দেশি মাছ সংকটে হতাশায় শুঁটকি পল্লীর বাসিন্দারা
দেশি প্রজাতির মৎস্য অঞ্চল হিসেবে পরিচিত বরিশালের আগৈলঝাড়া উপজেলার রাজাপুর ও তার পার্শ্ববর্তী রামশীল শুঁটকি পল্লীতে চলছে ভরা মৌসুম। এ পল্লীর শুঁটকির চাহিদা রয়েছে বিদেশেও। তবে দেশি প্রজাতির মাছ সংকটে হতাশায় ভুগছেন পল্লীতে জীবিকা নির্বাহ করা পরিবারগুলোর সদস্যরা।
রোববার (১১ ফেব্রুয়ারি) দুপুরে শুঁটকি পল্লীর বাসিন্দাদের সঙ্গে আলাপ করে জানা গেছে, আগের তুলনায় পুঁটি, দেশি সরপুঁটি, পাবদা, কই, শোল, রয়না, খলসেসহ বিভিন্ন প্রজাতির মাছের সংখ্যা অনেকাংশে কমে গেছে। তাই ভরা মৌসুমেও আগের তুলনায় কাজ অনেক কমে গেছে।
আগৈলঝাড়া উপজেলার পশ্চিম সীমান্তবর্তী বাকাল ইউনিয়নের রাজাপুর গ্রামের শুঁটকি ব্যবসায়ী অবনী রায় জানান, এ অঞ্চলের পাঁচ শতাধিক পরিবার শুঁটকির ব্যবসার সাথে জড়িত। একপাশে পয়সারহাট নদী, অন্যপাশে কোটালীপাড়ার বিল এলাকার মধ্যবর্তী পয়সারহাট, ত্রিমুখী ও রাজাপুর গ্রামের বিভিন্ন এলাকায় গড়ে উঠেছে শুঁটকি পল্লী। পল্লীতে প্রক্রিয়াজাত করা বিলের স্বাদু বা মিঠাপানির নানা প্রজাতির মাছের শুঁটকি অতীতে দেশের অভ্যন্তরীণ চাহিদা মিটিয়ে বিদেশেও রপ্তানি করা হয়েছে। বিশেষ করে ঢাকা, চট্টগ্রাম, সিলেট অঞ্চল ও ভারতের আগরতলা পর্যন্ত এখানকার শুঁটকির চাহিদা রয়েছে। শুঁটকি পল্লীর সাথে জড়িত পরিবারগুলো মৌসুমি ব্যবসায় লাভের আশায় বছরের আশ্বিন মাসের প্রথম থেকে ফাল্গুন মাস পর্যন্ত ছয় মাস নিয়োজিত থাকে। এখানকার শুটকির চাহিদা রয়েছে ঢাকা ও চট্টগ্রামের বাজারেও। দেশি-বিদেশি পাইকাররা এসে এখান থেকে শুঁটকি নিয়ে যান। আবার ঢাকার কারওয়ান বাজারে গিয়েও পল্লীর ব্যবসায়ীরা শুঁটকি বিক্রি করেন। তবে অধিকাংশ ব্যবসায়ীরা মহাজনের কাছ থেকে দাদন ও স্থানীয় বিভিন্ন মাধ্যমে চড়া সুদে ঋণ নিয়ে ব্যবসা করলেও মৌসুম শেষে ওই দাদন ও ঋণের টাকা পরিশোধ করে তাদের হাতে আর তেমন কিছুই থাকে না।
স্থানীয় নিখিল মণ্ডল ও মহাদেব বাড়ৈ জানান, একযুগেরও অধিক সময় ধরে ভৌগলিক পরিবেশের কারণে বাণিজ্যিকভাবে গড়ে ওঠা পয়সারহাট, রাজাপুর ও ত্রিমুখী শুঁটকি পল্লীতে দেশি প্রজাতির বিভিন্ন প্রকার মাছের মধ্যে পুঁটি, শোল, টেংরা, খলসে, পাবদা, কই, শিং, মাগুর, মেনি, ফলি, বজুরি, বাইম মাছের ব্যাপক কদর ছিল। শুঁটকি পল্লীতে দেশি প্রজাতির মাছগুলো কেটে, পানিতে পরিস্কার করে প্রাকৃতিক নিয়মে রোদে শুকিয়ে বিক্রির জন্য মজুত করা হয়। এখানকার শুঁটকি পল্লীতে ফরমালিনের মতো বিষাক্ত কোনো রাসায়নিক মাছে মেশানো হয় না। তাই সবখানে এ পল্লীর শুঁটকির কদর রয়েছে।
ব্যবসায়ী অখিল মণ্ডল জানান, চাহিদার মধ্যে ক্রেতাদের প্রধান আকর্ষণ পুঁটি মাছের শুঁটকিতে। ব্যবসায়ী মনমথ রায়, অশোক রায়, জয়নাল চৌকিদার, মঙ্গল অধিকারী, নরেশ তালুকদার বলেন, বাজার থেকে এক মণ কাঁচা মাছ কিনে শুকানোর পর ১৫ থেকে ২০ কেজি শুঁটকি মাছ পাওয়া যায়। গড়ে প্রায় তিন মণ কাঁচা মাছ শুকালে এক মণ শুঁটকি মাছ পাওয়া যায়। এক মণ পুঁটি মাছের শুঁটকি আট থেকে নয় হাজার টাকায় বিক্রি করা হয়। পল্লীতে মাছ কাটায় নিয়োজিত রাজাপুর গ্রামের সন্ধ্যা অধিকারী, আয়না বেগম, পপি অধিকারী, শোভা রানী জানান, বছরের ছয় মাস মাছ কাটার কাজে নিয়োজিত থাকলেও বাকি ছয়মাস কাটে তাদের অনেকটা অর্ধাহারে-অনাহারে।
তারা বলেন, ছেলে-মেয়েরা স্কুলে লেখাপড়া করছে। মাছ কেটে যা আয় হয়, তা দিয়ে বহু কষ্টে জীবনযাপন করতে হচ্ছে। তারা আরও জানান, শুকনো মৌসুমের শুরুতে দেশি মাছ বেশি পাওয়া গেলেও কার্তিক মাসের পর বিলে মাছ কম থাকায় তাদের দুঃখ দুর্দশা আরও বেড়ে গেছে। দেশি মাছ কমে যাওয়ায় তাদের মধ্যে হতাশাও কাজ করছে।
শুঁটকি ব্যবসায়ী রাজাপুরের অবনী রায় জানান, সরকারিভাবে সহজ শর্তে ঋণ না পাওয়ায় তারা বছর শেষে ঋণের জালে আটকেই থাকছেন।
শুঁটকি পল্লীর সাথে জড়িত পরিবারগুলো বছরের পর বছর সরকারের সংশ্লিষ্ট বিভাগের কাছে সহজ শর্তে ঋণ দাবি করে আসলেও বরাবরই তা উপেক্ষিত হয়ে আসছে।