কেউ খোঁজ রাখে না একাত্তরের শপথের পেছনের কারিগরদের
![ছবি: বার্তা২৪.কম](https://imaginary.barta24.com/resize?width=800&height=450&format=webp&quality=85&path=uploads/news/2024/Apr/15/1713189153448.jpg)
ছবি: বার্তা২৪.কম
একাত্তরের ১৭ এপ্রিল। বাংলাদেশের প্রথম সরকারের শপথ অনুষ্ঠান। হাতে তেমন সময় নেই; কেউ নিয়ে আসল চেয়ার-টেবিল আবার কেউ নিয়ে আসলেন বাঁশখুঁটি। বাড়ির নতুন কাপড় ব্যবহার করা হলো প্যান্ডেল ঘেরার কাজে। আগের দিনের অর্ধেক সময় আর রাত জেগে পাহারা দেওয়া হলো পুরো আম্রকানন। শপথের অনুষ্ঠান থেকে শুরুটা হলেও মুক্তিকামী মানুষের সহযোগিতা করতে গিয়ে কেটে গেল যুদ্ধের পুরোটা সময়।
সময় গড়িয়েছে মত পথ পাল্টেছে। তবে একাত্তরের ১৭ এপ্রিল ঐতিহাসিক সেই শপথের অনুষ্ঠানের পেছনের কারিগরদের খোঁজ নেয়নি কেউ। রাষ্ট্রীয় স্বীকৃতি তো দূরে থাক, স্থানীয়ভাবেও তারা পাননি যথোপযুক্ত সম্মান। এ আক্ষেপ নিয়ে কেউ পাড়ি দিয়েছেন পরপারে, আবার কেউ কেউ মৃত্যুর প্রহর গুনছেন।
বলছিলাম বঙ্গবন্ধুর ডাকে গঠিত বৈদ্যনাথতলা সংগ্রাম কমিটির কথা।
জানা গেছে, বঙ্গবন্ধুর ৭ মার্চের ঐতিহাসিক ভাষণে ‘প্রত্যেক গ্রামে গ্রামে, পাড়া মহল্লায় আওয়ামী লীগের নেতৃত্বে সংগ্রাম পরিষদ গড়ে তোল’ নির্দেশনায় উদ্বুদ্ধ হয়ে মেহেরপুরের মুজিবনগর উপজেলার বৈদ্যনাথতলা সংগ্রাম পরিষদ গঠন করেন কয়েক যুবক। সে সময়কার এমএনএ ছহি উদ্দীন বিশ্বাস এবং এসডিও তৌফিক-ই-এলাহী চৌধুরীর পরামর্শে তারা ঐতিহাসিক শপথের সব আয়োজন করেছিলেন। শপথ অনুষ্ঠানে পবিত্র কোরআন তেলাওয়াত, বাইবেল পাঠ, জাতীয় সংগীত পরিবেশনসহ বিভিন্ন কাজে যারা যুক্ত হয়েছিলেন তাদেরকে আম্রকাননে নিয়ে এসেছিলেন সংগ্রাম কমিটির সদস্যরা।
প্রথম সরকারের শপথ অনুষ্ঠানের পর গোটা এলাকা পাক হায়েনাদের প্রধান লক্ষ্যবস্তুতে পরিণত হয়। তারপরেও জীবনের পরোয়া না করে সংগ্রাম কমিটির অকুতোভয় সদস্যরা ত্রাণ সংগ্রহের কাজ করেছিলেন। তাদের অনেকে আজ রাষ্ট্রের কাছ থেকে সম্মান না পাওয়ার কষ্ট নিয়ে মৃত্যুবরণ করেছেন। এখনও দুয়েকজন মৃত্যুর প্রহর গুনছেন স্বীকৃতি পাওয়ার আকুতি নিয়ে।
সংগ্রাম পরিষদের অন্যতম সদস্য বল্লভপুর গ্রামের বয়োবৃদ্ধ থিওফিল মন্ডল জানান, প্রাণের টানে প্রতি বছর ১৭ এপ্রিল মুজিবনগরে ছুটে আসি। পঁচাত্তর পরবর্তী পরিস্থিতিতে ১৯৭৬ সালে কেউ মুজিবনগর দিবস পালন করতে আসেনি। আমরা মাত্র ১৯ জন লোক বাগানে গিয়ে মুজিবনগর দিবস পালন করেছিলাম।
সম্মান না পাওয়ার আক্ষেপ করে তিনি বলেন, দেশ স্বাধীনের পর শুনেছিলাম হাতেগোনা কয়েকজন মুক্তিযোদ্ধা আছেন। পরবর্তীতে দেখি শতাধিক মানুষ মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে ভাতা পাচ্ছেন। তারপরও সংগ্রাম কমিটির সদস্যরা অবহেলিত ও অপমানিত।
একই কথা জানিয়ে মানিকনগর গ্রামের বয়োবৃদ্ধ দোয়াজ উদ্দীন মাস্টার বলেন, সংগ্রাম কমিটির সদস্যরা সব আয়োজন করেছিল। পবিত্র কোরআন তেলাওয়াত করার জন্য আমার ছাত্র দায়িরয়াপুর গ্রামের বাকের আলীকে ডেকে নিয়ে আসি। সে মুক্তিযোদ্ধার স্বীকৃতি পেয়েছে।
এছাড়াও সংগ্রাম কমিটির আরেক সদস্য আব্দুল মোমিন চৌধুরী স্বীকৃতি পেয়েছেন। সংগ্রাম কমিটিসহ যারা সেদিন প্রাণ মায়ের ত্যাগ করে বিভিন্ন দায়িত্ব পালন করেছিলেন তাদের সবার স্বীকৃতি দাবি করেন তিনি।
বাংলা একাডেমি কর্তৃক প্রণীত মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস মেহেরপুর জেলা গ্রন্থের মাধ্যমে মূলত সংগ্রাম কমিটির বিষয়টি সবার নজরে আসে। এ গ্রন্থের লেখক মুক্তিযুদ্ধের গবেষক ও বাংলা একাডেমি পুরস্কারপ্রাপ্ত দেশবরেণ্য কথাসাহিত্যিক রফিকুর রশিদ বলেন, অনিবার্য মুক্তিযুদ্ধের সহযোগিতার হাত বাড়ানো এসব মানুষগুলোর রাষ্ট্রীয় স্বীকৃতি খুবই প্রয়োজন। তারা শুধু শপথের অনুষ্ঠানের আয়োজনই করেননি কুষ্টিয়া অঞ্চলের সম্মুখযুদ্ধের সব রসদ মুক্তিযোদ্ধাদের কাছে পৌঁছে দিয়েছেন জীবন বাজি রেখে। তাদের স্বীকৃতি দাবি করেন বাগোয়ান ইউপি চেয়ারম্যান আয়ুব হোসেন।
তবে আশার কথা শুনিয়ে মেহেরপুর জেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি ও জনপ্রশাসন মন্ত্রী ফরহাদ হোসেন বলেছেন, ঐতিহাসিক মুহূর্তে ঐতিহাসিক ভূমিকার সাথে যারা সম্পৃক্ত ছিলেন তারা মুক্তিযোদ্ধা। তাদের সকলের স্বীকৃতি দেওয়ায় জন্য মুক্তিযুদ্ধা বিষয়ক মন্ত্রণালয়ে উত্থাপন করা হয়েছে।