প্রবৃদ্ধির বদলে অর্থনৈতিক সুরক্ষার বাজেট চায় সিপিডি
আগামী অর্থবছরের জাতীয় বাজেটে মোট দেশজ উৎপাদনে (জিডিপি) বড় প্রবৃদ্ধির লক্ষ্য নির্ধারণ না করে সামষ্টিক অর্থনীতির স্থিতিশীলতা নিশ্চিত করার তাগিদ দিয়েছে গবেষণা প্রতিষ্ঠান সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগ (সিপিডি)।
সংস্থাটির পক্ষ থেকে বলা হয়েছে, দেশের অর্থনীতি এখন বড় ধরনের ক্রান্তিকাল অতিক্রম করছে। এই চাপ থেকে সুরক্ষা নিশ্চিত করতে রাজস্ব, আর্থিক ব্যবস্থাপনা, প্রকল্প বাস্তবায়ন ও সরকারি কেনাকাটাসহ প্রতিটি খাতে স্বচ্ছতা নিশ্চিত করতে বড় ধরনের সংস্কার উদ্যোগ বাস্তবায়ন করতে হবে।
সামষ্টিক অর্থনীতির হালনাগাদ চিত্র তুলে ধরতে সিপিডির পক্ষ থেকে রোববার (২ জুন) আয়োজন করা ‘২০২৩-২৪ অর্থবছরে বাংলাদেশের অর্থনীতির অবস্থা’ শীর্ষক এক মিডিয়া ব্রিফিংয়ে এসব কথা বলেন সংস্থাটির গবেষণা পরিচালক ড. খন্দকার গোলাম মোয়াজ্জেম।
সিপিডির নিজস্ব সম্মেলন কক্ষে আয়োজিত অনুষ্ঠানে গোলাম মোয়াজ্জেম বলেন, কোভিডকালীন সময়ে শুরু হওয়া সংকট থেকে ইউক্রেন যুদ্ধের পরেও দেশের অর্থনীতি পুনরুদ্ধার হয়নি। বহিস্থ খাতের সংকটগুলো দৃশ্যমান হওয়ায় কয়েক দশক ধরে বিদ্যমান অভ্যন্তরীণ খাতের ভঙ্গুরতাগুলোও অর্থনীতিতে নানা ধরনের চ্যালেঞ্জ সৃষ্টি করেছে।
তিনি বলেন, চলতি অর্থবছরে আগের বছরের তুলনায় রাজস্ব আদায়, ফিসক্যাল স্পেসে সংকোচন, ব্যাংক ব্যবস্থা থেকে সরকারের ঋণ গ্রহণ, বাণিজ্যিক ব্যাংকে তারল্যের চাপ, নিত্যপণ্যের মূল্য বৃদ্ধি, বিদেশি লেনদেনে চাপ ও বিদেশি মূদ্রার রিজার্ভের সংকট ঘনীভূত হয়েছে।
তিনি আরও বলেন, আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের (আইএমএফ) শর্তে বাংলাদেশ ব্যাংকের পক্ষ থেকে সুদের হারের ক্যাপ উঠিয়ে দেওয়া, বিনিময় হার বাজারে ছেড়ে দেওয়া, তেল, গ্যাস ও বিদ্যুতের দামে সমন্বয়ের মত বেশ কিছু উদ্যোগ নেওয়া হলেও এগুলোর সুফল এখনও আসেনি বলে দাবি করেন মোয়াজ্জেম।
আইএমএফ এর শর্তে সরকার সংস্কারে কিছুটা গুরুত্ব দেওয়ায় জিডিপি প্রবৃদ্ধিতে কিছুটা টান পড়েছে মন্তব্য করে তিনি বলেন, দুর্ভাগ্যজনকভাবে বাংলাদেশে সামষ্টিক অর্থনৈতিক সূচকে সব সময় বড় লক্ষ্য ধরা হয়ে থাকে।
উদাহারণ দিয়ে তিনি বলেন, চলতি অর্থবছরে ৭ দশমিক ৫ শতাংশ প্রবৃদ্ধির লক্ষ্য ধরা হলেও মনিটারি পলিসি স্টেটমেন্টে এই লক্ষ্য ৬ দশমিক ৫ শতাংশে নামিয়ে আনে বাংলাদেশ ব্যাংক। আর এশীয় উন্নয়ন ব্যাংক (এডিবি), বিশ্বব্যাংক ও আইএমএফসহ বৈশ্বিক বিভিন্ন সংস্থার প্রজেকশান ছিল আরও কম।
বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) সাময়িক হিসাবে চলতি অর্থবছরে যে ৫ দশমিক ৮ শতাংশ প্রবৃদ্ধির কথা বলা হয়েছে, এটা অর্জন করা কঠিন হবে বলেও মনে করেন তিনি।
জিডিপির আকার ও মাথাপিছু আয় যতটা বেড়েছে তার বড় অংশই ধনীদের কব্জায় চলে গেছে মন্তব্য করে তিনি বলেন, মূল্যস্ফীতির কারণে দরিদ্রদের প্রকৃত আয় কমে যাওয়ায় বৈষম্য বাড়ছে।
জিডিপির আকার বৃদ্ধির তুলনায় কর্মসংস্থান বৃদ্ধির হার যেমন কমছে, অপ্রাতিষ্ঠানিক খাতে শ্রমশক্তির পরিমাণ বাড়ছে। শিল্প প্রবৃদ্ধিতে ম্যানুফ্যাকচারিং খাতের অবদান কমে আসার কারণও গুরুত্ব দিয়ে অনুসন্ধানের তাগিদ দেন তিনি।
চলতি অর্থবছরের বাজেটে রাজস্ব আহরণেও বড় লক্ষ্য ধরা হয়েছিল মন্তব্য করে গোলাম মোয়াজ্জেম বলেন, জানুয়ারি পর্যন্ত প্রথম সাত মাসে রাজস্ব আদায়ে ১৩ শতাংশের বড় প্রবৃদ্ধি হয়েছে, যা আগের বছরের একই সময়ে ঋণাত্মক ছিল।
এ খাতে বড় প্রবৃদ্ধি হলেও পুরো বছরের লক্ষ্য অর্জন করতে হলে শেষ পাঁচ মাসে ৬৩ শতাংশ প্রবৃদ্ধি নিশ্চিত করতে হবে মন্তব্য করে তিনি বলেন, এই বড় লক্ষ্য পূরণ এবারও সম্ভব হবে না।
রাজস্ব আদায়ে আইএমএফ এর বেধে দেওয়া লক্ষ্যও পূরণ হবে না বলে মন্তব্য করেন তিনি।
সংকোচনমূলক পন্থার কথা বলে রফতানিতে প্রণোদনা কমিয়ে আনা, বিদ্যুৎ ও জ্বালানির দাম বৃদ্ধি, আমদানিতে বিভিন্ন ধরনের রেস্ট্রিকশন আরোপ করা হলেও সরকারি ব্যয়ে এটা মানা হচ্ছে না বলে মনে করেন মোয়াজ্জেম।
তিনি বলেন, একদিকে বন্ড ছেড়ে সার আমদানি ও বিদ্যুতের দাম পরিশোধ করা হচ্ছে। ঋণের সুদ ও আসল পরিশোধে বেশি সুদে স্বল্প মেয়াদি ঋণ নেওয়া হচ্ছে। অন্যদিকে বেসরকারি খাতে সংকোচনমূলক পন্থার কথা বলা হচ্ছে। সরকার নিজেই নিজের ব্যবস্থা ভাঙছে মন্তব্য করে তিনি বলেন, ব্যাংক ব্যবস্থা থেকে সরকারের বেশি ঋণ থাকার কারণে বেসরকারি খাত ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে।
বিদ্যমান সংকট মোকাবিলায় সরকারের বাজেটীয় আর্থিক সঙ্গতি বাড়ানোর তাগিদ দিয়ে মোয়াজ্জেম বলেন, এটা করতে হলে যে কোন ধরনের লিকেজ বন্ধ করতে হবে। কর ফাঁকি রোধ করা, কর কাঠামো ডিজিটাল করা ও অর্থপাচার রোধ করার বিষয়ে যেমন গুরুত্ব দিতে হবে, ব্যয়ের ক্ষেত্রে অপচয় কমাতে হবে।
তিনি বলেন, সরকারি ব্যয়ে প্রাধিকারের কথা বলা হলেও এমন অনেক প্রকল্প নেওয়া হচ্ছে যেগুলো কোনভাবেই প্রাধিকারের মধ্যে আসতে পারে না। সরকারি কর্মকর্তাদের জন্য বড় ব্যয়ে বিলাসবহুল গাড়ি কেনা বা খুব প্রয়োজন না হলে বৈদেশিক মুদ্রা ব্যবহার করে বিদেশ ভ্রমণের সুযোগ এই মুহূর্তে থাকা উচিত নয় বলেও তিনি মন্তব্য করেন।
তিনি আরও বলেন, রাজনৈতিক প্রভাবশালীরা বিভিন্ন মন্ত্রণালয়ের প্রকল্প বাস্তবায়নের দায়িত্ব নিয়ে সময়কাল ও ব্যয় বাড়িয়ে থাকেন। প্রকিউরমেন্ট সিস্টেম আরও ট্রান্সফারেন্ট করে এই ধরনের দুর্নীতি কমানোর পরামর্শ দেন তিনি।
আগামী অর্থবছরের জাতীয় বাজেটে পিছিয়ে পড়া লোকজনদের বিশেষ গুরুত্ব দেওয়ার সুপারিশ করেছে সিপিডি।
এ বিষয়ে গোলাম মোয়াজ্জেম বলেন, সামাজিক খাতে দরিদ্রদের জন্য বরাদ্দ বাড়াতে হবে। শুধুই খাদ্য বিতরণের মধ্যে আবদ্দ না রেখে পিছিয়ে পড়া মানুষদের শিক্ষা, সামাজিক অবকাঠামো ও স্বাস্থ্যে ব্যাপক সরকারি বরাদ্দ নিশ্চিত করতে হবে, তিনি বলেন।