল অপূর্ণতা দূর হবে। তার কাছে আমাদের শুধু এটুকুই চাওয়া।’
সরেজমিনে সারাদিন ঘুরে ও মানুষের সাথে কথা বলে জানা যায়, তারা প্রধানমন্ত্রীর উন্নয়নে খুশি। না চাইতেই তিনি এই শহরের জন্য যে উন্নয়ন করেছেন তাতে তারা উৎফুল্ল।
রাস্তা-ঘাট, মসজিদ-মাদ্রাসা, স্কুল-কলেজ সব জায়গায় আওয়ামী লীগ সরকারের উন্নয়নের ছোঁয়া। তবে একটাই অপূর্ণতা, আক্ষেপ একটি সরকারি বিশ্ববিদ্যালয় ও মেডিকেল কলেজের দীর্ঘদিনের চাওয়া এলাকাবাসীর। এই অপূর্ণতা ঘুচলেই যেন উন্নয়নের ষোলোকলা পূর্ণ হবে এই মানুষদের।
উল্লেখ্য, দীর্ঘ ১৯ বছর পর আওয়ামী লীগের সভাপতি ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা নরসিংদী এসেছেন। এদিন তিনি নরসিংদীর পলাশে দক্ষিণ এশিয়ার সর্ববৃহৎ পরিবেশবান্ধব ঘোড়াশাল-পলাশ ইউরিয়া সার কারখানার উদ্বোধন করেন।
জ্বালানি সাশ্রয়ী ও পরিবেশবান্ধব এই কারখানায় বছরে ৯ লাখ ২৪ হাজার মেট্রিক টন ইউরিয়া সার উৎপাদন হবে। দৈনিক উৎপাদন হবে ২ হাজার ৮০০ মেট্রিক টন। এই প্রকল্পটি বাস্তবায়নে ব্যয় হয়েছে ১৫ হাজার ৫০০ কোটি টাকা।
প্রকল্প সংশ্লিষ্টরা জানান, ২০১৮ সালের অক্টোবরে কারখানার নির্মাণকাজ শুরু হয়। ২০২০ সালে বিশ্বজুড়ে করোনা মহামারি শুরু হলে প্রকল্পের অবকাঠামোর কাজ বাধাপ্রাপ্ত হয়। পরে একই বছরের ১৬ আগস্ট পূর্ণোদ্যমে কাজ শুরু হয়।
কাজের দায়িত্ব পায় চীনের সিসি সেভেন এবং জাপানের ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান মিৎসুবিশি হেভি ইন্ডাস্ট্রিজ লিমিটেড। এরপর ২০২২ সালের ২১ এপ্রিল প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা আনুষ্ঠানিকভাবে এই প্রকল্পের ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন করেন।
১১০ একর জমির ওপর নির্মিত প্রকল্পটি বাস্তবায়নে বাংলাদেশ সরকার ৪ হাজার ৫৮০ কোটি ২১ লাখ টাকা আর জাপান ও চীনের ঠিকাদারদের যৌথ কনসোর্টিয়াম ব্যাংক অব টোকিও-মিৎসুবিশি ইউএফজে লিমিটেড ও দ্য হংকং অ্যান্ড সাংহাই ব্যাংকিং করপোরেশন লিমিটেড ১০ হাজার ৯২০ কোটি টাকার ঋণ দেয়।
এছাড়াও মোট ১৬ হাজার কোটি টাকা ব্যয়ে আরও ১১টি উন্নয়ন প্রকল্পের উদ্বোধন করবেন তিনি।