ফুটপাত তাদের আপন ঠিকানা

  • মেহেদী হাছান মাহীম, বার্তা২৪.কম, ঢাকা
  • |
  • Font increase
  • Font Decrease

ছবি: ঠিকানা না থাকায় ফুটপাতকেই আশ্রয় করে নিয়েছেন তারা/বার্তা২৪.কম

ছবি: ঠিকানা না থাকায় ফুটপাতকেই আশ্রয় করে নিয়েছেন তারা/বার্তা২৪.কম

গত ১৫ বছর ধরে রাজধানী খিলগাঁও এলাকার ফুটপাতে বসবাস করে আসছেন পঞ্চাশোর্ধ মনোয়ারা বেগম। দুর্ঘটনায় পঙ্গু স্বামী হযরত আলীর ভরণপোষণ ও নিজের জীবিকা নির্বাহের জন্য তিনি অন্যের বাড়িতে কাজ করেন। নিজের থাকার ঠিকানা না থাকায় ফুটপাতকেই আশ্রয় করে নিয়েছেন এই অসহায় নারী।

মনোয়ারার মতো এক টুকরো আপন ঠিকানার খোঁজে ঘুরতে ঘুরতে এই ফুটপাতে ঠাই হয়েছে মো. ফাহিমের। ছোটবেলায় বাবা-মা হারিয়ে এখন একা বসবাস করছে সে।

বিজ্ঞাপন

মনোয়ারা এবং ফাহিমের মতো প্রায় ৫৩টি পরিবার বাস করছে খিলগাঁও এলাকার আনসার ও ভিডিপি সদর দপ্তর সংলগ্ন এ ফুটপাতে। তবে বসবাসের স্থান পেলেও সরকারের সামাজিক নিরাপত্তা বেষ্টনীর সুযোগ সুবিধা মেলে না এসব পরিবারের সদস্যদের। জীর্ণশীর্ণ স্যাঁতস্যাঁতে পরিবেশে বসবাস তাদের। অভাব অনটন আর দারিদ্রে একপ্রকার এক ঘরে অবস্থা সেখানকার দুই শতাধিক মানুষের।

ফুটপাতে গড়ে ওঠা এই বস্তির উপার্জনক্ষম ব্যক্তিরা আয় করেন ভ্যান ও রিকশা চালিয়ে। নারীরা করেন অন্যের বাড়িতে ঝিয়ের কাজ। ফলে একদিকে যেমন তিন বেলা খাবার ঠিকমতো মেলে না তাদের, অন্যদিকে কেউ অসুস্থ হলে মেলে না পর্যাপ্ত চিকিৎসা সেবা। এতে নানা স্বাস্থ্য ঝুঁকিতে পড়ছে সেখানকার বাসিন্দারা।

বিজ্ঞাপন

দীর্ঘদিনে ধরে এখানে বসবাস করলেও ঢাকার ভোটার না হওয়ায় সিটি করপোরেশনের বিভিন্ন সুযোগ সুবিধা থেকে বঞ্চিত তারা। শিশুরাও আছে নানা ঝুঁকিতে, পুষ্টিহীনতার পাশাপাশি শিক্ষার আলো থেকেও বঞ্চিত তারা। বাবা-মায়ের টানাপড়েনের সংসারের হাল ধরতে কম বয়সেই বিভিন্ন কর্মে যুক্ত হচ্ছে অনেকেই।

নির্দিষ্ট স্থানে পুনর্বাসনের ব্যবস্থার দাবি জানিয়ে এখানকার বাসিন্দারা বলেন, "আমরা গরিব মানুষ, ফ্ল্যাট-বাসায় থাকার মতো টাকা আমাদের নেই। খুব কষ্টে দিন পার করতেছি। দিন এনে দিন খাচ্ছি। একটু বৃষ্টি হলেই আমাদের এই ভাঙাচোরা ঘরে পানি ঢুকে যায়। এতে করে থাকতে অনেক অসুবিধা হয়। তাই সরকার যদি আমাদেরকে নির্দিষ্ট একটি স্থানে থাকার ব্যবস্থা করে দেয় তাহলে অনেক ভালো হবে।

তারা আরও বলেন, আমরা দীর্ঘ ২০ থেকে ২৫ বছর ধরে এখানে বসবাস করে আসছি। ঢাকার ভোটার না হওয়ার কারণে আমরা ভাতাসহ বিভিন্ন সুযোগ সুবিধা পাই না। আমরা পরিবার চালাতে হিমশিম খাচ্ছি। তাই সন্তানদেরকে পড়াশোনার পরিবর্তে বিভিন্ন কাজে দিয়ে দিতে হচ্ছে। সন্তানরা অসুস্থ হলে ভালো চিকিৎসাও করাতে পারছে না বলে জানান তারা।

ফুটপাতে বসবাস করা বাসিন্দাদেরকে সিটি করপোরেশনের পক্ষ থেকে কোনো ধরনের সাহায্য সহযোগিতা করা হয় কিনা এবিষয়ে জানতে চাইলে ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের ১নং ওয়ার্ডের কাউন্সিলর মাহবুবুল আলম বার্তা২৪.কমকে বলেন, দীর্ঘদিন ধরে ফুটপাতে এরা বসবাস করে আসছে। আমরা বিভিন্নসময় এদেরকে সাহায্য সহযোগিতা করে আসছি। করোনার সময়ও এখানকার বাসিন্দাদেরকে সাহায্য করেছি।

ফুটপাতে বসবাস করা বাসিন্দাদেরকে পুনর্বাসনের বিষয়ে সিটি করপোরেশনের কোনো পরিকল্পনা আছে কিনা জানতে চাইলে এই কাউন্সিলর বলেন, সিটি করপোরেশনের ১নম্বর ওয়ার্ড গণপূর্ত মন্ত্রণালয়ের অধীনে রয়েছে। সেজন্য এদেরকে সিটি করপোরেশন চাইলেও পুনর্বাসন করতে পারবে না। যদি পুনর্বাসন করতে হয় তাহলে সেটা গণপূর্ত মন্ত্রণালয় করতে পারবে।

এবিষয়ে বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব প্ল্যানার্সের (বিআইপি) সভাপতি এবং নগর পরিকল্পনাবিদ ড. আদিল মুহাম্মদ খান বার্তা২৪.কমকে বলেন, সিটি করপোরেশনের ২০০৯ সালের স্থানীয় সরকার যে আইন রয়েছে সেখানে সিটি করপোরেশন চাইলে যেকোনো ডেভেলপমেন্ট উদ্যোগ নিতে পারবে। এক্ষেত্রে সিটি করপোরেশন সরকারের অন্য সংস্থার সাথে সমন্বয় করে নিতে পারবে। গণপূর্ত সরকারেরই অংশ। সিটি করপোরেশন উদ্যোগ নিয়ে গণপূর্ত মন্ত্রণালয়ে যদি পুরো বিষয়টা নিয়ে যদি তাদের সাথে কথা বলে সিটি করপোরেশনের মাধ্যমে সেটি করা সম্ভব।

তিনি বলেন, আবাসন হচ্ছে মানুষের মৌলিক অধিকার। আমাদের সংবিধানে যতগুলো মৌলিক অধিকারের কথা বলা হয়েছে তার মধ্যে আবাসনও একটি। আবাসনের দায়িত্ব সরকার যদিও পুরোপুরি ভাবে নেয় না। কিন্তু, যারা সুবিধাবঞ্চিত তাদের দায়িত্ব সরকারের ওপরেই থাকে। সেজন্য সরকারের উচিত যারা সুবিধাবঞ্চিত তাদের জন্য আবাসন তৈরি করা।

তিনি আরও বলেন, ঢাকা শহরে ফুটপাতে যারা বসবাস করছে তারা সুবিধাবঞ্চিত। এসব সুবিধা বঞ্চিত মানুষদের জন্য আবাসনের ব্যবস্থা করা উচিত। ফুটপাতে বসবাস করা পরিবারগুলোর মধ্যে যে শিশুরা রয়েছে তারা আবাসনে বসবাস করতে পারলে উন্নত জাতির অংশ হবে। তাদের আবাসন করতে গেলে সরকারের যে ধরনের প্ল্যান দরকার সেটির পরিমাণ খুবই কম। অল্প কয়েকদিন আগে সরকার গ্রামীণ এলাকাগুলোতে আবাসনের প্রকল্প নিয়েছে। তবে ঢাকা শহরসহ অন্যান্য শহরের ফুটপাতে যেসব সুবিধাবঞ্চিত মানুষ বাস করে তাদের জন্য এরকম আবাসনের প্রকল্প গ্রহণ করা উচিত।

এই নগর পরিকল্পনাবিদ বলেন, সরকারের কমফোর্টেবল প্ল্যানে প্রায় ৫০টার মতো লোকেশন চিহ্নিত করা হয়েছে। তবে এগুলোকে প্রকল্প আকারে নিয়ে এখন থেকে কাজ করা উচিত। সরকারের প্রয়োজনে প্রাইভেট সেক্টরদের সাথে নিয়ে আবাসনের জন্য কাজ করা উচিত। আবাসন না হলে ডেভেলপমেন্ট কখনোই হবে না।

তিনি বলেন, শিক্ষার আগে প্রথমে আবাসন আসে। এজন্য সরকারের উচিত নগরে যে সকল সুবিধা বঞ্চিত হতদরিদ্র লোক বাস করে তাদের জন্য আবাসনের ব্যবস্থা করা। তাদের জন্য পার্মানেন্ট এবং অন্তর্বর্তীকালীন ব্যবস্থা নেওয়া উচিত। এক্ষেত্রে সরকার যদি প্রায়োরিটি দেয় তাহলে করা সম্ভব।