প্রকাশ্যে অনলাইন জুয়ার ভয়ংকর ফাঁদ, নিষ্ক্রিয় আইনশৃঙ্খলা বাহিনী

  • ডিস্ট্রিক্ট করেসপন্ডেন্ট, বার্তা২৪.কম, পাবনা
  • |
  • Font increase
  • Font Decrease

ছবি- বার্তা২৪.কম

ছবি- বার্তা২৪.কম

পাবনার সুজানগর উপজেলার নাজিরগঞ্জ ইউনিয়নের মহব্বতপুর গ্রামের সদ্য এসএসসি পেরোনো কিশোর রাসেল মন্ডল। নবম শ্রেণীতে থাকাকালীন ক্রিকেট পাগল রাসেলকে টার্গেট করে বেটিং সাইটের (অনলাইন জুয়া) এজেন্ট মোহাম্মদ আলী জীবন। টাকা ধার দিয়ে খুলে দেয় বেটিং সাইটের একাউন্ট। গত দুই বছরে কিশোর রাসেলকে প্রলুব্ধ করে কয়েক লাখ টাকা জুয়ায় বিনিয়োগ করিয়েছে জীবন। বাজিতে হেরে রাসেলের মাথায় চেপে বসে প্রায় দুই লাখ টাকার ঋণ। একপর্যায়ে ঋণ শোধ করতে রাসেলকে মায়ের গহনা চুরি করার পরামর্শ দেয় জীবন।

জীবনের পরামর্শে গত মে মাসে সুজানগর বাজারের কর্মকার জুয়েলার্সে গহনা বন্ধক রেখে চড়া সুদে এক লাখ টাকা ঋণ নেয় রাসেল। তবে জুয়ায় জেতার নেশা আর ঋণের বোঝা কোনোটাই পিছু ছাড়েনি তার। মানসিক চাপ ও অনুশোচনায় সম্প্রতি তার মাকে গহনা চুরির কথা জানায় ভুক্তভোগী কিশোর।

বিজ্ঞাপন

পুরো ঘটনা জানতে পেরে তথ্য প্রমাণসহ এজেন্ট মোহাম্মদ আলী জীবনের বিরুদ্ধে সুজানগর থানায় অভিযোগ করে রাসেলের পরিবার। তবে এতেও খুব একটা লাভ হয়নি। ভুক্তভোগী পরিবারের অভিযোগ, অর্থ লেনদেন ও অপরাধে প্ররোচনার প্রমাণ থাকার পরেও জীবনের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়নি পুলিশ।

রাসেলের মা রোজিনা খাতুন বলেন, ছেলের কাছে সব জানতে পেরে আমি সুজানগর থানায় মোহাম্মদ আলী জীবনের বিরুদ্ধে লিখিত অভিযোগ করি। অভিযোগ তদন্তে থানা থেকে এস আই মাহবুবকে দায়িত্ব দেয়া হলে তিনি মালিফা ফাঁড়িতে উভয়পক্ষকে ডাকেন। সেখানে জীবনের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা না নিয়ে বরং আমার ছেলেকেই চোর সাব্যস্ত করে ধমক ও চর থাপ্পড় দেন। এ সময় ঘটনা মীমাংসার কথা বললে আমি রাজি হইনি। যারা আমার ছেলেকে বিপথে নিয়েছে, মানসিক যন্ত্রনা দিয়েছে আমি তার বিচার চাই ।

বিজ্ঞাপন

ভুক্তভোগী কিশোর জানান, জীবনের প্ররোচনায় জুয়ায় জড়িয়ে নিজের ক্ষতির বিষয়টি বুঝতে পেরে এ পথ থেকে সরে আসার চেষ্টা করে সে। বাবা মা তাকে গ্রাম থেকে ঢাকা পাঠিয়ে দিলেও, জীবন তার পিছু ছাড়ে নি। মানসিক চাপ সৃষ্টি করে আবারও খেলতে বাধ্য করে। হেরে যাওয়ার পর টাকার জন্য চাপ দেয়। রাসেল বলেন, ‘আমাকে কিডন্যাপের নাটক সাজিয়ে প্রবাসী বাবার কাছ থেকে টাকা আদায়, ঢাকার হাসপাতালে কিডনি বিক্রি করে টাকা জোগাড় করার পরামর্শ দেয় জীবন। একপর্যায়ে তাদের চাপে মায়ের গহনা চুরি করি। আমি এই ফাঁদ থেকে বের হতে চাই ‘

রাসেলের দেওয়া তথ্যের সূত্র ধরে সরেজমিনে সুজানগর বাজারের কর্মকার জুয়েলার্সে গিয়ে তার মায়ের গহনার সন্ধান মেলে। দোকান মালিক সজীব কর্মকার বলেন, ‘গত মে মাসে রাসেল ও জীবন সুজানগর উপজেলার উদয়পুর গ্রামের কৃষ্ণ নামের এক স্বর্ণ ব্যবসায়ীর মাধ্যমে গহনা বন্ধক রেখে যান। তারা প্রতি মাসে সাত হাজার টাকা সুদের চুক্তিতে এক লাখ টাকা নিয়ে যায়। তবে কি কাজে তারা টাকা ঋণ নিয়েছে তা কিছুই আমি জানি না।’

এ বিষয়ে এজেন্ট জীবনের সাথে যোগাযোগ করা হলে তিনি অনলাইন জুয়ায় জড়িত নন বলে দাবি করেন। তথ্য প্রমাণ আছে জানালে তিনি দ্রুত সরে পড়েন।

এদিকে রাসেলের জুয়ায় জড়িয়ে পড়ার অনুসন্ধানে বেরিয়ে আসে ভয়াবহ তথ্য। স্থানীয় সূত্র বলছে, কেবল নাজিরগঞ্জ ইউনিয়নেই বিভিন্ন মোবাইল ব্যাংকিংয়ের মাধ্যমে প্রকাশ্যে সক্রিয় অন্তত দশজন অনলাইন জুয়ার এজেন্ট। এদের প্ররোচনায় জুয়ার মরণ ফাঁদে নিঃস্ব হয়ে পথে বসেছেন অনেকেই।

নাজিরগঞ্জ বাজারের ব্যবসায়ী কেরামত আলী ব্যাপারী বলেন, ব্যবসা দেখাশোনার জন্য ছোটভাই রহমতকে দোকানে বসিয়েছিলাম। অনলাইন জুয়া এজেন্টদের খপ্পরে পড়ে সে। গত দুই বছরে দোকানের ক্যাশ নষ্ট করার পাশাপাশি বিভিন্ন এনজিও থেকে চড়া সুদে ঋণ নিয়েছে প্রায় ২৫ লক্ষ টাকার মতো। ঋণ আমার পরিবারের কাঁধে। দিনে দিনে জমি বিক্রি করে তাদের দেনা শোধ করেছি। এখন আমি নিঃস্ব।

একই গ্রামের রবিউল মোল্লা বলেন, আমার বড় ভাই ইসা মোল্লাকে স্থানীয় মোবাইল ব্যাংকিং এজেন্ট শীতল অনলাইন জুয়ার ফাঁদে ফেলে। খেলায় হেরে তার আয়ের সম্বল সিএনজি অটোরিকশা বিক্রি করে এখন বেকার হয়ে পড়েছেন। অথচ এজেন্টরা বহাল তবিয়তে। পুলিশ সব জেনেও কোন ব্যবস্থা নিচ্ছে না।

অন্যদিকে অনলাইন জুয়ার বিষয়ে তেমন অভিযোগ না থাকায় ব্যবস্থা নেওয়া যায়নি বলে দাবি করছেন সুজানগর থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা জালাল উদ্দিন। তিনি বলেন, ‘রাসেল মন্ডলের মায়ের অভিযোগের বিষয়টি তদন্ত চলছে। তদন্ত কর্মকর্তার গাফিলতি আছে কিনা তাও খতিয়ে দেখা হবে।’

কেবল সুজানগরই নয় পাবনার ১০টি থানার প্রত্যন্ত গ্রামাঞ্চলে ছড়িয়ে পড়েছে অনলাইন জুয়া। সক্রিয় অন্তত দুই শতাধিক এজেন্ট। বেটিং সাইটের এজেন্টরা প্রবাসী, অবস্থাপন্ন পরিবারের তরুণদের টার্গেট করে জুয়ার ফাঁদে ফেলে যুক্ত করছে নানা অপরাধে। বিদেশে অর্থ পাচার ও সাধারণ মানুষকে সর্বস্বান্ত করার এমন কার্যক্রম প্রকাশ্যে চললেও, তৎপরতা নেই আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর।

জেলা দুর্নীতি প্রতিরোধ কমিটির সদস্য উৎপল মির্জা বলেন, অনলাইন জুয়ায় তরুণ সমাজ নষ্ট হওয়ার পাশাপাশি মোবাইল ব্যাংকিংয়ের মাধ্যমে কোটি কোটি টাকা বিদেশে পাচার হয়ে যাচ্ছে। অভিযোগ না থাকার অজুহাতে আইন শৃংখলা বাহিনীর নিষ্ক্রিয় থাকার কোন সুযোগ আছে বলে আমি মনে করিনা।

পাবনার পুলিশ সুপার আব্দুল আহাদ বলেন, আমি সদ্য যোগদান করেছি। এ বিষয়ে খোঁজ নিয়ে আইনগত ব্যবস্থা নেওয়া হবে।