‘কেউ কুন্তা আমরারে দেইন না, খোঁজও নেইন না’

  • মশাহিদ আলী, স্টাফ করেসপন্ডেন্ট, বার্তা২৪.কম, সিলেট
  • |
  • Font increase
  • Font Decrease

তিনবার তলিয়েছে খোদেজা বেগমের ঘর, ছবি: বার্তা২৪.কম

তিনবার তলিয়েছে খোদেজা বেগমের ঘর, ছবি: বার্তা২৪.কম

‘কেউ কুন্তা আমরারে দেইন না। খোঁজও নেইন না। বাইয়া গেলেও কেউ আমরারে দেখইন না। কোনো জাতের সায় সাহাজ্য আইলেও আমরারে দেইন না। ভোটর সময় ভোট দিবার লাগি মেম্বার চেয়ারম্যান হাত-পাও ধরইন। আগর বার ঘরো ৮-১০দিন আছিল। তিনবারের পানিয়ে আমরারে মারিয়া গেল। মেম্বার-চেয়ারম্যানের চোখে আমরা পরি না।আমরা জোরে কইতাম পারমু কেউ কুন্তা দিছইন না। আমরা তো রে বাবা অসহায় কেউ কোনো ঠাঁইও দেই না।’

এভাবে সিলেটের আঞ্চলিক ভাষায় কথাগুলো বলেছেন বিশ্বনাথ উপজেলার রামপাশা ইউনিয়নের আমতৈল গ্রামের বধির নেছার উদ্দিনের স্ত্রী শিরিনা বেগম।

বিজ্ঞাপন

শিরিন বেগমের মতো সাত কন্যা সন্তানের জননী খোদেজা বেগম। গত এক মাসে তিনবার তলিয়েছে খোদেজা বেগমের ঘর। বদির স্বামী নাসির উদ্দিনসহ ৯ সদস্যের পরিবার নিয়ে মানবেতর দিন কাটছে তার।

খোদেজা বেগম বার্তা২৪.কমকে বলেন তার কষ্টের কথা। তিনি বলেন, ‘গত এক মাসে ৩ বার ঘরে পানি উঠছে। ঘরের চালা ও বাঁশ পচি গেছে। কোন সময় ঘর ভাঙিয়া পড়ি যায় কওয়া যায় না। আমি বড় অসহায়, আমার মাও নাই ভাইও না রে সোনা হখল। জামাই একজন প্রতিবন্ধী। আমি পানি আইলে মাইনষের ঘরে ঘরে যাই। স্কুলে-বিস্কুলে মানুষ যায়। আমার ঝামেলা করি আমি যাই না। ইতা ছোট ছোট ফুরুতার লাগি যাই না । দোতালা তিনতালা ওপরে যাইবা পড়বা হাত পাও ভাঙবো আমি ডাক্তরি কই থাকি করাইমু। মাইনষের বাড়ি বাড়ি গিয়া কয়দিন আর থাকা যায়। অতার লাগি আমি পানির মাঝে আইয়া থাকি।’


তিনি আরও বলেন, ‘আমরা জামাই-বউসহ ৯ সদস্যের পরিবার। ৭ ফুড়ি লইয়া বড় বিফদ আছি। আইজ পর্যন্ত চেয়ারম্যান মেম্বার কোনো খোঁজ খবর নিছইন না। গত ২০২২ সালে আমরার ইতা সাইটে পানিয়ে ডুবাইল আছিল। আর এখন পর্যন্ত তিনবারও পানি অইগেছে। বারা জাগা থাকি মানুষ আইয়া আমরারে মুড়ি এক কেজি, এক বোতল পানি, নাপা ও স্যালাইন দিয়া গেছইন। ভোটর সময় আইয়া মাই-পুত ডাকিয়া ভোট নিলা। কইলা পুল করিয়া দিবা। এখন আর পুল দিলা না।ইতা যেতা ত্রাণ আয় ইতা মুখ চাইয়া দেইন তারা।’

শুধু শিরিন ও খেদেজা এই রকম সিলেটের বিভিন্ন এলাকায় বন্যার্ত মানুষ সরকারি ত্রাণ সহযোগিতা পাচ্ছেন এবং তাদের বিপদের সময় জনপ্রতিনিধি কাউকেই পাশে পাচ্ছেন না বলে অভিযোগ উঠেছে।

সিলেট নগরীর ২৫ নং ওয়ার্ডের সুরমা নদীর তীরে ঘেষা কলোনিতে বাস করেন ইছমা বেগম। ঘরের মধ্যে তিনদিন ধরে পানি রয়েছে। পানির মধ্যে তাদের বসবাস। উরু সমান পানি ডিঙিয়ে পাশের বাসার টিউবওয়েল থেকে পানি এনে কোনো রকম রান্না-বান্না করে খাবার খাচ্ছেন। তবে তাদেরকে দেয়া হয়নি কোনো ত্রাণ সহায়তা।

নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক আরেকজন জানান, ঘরের মধ্যে সুরমা নদীর পানি প্রবেশ করেছে। এই পানিতে থালা-বাসন ধুঁয়ে সবকিছু করেন। একে একে তিনবার পানি উঠেছে তার ঘরে। দ্বিতীয় দফায় বন্যায় তারা পাশের টেকনিক্যাল স্কুল অ্যান্ড কলেজে আশ্রয় নিলে পরবর্তীতে তাদেরকে ফিরিয়ে দেয়া হয়।

জানা যায়, এক মাসের ব্যবধানে তিনবার বন্যায় প্লাবিত হয়েছে সিলেট অঞ্চল। গত ২৭ মে সিলেটে আগাম বন্যা পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়। তখন প্রায় সাড়ে ৭ লাখ মানুষ বন্যা আক্রান্ত হন। এরপর গত ১৭ জুন ঈদুল আজহার দিন থেকে আবারও বন্যা পরিস্থিতি সৃষ্টি হয়। তখন সিলেটর ১৩টি উপজেলার ১০ লাখের উপরে মানুষ বন্যা আক্রান্ত হন। এই রেশ কাটতে না কাটতেই গত ১ জুলাই থেকে আবারও সিলেট ও ভারতের চেরাপুঞ্জিতে চলমান বৃষ্টিপাতের কারণে সব নদ নদীর পানি বৃদ্ধি পেয়ে সিলেটে তৃতীয় দফা বন্যা পরিস্থিতি সৃষ্টি হয়েছে।

এদিকে, শনিবার দুপুরে সিলেট জেলা প্রশাসন সূত্রে জানা যায়, সিলেটের ১৩টি উপজেলার ৯৮টি ইউনিয়নের ১ হাজার ১৩৯টি গ্রামের ৫ লাখ ৮৮ হাজার ২৮৭ জন মানুষ বন্যাকবলিত। আর এখনো আশ্রয়কেন্দ্রে রয়েছেন ৯ হাজার ৮৩১জন মানুষ।


সিলেট পানি উন্নয়ন বোর্ডের তথ্যমতে, সিলেটের কুশিয়ারা নদীর তিনটি পয়েন্ট ও সুরমা নদীর একটি পয়েন্টে পানি বিপৎসীমার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে। সুরমা নদীর সিলেট পয়েন্টে পানি বিপৎসীমার ৬ সেন্টিমিটার নিচ দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে।

শনিবার (৬ জুলাই) বিকেল ৩টায় সুরমা নদীর কানাইঘাট পয়েন্টে বিপৎসীমার ৬২ সেন্টিমিটার, কুশিয়ারা নদীর অমলশীদ, শেওলা, ফেঞ্চুগঞ্জ, পয়েন্টে যথাক্রমে ১০৪, ২৬, ৯৮ সেন্টিমিটার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে।

এব্যাপারে বিশ্বনাথ উপজেলার রামপাশা ইউনিয়নের চেয়ারম্যান ইমাম উদ্দিন বলেন, আমাদেরকে সরকারি যে পরিমাণ বরাদ্দ বা ত্রাণ দেয়া হয়, সেটা তুলনামূলক অপ্রতুল। সবটুকু ওয়ার্ডের মেম্বারদের মাধ্যমে বন্টন করা হয়ে থাকে। তাদেরকে তো মেম্বার দেয়ার কথা।

জানতে চাইলে বিশ্বনাথ উপজেলার নির্বাহী কর্মকর্তা(ইউএনও) শাহীনা আক্তার বলেন, এই রকম অভিযোগ আগে কখনো পাইনি। এই প্রথম শুনলাম। আমি খোঁজ নিচ্ছি।

তবে, সিলেট সিটি করপোরেশনের ২৫ নং ওয়ার্ডের কাউন্সিলর তাকবির ইসলাম পিন্টুর মুঠোফোনে একাধিকবার কল দিলে মুঠোফোন বন্ধ পাওয়া যায়।