৯ শিক্ষার্থী, ১৩ জন শিক্ষক
গাইবান্ধার সেই বিদ্যালয়ের ফলাফল পুনর্নিরীক্ষণেও সবাই ‘ফেল’!
গাইবান্ধার সেই ৯ শিক্ষার্থীর জন্য ১৩ শিক্ষকের বিদ্যালয়ে ফলাফল পুনর্নিরীক্ষণেও কেউই পাস করেননি। সবাই ফেল করেছেন। পুনর্নিরীক্ষণ ফলাফল প্রকাশের পর গাইবান্ধা জেলা মাধ্যমিক শিক্ষা অফিস ও ওই বিদ্যালয় সূত্রে বিষয়টি নিশ্চিত হওয়া গেছে। এর আগে গত ১২ মে'র প্রকাশিত ফলাফলে সবাই অকৃতকার্য হয়।
পরে ফলাফল পুনর্নিরীক্ষণের জন্য ১৩ মে থেকে ১৯ মে’র নির্ধারিত সময়ের মধ্যে তাদের ফলাফল পুনর্নিরীক্ষণের (বোর্ড চ্যালেঞ্জ) জন্য আবেদন করে বিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ। পুনর্নিরীক্ষণের ফলাফলেও পাস করেননি একজন পরীক্ষার্থীও।
ফলাফল বিপর্যয়ে আলোচিত গাইবান্ধার এই বিদ্যালয়ের নাম ‘ঘগোয়া বালিকা উচ্চ বিদ্যালয়’।
প্রতিষ্ঠানটি জেলার সুন্দরগঞ্জ উপজেলার তারাপুর ইউনিয়নে অবস্থিত। বিদ্যালয়টি ১৯৯৪ সালে প্রতিষ্ঠিত হয়। পরবর্তীতে ১৯৯৯ সাল থেকে ওই বিদ্যালয় থেকে এসএসসি পরীক্ষায় অংশ নিতে থাকেন শিক্ষার্থীরা। প্রতিষ্ঠার ১০ বছর পর বিদ্যালয়টি ২০০৪ সালে এমপিওভুক্ত হয়। বর্তমানে বিদ্যালয়ে ১৩ জন শিক্ষকের মধ্যে ৯ জন পুরুষ এবং নারী শিক্ষক ৪ জন। এছাড়া শিক্ষক-কর্মচারী মিলে ওই বিদ্যালয়ে জনবল সংখ্যা ১৬ জন।
বিদ্যালয় সংশ্লিষ্ট সূত্র জানায়, ২০২৪-এর এসএসসি ও সমমান পরীক্ষায় এই বিদ্যালয় থেকে ৯ জন নিয়মিত ও ৫ জন অনিয়মিত শিক্ষার্থীসহ মোট ১৪ জন পরিক্ষার্থী অংশ নেন অর্থাৎ ২০২৩ সালের অকৃতকার্য ওই ৫ পরীক্ষার্থী ছাড়া এ বছরে শুধু ৯ জন নিয়মিত শিক্ষার্থী অংশ নেন।
এদের কেউই পাস করেননি অথচ তাদের জন্য বিদ্যালয়ে ছিল ১৩ জন শিক্ষক।
বিদ্যালয়ে বিজ্ঞান, ব্যবসায় শিক্ষাসহ ৩টি শাখা থাকলেও ফেল করা শিক্ষার্থীরা সবাই ছিলেন মানবিক বিভাগের। তাদের মধ্যে নিয়মিত শিক্ষার্থীদের ৬ জনই ফেল করেছিলেন গণিত বিষয়ে এবং বাকি ৩ জনের একজন গণিতসহ বাংলা, একজন গণিতসহ ধর্ম এবং অপরজন গণিত, কৃষিশিক্ষা বিষয়ে অকৃতকার্য হন।
অকৃতকার্য এই ১৪ জন পরীক্ষার্থীর মধ্যে নিয়মিত ৬ জন এবং অনিয়মিত ৩ জন পরীক্ষার্থীর পরীক্ষার ফলাফল পুনর্নিরীক্ষণের জন্য আবেদন করে বিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ। বাকি ৫ পরীক্ষার্থীর বোর্ড চ্যালেঞ্জে অনাগ্রহ এবং একাডেমিক পারফরম্যান্স বিবেচনায় তাদের পক্ষে ফলাফল পুনর্নিরীক্ষণের জন্য আবেদন করা হয়নি বলে জানিয়েছেন বিদ্যালয় সংশ্লিষ্টরা।
সেসময়ে বিদ্যালয়টির এমন নেতিবাচক হতাশ করা ফলাফল প্রকাশের পর চরম ক্ষোভ প্রকাশ করেন স্থানীয়সহ সচেতনমহল ও অভিভাবকেরা। ওই সময়ে তারা প্রশ্ন তুলেছিলেন, বিদ্যালয়ের শিক্ষকদের দায়িত্বের পাশাপাশি যোগ্যতা নিয়েও।
ওই সময় সব পরীক্ষার্থী অকৃতকার্য হওয়া প্রশ্নে বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক আব্দুল হাকিম জানিয়েছিলেন, ১৯৯৯ সাল থেকে এই বিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা এসএসসি ও সমমান পরীক্ষায় অংশ নেয়। কোনো বছরই ফলাফলে এমন বিপর্যয় হয়নি। ফলাফল খারাপ ছিল; তাই বলে এই রকম নয়!
এ বছরের ১৪ শিক্ষার্থীর অন্তত ৫ থেকে ৭ জন পাস করার শতভাগ যোগ্যতা রাখে। কেন তাদের রেজাল্ট ফেল আসলো, আমরা বুঝতে পারছি না। ধারণা করা হচ্ছে, উত্তরপত্র মূল্যায়নে যে কোনো ধরনের ত্রুটি হয়ে থাকতে পারে। সেই ধারণা থেকেই ফলাফলে অসন্তুষ্ট হয়ে বোর্ড চ্যালেঞ্জ করেন প্রধান শিক্ষক। কিন্তু বোর্ড চ্যালেঞ্জের ফলাফলেও সবাই ফেল।
এ ব্যাপারে গাইবান্ধা জেলা মাধ্যমিক শিক্ষা কর্মকর্তা রোকসানা বেগম মোবাইল ফোনে বার্তা২৪.কমকে বলেন, পরীক্ষার পুনর্নিরীক্ষণের ফলাফলেও সবার ফেল আসার বিষয়টি উদ্বেগজনক!
এসময় এক প্রশ্নের জবাবে এমন ফলাফল বিপর্যের পেছনে ওই বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষককে দোষারোপ করেন এই কর্মকর্তা। রোকসানা বেগম বলেন, প্রধান শিক্ষকের চরম দায়িত্বহীনতা ও আন্তরিকতার অভাবের কারণে ফলাফলে শতভাগ ফেল হয়েছে।
একইসঙ্গে সংশ্লিষ্ট বিষয়ের শিক্ষকদের প্রতিও ক্ষোভ প্রকাশ করেন তিনি।
তবে, পুনর্নিরীক্ষণের ফলাফল প্রকাশের পর সুর পাল্টেছেন প্রধান শিক্ষক আব্দুল হাকিম। তিনি মোবাইল ফোনে বার্তা২৪.কমের কাছে এমন ফলাফল বিপর্যের পেছনে তিনি নিজেই দায়ী বলে স্বীকার করে নেন।
আব্দুল হাকিম বলেন, যেহেতু সবাই ফেল করেছে, দায় তো নিতেই হবে! তার ওপর ফলাফল পুনর্নিরীক্ষণেরর আবেদন করেও কারো রেজাল্ট ‘পাস’ (কৃতকার্য) আসলো না। সব তো মাথা পেতে নিতেই হবে! এজন্য কর্তৃপক্ষ যে শাস্তি দেবে, তাও মেনে নিতে হবে।
এসময় তিনি আরো বলেন, আগামী ২০২৫ সালের এসএসসি ও সমমান পরীক্ষায় এই বিদ্যালয় থেকে ২২ জন নিয়মিত শিক্ষার্থী পরীক্ষায় অংশ নেবে। ইতোমধ্যে, তাদের জন্য বিশেষ ব্যবস্থা নেওয়া হচ্ছে। নিয়মিত ক্লাসের পাশাপশি চিহ্নিত দুর্বল শিক্ষার্থীদের জন্য অতিরিক্ত বিশেষ ক্লাসের ব্যবস্থা করা হচ্ছে। শিক্ষকদেরও কঠোর নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে। বিষয়টি আমাদের অনেকগুলো পরিবারের রুটি-রুজির!
উল্লেখ্য, ২০২৩ সালের এসএসসি পরীক্ষায় ‘ঘগোয়া বালিকা উচ্চ বিদ্যালয়’ থেকে ১৮ জন শিক্ষার্থী পরীক্ষায় অংশ নেন, যাদের মধ্যে পাস করেন ১৩ জন এবং ফেল করেন ৫ জন (যারা এ বছরও পরীক্ষায় অংশ নেন)।
এছাড়া বিদ্যালয়টি থেকে ২০২২ সালের এসএসসি পরীক্ষায় অংশ নেন ২১ জন। এর মধ্যে কৃতকার্য হন ১৭ জন। ওই বছরেও অকৃতকার্য হন ৫ জন শিক্ষার্থী।
এদিকে, ২০২৫ সালের আগামী এসএসসি ও সমমান পরীক্ষায় ওই বিদ্যালয় থেকেই ২২ জন নিয়মিত শিক্ষার্থীর অংশগ্রহণের কথা রয়েছে। এর মধ্যে বিজ্ঞান বিভাগের ৬ জন শিক্ষার্থী রয়েছেন। এছাড়া এই অকৃতকার্য ১৪ জন পরীক্ষার্থীও একই বছর অনিয়মিত হিসেবে এসএসসি-২০২৫ পরীক্ষায় অংশ নেবেন।