রেডিমেডের উত্থানে টেইলারিং ব্যবসায় ধ্বস

  • ডিস্ট্রিক্ট করেসপন্ডেন্ট বার্তা২৪.কম, রাজশাহী
  • |
  • Font increase
  • Font Decrease

ছবি: বার্তা ২৪.কম

ছবি: বার্তা ২৪.কম

টেইলারিং শিল্প দীর্ঘদিন ধরে অনেকের জীবিকা এবং শিল্পকলার এক অপরিহার্য অংশ হিসেবে গণ্য হয়েছে। এই রংবেরঙের বাজারে, টেইলারিং দোকানগুলো বিবিধ উৎসবের পোশাক থেকে শুরু করে প্রতিদিনের পরিধেয় পর্যন্ত সব কিছুর জন্য গ্রাহকদের এক অদ্বিতীয় সমাধান প্রদান করে আসছিল। তবে, সম্প্রতি বদলে যাওয়া ফ্যাশনের চাহিদা এবং প্রযুক্তির উন্নতির ফলে টেইলারিং পোশাকের চাহিদা ক্রমশ কমে আসছে। এই পরিবর্তন শুধু ফ্যাশন শিল্পের গতিপথ পরিবর্তন করছে না, বরং অনেক টেইলারদের জীবিকা এবং তাদের শিল্পের ভবিষ্যতের উপরও গভীর প্রভাব ফেলছে।

রেডিমেড পোশাকের বাজারের উত্থানের ফলে বাংলাদেশের ট্র্যাডিশনাল টেইলারিং শিল্প গভীর সংকটে মুখোমুখি হয়েছে। এই পরিবর্তনের কারণে অনেক ছোট ও মাঝারি সাইজের টেইলারিং ব্যবসায়ীরা তাদের পেশা ও উপার্জনের পথ হারিয়ে ফেলছেন।

বিজ্ঞাপন

প্রতিবছর ঈদুল ফিতরের আগে দম ফেলবার ফুরসত থাকে না দর্জিদের কর্মব্যস্ততায়। কিন্তু এবারের চিত্র একদম ভিন্ন। চিরচেনা সেই ব্যস্ততা এবার আর নেই দর্জিপাড়ায়। ঈদ বাজারের শেষ প্রান্তে এসেও দুঃখ ঘোচেনি রাজশাহীর টেইলার্স ব্যবসায়ীদের।

তারা বলছেন, প্রতিবছর রমজানের শুরু থেকেই ঈদুল ফিতরের নতুন কাপড় তৈরির ভিড় লেগে যেত দর্জিপাড়ায়। ঈদ যত এগিয়ে আসে দর্জিপাড়ার কারিগরদের ব্যস্ততাও ততই বাড়তে থাকে। কিন্তু আধুনিকতার ছোঁয়ায় চাহিদা কমেছে টেইলারিং পোশাকের।

বিজ্ঞাপন

ব্যবসায়ীরা জানান, সাশ্রয়ী দামে ভালো মানের কাপড় পেয়ে যাওয়ার কারণে রেডিমেড পোশাক ক্রেতাদের কাছে আরো আকর্ষণীয় হয়ে উঠছে। পাশাপাশি, সুতা এবং কর্মচারীদের মজুরি বাড়ার ফলে সেলাই খরচ বৃদ্ধি পেয়েছে, যা ব্যবসায়ীদের খরচ বাড়াতে বাধ্য করেছে। এর ফলে ক্রেতা সংখ্যায় প্রভাব পড়েছে। আর সর্বত্র টেইলার্স প্রতিষ্ঠান গড়ে তোলার কারণে প্রায় সবাই ক্রেতা হারাচ্ছে। তবে, অত্যধিক লোডশেডিং অনেককেই প্রচন্ড সমস্যায় ফেলছে।

নগরীর সাহেববাজার, গণকপাড়া, নিউ মার্কেট এবং স্টেশন মার্কেটের টেইলার্সগুলোতে পরিদর্শন করে দেখা গেছে, অর্ডারের চাপ কম থাকায় কর্মচারীদের কাজের গতি ধীর। অন্যান্য সময়ে যেখানে রাতভর সেলাই করেও কাজের চাপ সামলাতে হয়, এবার তেমন কোনো চাপ নেই। বেশির ভাগ মালিক ও কর্মচারী রাত ১০ থেকে ১২ টার মধ্যেই বাড়ি ফিরছেন। এছাড়াও, অনেকে প্রখর তাপদাহ সত্ত্বেও ক্রেতার অপেক্ষায় বসে আছেন।

নগরীর সাহেববাজার এলাকার মডার্ন টেইলার্সের দর্জি রফিকুল ইসলাম বলেন, এবার ব্যস্ততা অপেক্ষাকৃত কম। আগে সকাল পরের দিন থেকে ভোর পর্যন্ত নিরলস কাজ করা লাগতো। কিন্তু এখন, বেলা ১১টা থেকে সর্বোচ্চ রাত ১২টা পর্যন্ত কাজ করছি। টেইলার্সের প্রচুর কাজ গত দুই বছরে অনেক কমে গেছে, পূর্বের মতো নেই। সেলাইয়ের বিবিধ কাজ যা কিছু হচ্ছে তা হলেও, প্যান্ট সেলাইয়ের চাহিদা প্রচুর হ্রাস পেয়েছে। প্রায় নেই বলেই ধরা যায়।

গণকপাড়া এলাকার ড্রেসকো টেইলার্স এর মালিক হাবিবুর রহমানের সাথে কথা হয়। তিনি বলেন, আগে ১৫তম রোজা অতিক্রান্ত হলে আর নতুন অর্ডার গ্রহণ করা হতো না। অবশ্য, এবার ২৫তম রোজা পেরোনোর পরও নতুন অর্ডার গ্রহণ করা হচ্ছে। প্রত্যেক উপাদানের দাম বৃদ্ধি পেয়েছে, সুতার মূল্য ও শ্রমিকের মজুরি বাড়ায় অনেকেই রেডিমেড পোশাকের প্রতি ঝুঁকেছেন।

অন্যদিকে, কিছু অসৎ বিক্রেতা প্রতারণা করে নিম্নমানের কাপড় দিয়ে থাকেন, যার ফলে সেলাই মানহীন হচ্ছে। এই কারণে টেইলার তৈরি পোশাক থেকে অনেকের আস্থা কমে যাচ্ছে। তবে, ব্র্যান্ডেড পোশাক ক্রেতাদের কোনো উদ্বেগ রাখছে না। নানান দিক থেকে সমস্যা দেখা দেওয়ায়, টেইলারিং পোশাকে আগ্রহ হ্রাস পাচ্ছে।

নিউ মার্কেটের ডলফিন টেইলার্সের বিক্রেতা লিপন সাহা বলেন, এবারে বিক্রি প্রায় নগণ্য। দেখা যাচ্ছে, প্রতিটি দোকান প্রায় খালি। এই মুহূর্তে, কাজের গতি মধ্যমানের, না খুব বেশি না খুব কম। পূর্বের বছরগুলোর তুলনায়, অর্ডার তিন ভাগের এক ভাগে এসে ঠেকেছে। আমাদের সাধারণ লক্ষ্যের অর্ধেকেরও কম অর্ডার পাওয়া গেছে। ঈদের বাইরে আমাদের কাছে ব্যবসা প্রায় থাকে না, শুধু শীতের সময়ে কিছুটা ব্যবসা হয়। বর্তমানে, প্রতিটি জায়গায় টেইলারিং বেড়ে গেছে। এমনকি ছোট ছোট বাজারগুলোতেও এখন প্রচুর টেইলারিং দোকান ও বাজার দেখা যায়। আগে দেখা যেত, শহরের বাইরে থেকেও মানুষ আসতেন। কিন্তু এখন, প্রতিটি জায়গায় সেবা পাওয়া যাওয়ায়, তারা দূর থেকে আসছেন না।

রাজশাহীর এই সৃষ্টি টেইলার্সে কাপড় তৈরি করতে আসা বিথী জানান, সামনে ঈদ তাই নিজের ও বাচ্চার জন্য কাপড় বানাতে এসেছি। ঈদের আগে সময়মত কাপড় বানাতে না দিলে কাজের চাপের কারণে নিতে চায়না। এছাড়া রেডিমেট কাপড় চোপড় ঠিকঠাক হয়না। তাই মনের মত কাপড় বানানোর জন্য টেইলার্সে দিলাম। সময়মত কাপড় দেওয়ার জন্য কারিগররা দিন-রাত কাজ করে যাচ্ছেন।

এ বিষয়ে নিউ মার্কেট ব্যবসায়ী মালিক সমিতির সাধারণ সম্পাদক ও দর্জি ব্যবসায়ী মঞ্জুর হোসেন বলেন, প্রতিটি জিনিসের মূল্য বৃদ্ধি পেয়েছে, যার ফলে মানুষ ইচ্ছে থাকা সত্ত্বেও অনেক কিছু কিনতে সক্ষম হচ্ছে না। যেখানে তারা পাঁচটি জিনিস কিনতে পারতো, সেখানে এখন মাত্র একটি নিচ্ছে, এবং অন্যান্য কাপড়-চোপড়ের তুলনায় টেইলারিং পণ্য মোটামুটি ভাবে বিক্রি হচ্ছে। যারা দোকানে আসেন, তারা বেশিরভাগই চাকরিজীবী, এবং প্রায়শই দুই থেকে তিনটি অর্ডার নিচ্ছেন। তবে, পূর্বের বারগুলোর তুলনায় বিক্রি এবার অনেক কম।