'সেদিন এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ে থাকলে মা হয়তো বেঁচে যেতেন'

  • সীরাত মঞ্জুর, স্টাফ করেসপন্ডেন্ট, বার্তা২৪.কম, চট্টগ্রাম
  • |
  • Font increase
  • Font Decrease

ছবি: বার্তা২৪.কম

ছবি: বার্তা২৪.কম

আমি এই সড়কে যানজটের মধ্য দিয়ে আমার মাকে হারিয়েছিলাম। এই জ্যামের মধ্যে আমার মা অনেক কষ্ট পেয়েছিলেন। ২০১৮ সালে আমার মা স্ট্রোক করেছিলেন, বাড়ি থেকে অসুস্থ মাকে নিয়ে হাসপাতালে যাওয়ার সময় অনেক যানজটের মধ্যে পড়েছিলাম। জিইসি মোড়ে মেডিকেল সেন্টারের কাছাকাছি যেতেই মা মারা যান। সেদিন এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ে থাকলে মা হয়তো বেঁচে যেতেন। আমার মাকে দ্রুত হাসপাতালে নিয়ে যেতে পারতাম।

মঙ্গলবার (১৪ নভেম্বর) দুপুরে উদ্বোধনের পর চট্টগ্রামের এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ের ওপর দাঁড়িয়ে আক্ষেপ করে এসব কথা বলেন পতেঙ্গার স্টিল মিল এলাকার মোঃ সালাউদ্দিন।

বিজ্ঞাপন

সালাউদ্দিনের সঙ্গে বার্তা২৪.কমের কথা হয় নবনির্মিত এই উড়ালপথের টাইগার পাস প্রান্তে। দেড় ঘণ্টার পথ মাত্র ১৫ মিনিটে পাড়ি দিয়ে তার চোখে-মুখে উচ্ছ্বাস। অনুভূতির কথা জানিয়ে তিনি বলেন, এই অনুভূতি প্রকাশ করার ভাষা জানা নেই। আমি এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ে দিয়ে পতেঙ্গা থেকে এখানে (টাইগাস পাস) এসেছি, সময় লেগেছে মাত্র ১৫ মিনিট। নিচের সড়কপথে আসতে গেলে দেড় থেকে দু'ঘণ্টা পর্যন্ত সময় লেগে যেত।

উড়ালপথ থেকে পাখির চোখে শহরটাকে দেখলেন জানিয়ে তিনি বলেন, একটি কথা ছিল পাখির চোখে এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ে। আমি হয়তো এই পথ পাড়ি দেওয়ার সময় পাখি ছিলাম। পাখির মতো দেখলাম চতুর দিকে খুব সুন্দর এবং খুবই মনোরম পরিবেশ। একটা অঞ্চলের জন্য এর চেয়ে ভালো কিছু হতে পারে না। যোগাযোগ ব্যবস্থা যে দেশে ভালো, সেই দেশের মানুষ উন্নত জীবনগ-যাপন করতে পারে।

বিজ্ঞাপন

সালাউদ্দিন সঙ্গে কথা শেষ হতেই দেখা হয় পতেঙ্গার কাটগড় এরাকার বাসিন্দা মোহাম্মদ ইলিয়াস। তিনিও প্রধানমন্ত্রীকে ধন্যবাদ জানান এবং বলেন, প্রধানমন্ত্রী এটি করে আমাদের চলাচলের জন্য একটা সুব্যবস্থা করে দিয়েছেন। আগে আমরা চট্টগ্রাম শহরের টাইগার পাস জিসি মোড় বা হাসপাতাল যেতে তিন ঘণ্টার অধিক সময় লেগে যেত। এখন এই উড়ালপথ দিয়ে ১৫ মিনিটে আসা-যাওয়া করতে পারব। আমি পতেঙ্গা থেকে টাইগার পাস মোরে ১৫ মিনিটে চলে এসেছি।

এটি শুধু আমাদের পতেঙ্গার মানুষের জন্য না, যারা ব্যবসা-বাণিজ্য করেন এবং ভ্রমণ করেন তাদের জন্য অত্যন্ত অসুবিধাজনক হয়েছে। যেটা অকল্পনীয়। এটির মাধ্যমে ভবিষ্যতে যানজট নিরসন হবে। যানজট নামের অভিশাপ থেকে মুক্ত হয়েছি।

দ্রুত এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ে পেয়ে আনন্দিত শহরের টাইগার পাস এলাকার যুবক মুজিবুল হক রুমেনও। তিনি বলেন, আমরা আর মাত্র ১৫ মিনিটে পতেঙ্গা দেখব। আবার ১৫ মিনিটে পতেঙ্গা থেকে টাইগার পাস দেখব। এত দ্রুত করে দেওয়ার জন্য প্রধানমন্ত্রীকে ধন্যবাদ জানাই।

দেশের দ্বিতীয় বৃহত্তম এই উড়ালপথের নির্মাণ কাজে সিকিউরিটি সুপারভাইজার হিসেবে দায়িত্বে পালন করছেন রাউজানের মোঃ আবুল কালাম। এত বড় প্রকল্পের অংশ হতে পরে নিজেকে গর্বিত মনে করে বার্তা২৪.কমকে তিনি বলেন, আমি এমন একটি প্রকল্পে কাজের দায়িত্ব পেয়ে অনেক অনেক আনন্দিত, নিজেকে গর্বিত মনে করছি। আমি নিজেও একজন চট্টগ্রামের সন্তান। চট্টগ্রামবাসীর জন্য এটি অনেক উপকার হয়েছে, এ অঞ্চলে মানুষ এটির ঋণ শোধ করতে পারবে না।

এর আগে, মঙ্গলবার সকাল ১১টায় গণভবন থেকে ভিডিও কনফারেন্সে যুক্ত হয়ে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ‘মেয়র মহিউদ্দিন চৌধুরী-সিডিএ ফ্লাইওভার’ নামে এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ে প্রকল্পের উদ্বোধন করেন। এরপর দুপুর ১২টা থেকে বিকেল ৩টা পর্যন্ত মাত্র তিন ঘণ্টার জন্য খুলা রাখা হয় এই উড়ালপথ।

উদ্বোধনের পর চট্টগ্রাম উন্নয়ন সংস্থার (সিডিএ) চেয়ারম্যান জহিরুল আলম দোভাষ সাংবাদিকদের বলেন, এ এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ের কারণে চট্টগ্রামের মানুষের অনেক উপকার হবে। বিমানবন্দর থেকে লালখান বাজারে মাত্র ২০ মিনিটে পৌঁছা যাবে। ওই এলাকার লোকজন যারা মেডিকেল বা বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ জায়গায় যেতে দুই-তিন ঘণ্টা লাগত সেখানে খুব সহজেই অল্প সময়ে পৌঁছাতে পারবে। এ উড়াল সড়কের কারণে চট্টগ্রাম শহরের সঙ্গে অনেক জেলার যোগাযোগ সহজ হবে। মাতারবাড়িতে যে গভীর সমুদ্র হচ্ছে সেটাও এ এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ের কারণে উপকার পাবে। বাকি কাজ শেষ হলেই এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ে পুরোপুরি খুলে দেওয়া হবে।

সিডিএর প্রধান প্রকৌশলী কাজী হাসান বিন শামস সাংবাদিকদের বলেন, চট্টগ্রামের যোগাযোগ নেটওয়ার্কিংয়ে এক্সপ্রেসওয়ে অন্য একটি মাত্রায় নিয়ে গেল। বিগত ১৫ বছরে প্রধানমন্ত্রী চট্টগ্রামকে সত্যিকারের বাণিজ্যিক রাজধানী গড়তে বিভিন্ন উন্নয়নমূলক প্রকল্প নিয়েছেন। এরমধ্যে মেয়র মহিউদ্দিন চৌধুরী সিডিএ এক্সপ্রেসওয়ে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখবে। আমরা এ প্রকল্পটি মূলত বঙ্গবন্ধু টানেল প্রকল্পের সঙ্গে সমন্বয় করে শেষ করতে চেয়েছি। যেন শহরের যানজটের ভোগান্তি এড়িয়ে শহর থেকে সহজে পতেঙ্গা প্রান্তে আসা যায় এবং পতেঙ্গা থেকে আনোয়ারা প্রান্তে যাওয়া যায়। আমরা এই এক্সপ্রেসওয়ের এ মাসের মধ্যেই খুলে দেব। আর লালখান বাজার অংশের কাজ আগামী মাসে শেষ করে তারপর উন্মুক্ত করা হবে। আপাতত টাইগার পাস দিয়ে এক্সপ্রেসওয়ের যাতায়াতের ব্যবস্থা করা হচ্ছে।

আগামী বছরের শুরুতে এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ে পুরোদমে চালু হওয়ার কথা রয়েছে। এটি হলে নগরীর যানজট অনেকাংশ দূর হবে বলে জানান সিডিএর নির্বাহী প্রকৌশলী ও প্রকল্প পরিচালক মোঃ মাহফুজুর রহমান। তিনি বলেন, এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ে চালু হলে শুধু চট্টগ্রাম নগরীর মানুষ নন, উত্তর ও দক্ষিণ জেলার মানুষেরাও উপকৃত হবেন। আগামী বছরের জানুয়ারির শেষে অথবা ফেব্রুয়ারির শুরুতে পুরোপুরি প্রস্তুত হয়ে যাবে এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ে।

নগরীর যানজট নিরসনের লক্ষ্যে ২০১৭ সালের ১১ জুলাই একনেক সভায় এ প্রকল্প অনুমোদন করা হয়। প্রথমে প্রকল্পের ব্যয় ৩ হাজার ২৫০ কোটি ৮৩ লাখ টাকা ধরা হয়। তিন বছরের মধ্যে অর্থাৎ ২০১৭ সালের জুলাই থেকে ২০২০ সালের জুন পর্যন্ত প্রকল্পের কাজ শতভাগ শেষ হওয়ার কথা থাকলেও তা হয়নি। দ্বিতীয় দফায় ২০২২ সালের জুন পর্যন্ত সময় বাড়ানো হয়। মেয়াদ শেষ হওয়ার আগেই তৃতীয় দফায় ২০২৪ সালের জুন পর্যন্ত সময় বাড়ানোর প্রস্তাব করা হয়। এ দফায় সময় বেড়েছে এক বছর। অর্থাৎ ২০২৩ সালের জুনে কাজ শেষ হওয়ার কথা ছিল।