গাইবান্ধা কারাগারের অভিযুক্ত দুই কারারক্ষীকে বদলি
গাইবান্ধা জেলা কারাগারে নারী হাজতিকে বিবস্ত্র করে হাত-পা বেঁধে নির্যাতনের ঘটনায় প্রধান অভিযুক্ত ও কারাগারের প্রধান কারারক্ষী আশরাফুল ইসলামসহ দুই কারারক্ষীকে বদলি করা হয়েছে।
শুক্রবার (১৯ এপ্রিল) দুপুরে ওই ঘটনায় তাদেরকে বদলির বিষয়টি নিশ্চিত করেছেন গাইবান্ধা জেলা কারাগারের জেল সুপার জাভেদ মেহেদী। এর আগে গতকাল বৃহস্পতিবার রাতে তাদেরকে বদলি করা হয়।
বদলি হওয়া অপর কারারক্ষীর নাম সাবানা খাতুন। তাদের মধ্যে প্রধান কারারক্ষী আশরাফুল ইসলামকে দিনাজপুর কারাগার এবং নারী কারারক্ষী সাবানা খাতুনকে ঠাঁকুরগাও কারাগারে বদলি করা হয়েছে।
এর আগে গাইবান্ধা জেলা কারাগারের ভিতরে কারাগারের প্রধান কারারক্ষী আশরাফুল ইসলামের সাথে মেঘনা খাতুন নামের এক নারী কয়েদির অবৈধ কর্মকাণ্ড দেখে ফেলায় মোর্শেদা খাতুন সীমা (৩৪), হাজতী নম্বর-৫০৮) নামের এক নারী হাজতিকে বিবস্ত্র করে, হাত-পা বেধে নির্যাতন করে অভিযুক্ত দুই কারারক্ষীসহ অন্যরা। শুধু তাই নয়, ওই নারী হাজতি সীমাকে কারাগারের নারী-পুরুষ উভয়ই মিলে বিবস্ত্র করে স্পর্শকাতর স্থানে লাঠি দিয়ে আঘাত, এমনকি কামড় দিয়ে ছিঁড়ে নেওয়া হয়েছে শরীরের গোশত।
এখানেই শেষ নয়, ঘটনা গোপন রাখতে দেখানো হয় জীবনণাশসহ সম্ভ্রমহানীর হুমকিও। অন্যথায় হত্যা করে হৃদরোগে মৃত্যু হয়েছে বলে চালিয়ে দেওয়ার আল্টিমেটামও দেয় সুবেদারসহ অভিযুক্তরা।
পরে এ ঘটনায় গাইবান্ধা জেলা কারাগারের ভিতরে নারী হাজতীর সাথে এমন লোমহর্ষক ঘটনার বণর্না তুলে ধরে অসুস্থ ওই নারী হাজতির উন্নত চিকিৎসার ব্যবস্থা, জীবন ও সম্ভ্রম রক্ষা করতে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা এবং নির্যাতনকারীদের বিরুদ্ধে আইনগত ব্যবস্থা নিতে গত ১৬ এপ্রিল গাইবান্ধার জেলা প্রশাসক বরাবর একটি লিখিত অভিযোগ দায়ের করেন ভুক্তভোগী হাজতির মা করিমন নেছা।
জেলা প্রশাসকের কাছে দেওয়া ওই অভিযোগে উল্লেখ করা হয়, হাজতি মোর্শেদা খাতুন সীমা প্রায় ৫ বছর যাবৎ গাইবান্ধা জেলা কারাগারে আবদ্ধ রয়েছেন। কারাগারে অবস্থানকালে কিছুদিন পূর্বে গাইবান্ধা জেলা কারাগারে কর্মরত সুবেদার আশরাফুল ইসলাম এবং মহিলা কয়েদি (রাইটার) মেঘলা খাতুনের মধ্যে চলমান অবৈধ কার্যকলাপ দেখে ফেলে নারী হাজতি সীমা।
এতেই সুবেদার আশরাফুল ও মহিলা কয়েদি মেঘলা খাতুন তার (সীমার) উপর ক্ষিপ্ত হয়ে উঠে এবং তারা প্রতিনিয়ত ঘটনার বিষয়ে কাউকে বললে কারাগারের ভিতরেই সীমাকে খুন-জখমে হত্যা করে আত্মহত্যা করে মৃত্য হয়েছে কিংবা হৃদরোগে আক্রান্ত হয়ে মৃত্য হয়েছে মর্মে ভয়-ভীতি ও হুমকী প্রদর্শন করতে থাকে। হাজতি সীমা খাতুন বারবার তাদেরকে (সুবেদার আশরাফুল-মেঘলা) ঘটনার বিষয়ে কাউকে কিছু বলবেনা মর্মে জানানোর পরেও সুবেদার আশরাফুল ও মহিলা কয়েদি মেঘলা খাতুন আতঙ্কিত হয়ে কারাগারের ভিতরে সীমাকে বিভিন্নভাবে মানসিক নির্যাতন করতে থাকে বলে অভিযোগে উল্লেখ করা হয়।
এছাড়া এসবের একপর্যায়ে সুবেদার আশরাফুল সীমাকে জিম্মি করতে বিভিন্ন তারিখ ও সময়ে কু-প্রস্তাব দিয়ে উত্যক্তসহ হাত এবং পড়নের কাপড় ধরে টানা-হেচড়াসহ একাধিকবার শ্লীলতাহানী ঘটায়। পরে বিভিন্ন ধরনের প্রলোভন দিয়েও আশরাফুলের মনোবাসনা পূর্ণ করতে ব্যর্থ হয়ে সুবেদার আশরাফুলসহ তার সহযোগীরা হাজতী সীমার স্বামী খোকন মিয়াকে গাইবান্ধা কারাগারে ডেকে নেয়। অভিযুক্তরা সীমার বিরুদ্ধে বিভিন্ন ধরনের মিথ্যা ও আপত্তিকর তথ্য দিয়ে সীমার সংসার নষ্ট করে ভেঙ্গে দেয়।
এতসবের পরে যখন হাজতি সীমা এসব ঘটনা জেল সুপার সাহেবকে বিচার দিবে মর্মে জানায়, তখন সুবেদার আশরাফুল প্রকাশ্যভাবে জেলার সাহেব তার লোক, সে (সুবেদার) নিজের টাকা খরচ করে জেলারকে এই কারাগারে বদলি করে এনেছেন বলে জানিয়ে জেলার তার (সুবেদারের) কোন বিচার করতে পারবেনা বলে ভয়-ভীতি ও হুমকী প্রদর্শন করে। এসবের এক পর্যায়ে চলতি বছরের গত ২০ মার্চ দুপুরে সুবেদার আশরাফুলের নেতৃত্বে মহিলা কয়েদি মেঘলা খাতুন, রেহেনা, আলেফা এবং কারারক্ষী তহমিনা ও সাবানা পরিকল্পিতভাবে জেলা কারাগারের মহিলা ইউনিটের ভিতরের বারান্দায় লাঠি দিয়ে অতর্কিত সীমার মাথায়, কোমড়ে বুকে, পিঠে, দুইপায়ের হাটুসহ শরীরের বিভিন্নস্থানে এলোপাথারী ভাবে মারধর করে। মহিলা কয়েদি মেঘলা ভুক্তভোগী সীমার ডানহাতের দাপনায় কামড় দিয়ে মাংস ছিড়ে নেয়।
শুধু তাই নয়, সুবেদার আশরাফুল, সিআইডি আনিছ ও হাবিলদার মোস্তফাগণ কারাগারের মহিলা ইউনিটের ভিতরে প্রবেশ করে সীমাকে টেনে-হেচড়ে বের করে মহিলা ইউনিটের বারান্দা হতে সেলের ভিতরে নিয়ে হাজতি সীমার দুইহাতে হ্যান্ডকাপ ও দুই পা রশি দিয়ে বেধে বিবস্ত্র করে লাঠি দিয়ে শরীরের স্পর্শকাতর স্থান (দুই উরু), পায়ের পাতায় পেটাতে থাকে। এ সময় নির্যাতনকারীরা এসবের কোনও ঘটনা কারাগারের বাহিরে প্রকাশ হলে সীমাকে মারপিটে হত্যা করে হৃদরোগ মৃত্যু হয়েছে বলে চালাবে মর্মে আবারো হুমকি দেয়।
এছাড়া অভিযোগে আরও উল্লেখ করা হয়, নির্যাতিতা হাজতির মা ও অভিযোগকারী করিমন নেছা একাধিকবার হাজতি মেয়ের সাথে দেখা করতে গাইবান্ধা কারাগারে আসলেও মেয়ের সাথে সাক্ষাত করতে দেওয়া হয়নি। অবশেষে হাজতী সীমা খাতুনের গাইবান্ধা আদালতে হাজিরার তারিখে আদালতে মেয়ের সাক্ষাত পান মা করিমন নেছা। এদিন সীমা মায়ের কাছে ঘটনার লোমহর্ষক বর্ণনা দেন এবং শরীরের বিভিন্নস্থানে জখমের চিহ্ন দেখায়।
পরে অভিযোগ দায়েরের প্রেক্ষিতে গত ১৬ এপ্রিল জেলা কারাগারে ঘটনা তদন্তে যান গাইবান্ধা জেলা প্রশাসাকের কার্যালয়ের অতিরিক্ত জেলা ম্যাজিস্ট্রেট (এডিসি) মো: মশিউর রহমান।
জানতে চাইলে এদিন তিনি বার্তা২৪.কমকে বলেন, অভিযোগ পেয়ে গতকাল বিষয়টি তদন্ত করেছি। খুব দ্রুত জেলা প্রশাসকের কাছে তদন্ত রিপোর্ট জমা দেব। এর পরেই জড়িতদের বিরুদ্ধে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নিবেন জেলা প্রশাসন।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে গাইবান্ধা জেলা কারাগারের জেল সুপার জাভেদ মেহেদী মুঠোফোনে বার্তা২৪.কমকে বলেন, অভিযুক্তদের মধ্যে দুই কারারক্ষীকে বদলি করা হয়েছে। তাদের মধ্যে প্রধান কারারক্ষী আশরাফুল ইসলামকে দিনাজপুর এবং নারী কারারক্ষী সাবানা খাতুনকে ঠাকুরগাঁও কারাগারে বদলি করেছে কারা প্রশাসন।
এ সময় এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, অভিযোগের বিষয়টি জেলা প্রশাসকের কার্যালয় থেকে তদন্ত করা হচ্ছে। তদন্ত সাপেক্ষে পরবর্তীতে ব্যবস্থা হবে।