চট্টগ্রামে খাবারের জন্য হোটেলে, গাড়ির জন্য সড়কে হাহাকার
‘অফিস বন্ধ থাকায় ভেবেছিলাম দিনভর বাসায় অবসর সময় কাটাব, বাচ্চাদের সময় দেব। কিন্তু কোথায় কি? সকাল থেকে গ্যাস না থাকায় দৌড়ঝাঁপ করতে হচ্ছে। সকালে কোনোরকমে পাউরুটি-জেলি দিয়ে খেলাম। এখন দুপুরে খেতে বাইরে এসে দেখি রেস্তোরাঁয়ও সংকট।’
বাসায় রান্না না হওয়ায় দুপুরে সন্তানদের নিয়ে চকবাজার এলাকার একটি রেস্তোরাঁয় খেতে এসে কথাগুলো বলছিলেন চট্টগ্রাম নগরীর একটি বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে কর্মরত জাহাঙ্গীর।
চট্টগ্রামজুড়ে গ্যাস সংকট চলছে বহুদিন ধরেই। বেশিরভাগ এলাকায় প্রায় দিনভর বন্ধ থাকত গ্যাস সরবরাহ। এই কারণে ভোগান্তিতে আছেন নগরবাসী। কিন্তু এবারের ভোগান্তি যেন সবকিছুকেই ছাড়িয়ে গেল।
শুক্রবার (১৯ জানুয়ারি) সকাল থেকে বন্দরনগরীর কোথাও জ্বলছে না চুলা। একই কারণে সিএনজিচালিত গাড়িও সড়কে চলছে কম। ফলে ঘরে-বাইরে দুর্ভোগে পড়েছেন নগরবাসী।
চাহিদার তুলনায় সরবরাহ কম থাকায় শীত মৌসুমের শুরু থেকেই গ্যাসের সংকট শুরু হয়। কিছু কিছু এলাকায় গ্যাস থাকলেও বেশিরভাগ এলাকায় সকাল ৮টা থেকে রাত ১১টা পর্যন্ত গ্যাস থাকত না। কিন্তু মহেশখালীর এলএনজি (তরলীকৃত ন্যাচারাল গ্যাস) সরবরাহের এফএসআরইউয়ের (ফ্লোটিং স্টোরেজ রি-গ্যাসিফিকেশন ইউনিট) কারিগরি ত্রুটির কারণে চট্টগ্রাম এলাকায় শুক্রবার সকাল থেকে গ্যাস সরবরাহ বন্ধ হয়ে যায়। জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ বিভাগ থেকে বিজ্ঞপ্তি দিয়ে বিষয়টি জানানো হয়। পাশাপাশি চট্টগ্রামে গ্যাস সরবরাহের দায়িত্বে থাকা প্রতিষ্ঠান কর্ণফুলী গ্যাস ডিস্ট্রিবিউশন কোম্পানি লিমিটেডও (কেজিডিসিএল) তাদের ওয়েবসাইটে একই বিষয়টি জানিয়েছে।
গ্যাস না থাকায় সকাল থেকেই ঘরে ঘরে শুরু হয় রান্না নিয়ে ভোগান্তি। সাপ্তাহিক ছুটির দিন হওয়ায় বেশিরভাগ মানুষই আছেন বাসায়। ফলে সকাল থেকে চুলা না জ্বলায় অনেকে ছোটেন দোকানে-রেস্তোরাঁয়। কিন্তু বন্ধের দিন হওয়ায় বেশিরভাগ মুদি দোকানেই পাউরুটির মতো শুকনা খাবারের মজুত ছিল না। ফলে শুরুতেই সকালের নাশতা নিয়ে ভোগান্তিতে পড়েন মানুষ। এরপর শুরু হয় দুপুরের খাওয়ার জন্য তোড়জোড়। খাবারের জন্য হোটেলে হোটেলে ভিড় জমান অনেকেই।
গ্যাস না থাকায় অনেকে নতুন করে সিলিন্ডার-চুলা কিনতে বাধ্য হয়েছেন। তাঁদেরই একজন নগরীর চান্দগাঁওয়ের বাস টার্মিনাল এলাকার বাসিন্দা ফজিলাতুন নেছা। এই নারী বলেন, ‘বেশ কিছুদিন ধরে সকাল ৮টা থেকে রাত ১১টা পর্যন্ত গ্যাস থাকছে না। সেজন্য ভোরে উঠে দিনভরের রান্না সেরে নিতাম। কিন্তু শুক্রবার ভোর থেকেই কোনো গ্যাস নেই। সেজন্য বাধ্য হয়ে সিলিন্ডার ও নতুন চুলা কিনতে হয়েছে।’
অন্যদিকে নিম্ন আয়ের মানুষেরা ঝুঁকেছেন মাটি ও তেলের চুলার দিকে। মুরাদপুর এলাকার একটি বস্তিতে বসবাস করেন শাকিলা খাতুন। বিভিন্ন বাসাবাড়িতে কাজ করে সংসারের ব্যয় সামলান এই নারী। তিনি বলেন, ‘গ্যাস না থাকায় মাটির চুলায় দুপুরের রান্না সেরেছি। আমাদের তো আর গ্যাস না থাকলে সিলিন্ডার কিনে রান্নার সামর্থ্য নেই।’
এদিকে গ্যাস সরবরাহ বন্ধ থাকায় বেশিরভাগ ফিলিং স্টেশনেও সংকট শুরু হয়েছে। এ কারণে সিএনজিচালিত বেশিরভাগ গাড়ি সড়কে বের হয়নি। যেগুলো বের হয়েছে সেগুলোও এই সুযোগে যাত্রীদের পকেট কাটা শুরু করে দিয়েছে।
শুক্রবার দুপুর থেকে বিকেল পর্যন্ত নগরীর বহদ্দারহাট, চকবাজার, মুরাদপুর, দু নম্বর গেট, জিইজি, কাজির দেউড়ি ও মেহেদীবাগ এলাকায় ঘুরে দেখা গেছে সড়কের মোড়ে মোড়ে অপেক্ষামাণ মানুষদের ভোগান্তি। কোনো একটি গণপরিবহন এলেই ঝুঁকি নিয়ে দৌড়াদৌড়ি করে উঠছেন যাত্রীরা।
দুপুরে বহদ্দারহাট মোড়ে দেখা গেছে, যাত্রীদের অস্বাভাবিক ভিড়। বহদ্দারহাট-আমতল রুটে সিএনজিচালিত টেম্পো চলাচল করে। সেই টেম্পোগুলোতে সর্বনিম্ন ভাড়া অন্যান্য সময়ে পাঁচ টাকা হলেও যাত্রীর চাপ বাড়ায় দ্বিগুণ করে নেওয়া হচ্ছে। গাড়িতে যাত্রী উঠার আগেই, চালক বলে দিচ্ছেন, ‘উঠানামা পাঁচ টাকা।’
শামসুল ইসলাম নামের এক যাত্রী ক্ষুব্ধ হয়ে বলেন, ‘গ্যাস নেই সেটির দোষ কি আমাদের? আমাদের কাছ থেকে কেন বাড়তি ভাড়া আদায় করা হবে?।
একইভাবে চকবাজার-আগ্রাবাদ রুট, মুরাদপুর-অক্সিজেন রুট এবং দু নম্বর গেট-বায়েজিদ রুটে চলাচল করা টেম্পোগুলোতেও দ্বিগুণ ভাড়া আদায় করতে দেখা গেছে।
গ্যাসের সমস্যা সমাধানে কাজ চলছে বলে জানিয়েছেন কেজিডিসিএলের মহাব্যবস্থাপক (অপারেশন) আমিনুর রহমান। তিনি বলেন, ‘কারিগরি ত্রুটির কারণে এলএনজি সরবরাহ কম থাকায় চট্টগ্রাম এলাকায় গ্যাসের স্বল্পচাপ বিরাজ করছে। সাময়িক অসুবিধার জন্য কেজিডিসিএল কর্তৃপক্ষ আন্তরিকভাবে দুঃখিত।’