গাইবান্ধায় নিখোঁজ ৩ শ্রমিকের সন্ধান মেলেনি ৭ দিনেও, পরিবারে শোকের মাতম

  • মাসুম বিল্লাহ, ডিস্ট্রিক্ট করেসপন্ডেন্ট, বার্তা২৪.কম, গাইবান্ধা
  • |
  • Font increase
  • Font Decrease

ছবি: নিখোঁজ শ্রমিকেদের পরিবার

ছবি: নিখোঁজ শ্রমিকেদের পরিবার

গাইবান্ধার সুন্দরগঞ্জে পানি উন্নয়ন বোর্ডের ব্লক ফেলতে গিয়ে নৌকা ডুবে তিন শ্রমিক নিখোঁজের এক সপ্তাহ পার হলেও তাদের কারও খোঁজ মেলেনি। দফায় দফায় উদ্ধার তৎপরতা চালিয়েও সন্ধান মিলছেনা তাদের। খোঁজ পাওয়া যায়নি নদীর দূর প্রান্তে ভেসে যাওয়া কোনও লাশ হিসেবেও। লাশের সন্ধান না পেয়ে নিখোঁজ শ্রমিকদের পরিবারে চলছে শোকের মাতম। জীবন্ত তো পাওয়ার আশা নেই, অন্তত মরদেহটি পেলে বাড়ির পাশে কবর দিয়ে স্মৃতিটুকু বাঁচিয়ে রাখার নিশ্চয়তাও যেন ফুরিয়ে যাচ্ছে পরিবারগুলোর। যে কোনও মূল্যে অন্তত লাশটির সন্ধান চান তারা।

গত ২৭ জুন শনিবার বেলা সাড়ে ১২ টার দিকে সুন্দরগঞ্জ উপজেলার দক্ষিণ শ্রীপুর ইউনিয়নের গোয়ালবাড়ি নামক এলাকায় পানি উন্নয়ন বোর্ডের "শ্রীপুর-২" নামের প্রকল্পের ব্লক ফেলতে গিয়ে একটি নৌকা ডুবির ঘটনা ঘটে। সে সময় ঘটনাস্থলে থাকা সুন্দরগঞ্জ উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা তরিকুল ইসলাম মোবাইল ফোনে জানান, উপজেলার বাবুর বাজার এলাকায় বাঁধে পানি উন্নয়ন বোর্ডের ব্লক বসানোর কাজ চলছিল। বিকেলে হঠাৎ সেই ব্লক বাঁধ সংলগ্ন নদীতে থাকা একটি নৌকায় এসে পড়ে। তৎক্ষনাৎ নৌকাটি ডুবে যায়। এতে আহত হয়েছেন অন্তত পাঁচ থেকে সাতজন। ডুবে যাওয়া নৌকা থেকে সবাই উঠতে পারলেও শেষ পর্যন্ত দুই শ্রমিককে খুঁজে পাওয়া যায়নি।

বিজ্ঞাপন

তবে, পরে সরজমিনে স্থানীয়রা ও প্রত্যক্ষদর্শী সূত্রে জানা যায়, নদীর বাঁধে নয়, নৌকায় করে ব্লক ফেলানো হচ্ছিল নদীতে। এছাড়া দুজন নয়, নিখোঁজ হয়েছেন তিন শ্রমিক। সেদিন কংক্রিটের ৫০০টি ব্লক নৌকায় নিয়ে শ্রমিক সরদারসহ ২৮ জন শ্রমিক নদীতে ব্লক ফেলানোর কাজ শুরু করা মাত্রই নৌকা ফেটে নিমিষেই তলিয়ে যায়। এসময় নৌকায় স্তুপ করে নেওয়া কংক্রিটের ব্লকগুলো হুরমুর করে শ্রমিকদের শরীরে এসে পড়ে কারো মাথা ফেটে যায়, কারো হাত ভাঙ্গে, কারো পা।


পরে স্থানীয়দের সহায়তায় শ্রমিকদের সবাই উঠে আসলেও নিখোঁজ হয় আতোয়ার হোসেন (৩০), আব্দুর রশিদ (৩৫) ও রাজু (৪০) নামের তিন শ্রমিক। একই সময় মারাত্মক আহত হন ১১ জন। যারা সর্বোচ্চ ৫ দিন পর্যন্ত হাসপাতালে ভর্তি থেকে চিকিৎসা নিয়েছেন। এছাড়া আরও ১৩ শ্রমিক শরীরের বিভিন্ন অঙে ছেঁলা-ফোলা জখমের শিকার হন।

বিজ্ঞাপন

নিখোঁজ তিন শ্রমিকের মধ্যে আতোয়ার হোসেন সদর উপজেলার গিদারী ইউনিয়নের দক্ষিণ বাগুরিয়া গ্রামের মুত আব্দুল কাদেরে ছেলে। এছাড়া আব্দুর রশিদ একই ইউনিয়নের একই গ্রামের মো.জোব্বার মিয়ার ছেলে। অপরজন রাজু মিয়া ওই ইউনিয়নের পশ্চিম বাগুরিয়া এলাকার মো.তোফাজ্জাল হোসেনের ছেলে।

এছাড়া মারাত্মক চোট পাওয়া শ্রমিকরা হলেন, মুকুল, রুবেল মানিক, বিশ্বনাথ, শাহআলম, নূরআলম, মজিদ, খাইরুল ও আব্দুর রশিদ-২। এসব আহত শ্রমিকদের কারো মাথা ফেটেছে, কারা ভেঙ্গেছে হাত, কারো পা।

পরে নিখোঁজ এই তিন শ্রমিকের সন্ধানে পরদিন (রোববার) সকাল ৯ টায় আনুষ্ঠানিকভাবে উদ্ধার কাজ শুরু করে রংপুর থেকে আসা ছয় সদস্যের ডুবুরি দল। ওইদিন সকাল নয়টা থেকে সন্ধ্যা সাতটা পর্যন্ত ১০ ঘণ্টা উদ্ধার তৎপরতা চালালেও সন্ধান মেলেনি নিখোঁজ শ্রমিকদের। তবে সেদিন তলিয়ে যাওয়া স্থানের কাছেই শতাধিক ফুট পানির নিচে ডুবে যাওয়া নৌকাটির সন্ধান পায় তারা। সেখানে ডুবে থাকা নৌকাটির সাথে দঁড়ি বেঁধে পানির উপর ড্রাম রেখে চিহ্নিত করে রাখা হয়। ঘটনাস্থলে সর্বশেষ গত ৩১ জুন উদ্ধার তৎপরতা চালায় বিআইডব্লিউটিএর ডুবুরি দল। তাতেও নিখোঁজদের সন্ধান মেলেনি।

এদিকে, সরেজমিনে গিদারী ইউনিয়নের নিহতদের বাড়িতে গিয়ে দেখা যায়, প্রত্যেক বাড়িতেই শোকে বিহবল তাদের পরিবার। প্রতিবেদকের সাথে কথা বলতেই কেঁদে ওঠেন তারা। নিহতদের পরিবারের দাবি অন্তত তাদের নিখোঁজ স্বজনের মৃতদেহটা যেন পান তারা। সেজন্য সংশ্লিষ্ট সকলের কাছে করুণ আবেদন জানিয়েছে পরিবারের সদস্যরা। এছাড়া নিখোঁজ শ্রমিকদের প্রত্যেকের অর্থনৈতিক অবস্থা খারাপের কথা জানায় নিহতদের স্ত্রী-স্বজনরা। এসময় তারা যাদের কাজ করতে গিয়ে শ্রমিকরা নিখোঁজ হয়েছেন তাদের কাছে পরিবারের জন্য আর্থিক নিরাপত্তার দাবি জানান।

নিহত শ্রমিকদের মধ্যে আতোয়ারের পরিবারে স্ত্রীসহ ১৩ বছর বয়সী ছেলে ইয়াসিন ও মরিয়ম নামের ৭ বছর বয়সী একটি মেয়ে রয়েছে। রাজুর পরিবারে রয়েছে স্ত্রীসহ হাবিব (১৫) ও রাব্বি (১০) নামের দুই সন্তান। এছাড়া রশিদের পরিবারে স্ত্রীসহ ইয়াসিন নামের ৫ বছর বয়সী একটি সন্তান রয়েছে। এই তিন পরিবারের মধ্যে রাজুর সাংসারিক অবস্থা অত্যন্ত নাজুক

অন্যদিকে একইদিন সরজমিনে আহতদের বাড়িতে গিয়ে দেখা যায় ভাল নেই আহতরাও। আহতদের মধ্যে পাঁচদিন হাসপাতালে থেকে এদিন (বৃহস্পতিবার) বাড়ি ফিরেছে আহত শ্রমিক মুকুল (৪৫)। ব্লক পড়ে মুকুলের বাম পায়ের গোড়ালি খসে গেছে। কাটা ছেঁড়া করে বেশ কয়েকটি সেলাই দেওয়া হয়েছে পায়ে। এছাড়া মুকুলের শরীরের বিভিন্ন অংশে ক্ষত চিহ্ন স্বাক্ষ্য দিচ্ছে সেদিন কতটা ভয়াবহ দুর্ঘটনার কবলে পড়েছিল শ্রমিকরা।

আহত শ্রমিক মুকুল বার্তা২৪.কমকে জানান, সেদিন আমরা ২৮ জন শ্রমিক ৫০০টি ব্লক নৌকায় করে নিয়ে যাই। যখন একটি ব্লক নদীতে ফেলানো হয়েছে তখনই বিকট শব্দ হয়ে নৌকাটি তলিয়ে যায়। আর তখন সব ব্লক গড়ে পরে আমাদের গায়ের উপর। এসময় শ্রমিকদের কারো মাথা ফাটে, কারো হাত ছিলে যায়। সবারই কোননা কোনো ভাবে ক্ষতি হয়। সেদিন ভরা নদীতে প্রবল স্রোতে ব্লক ফেলাতে গিয়ে নৌকা তলিয়ে যায়।

গাইবান্ধা পানি উন্নয়ন বোর্ডের সংশ্লিষ্ট প্রকল্পের উপ-সহকারী প্রকৌশলী মোহন মোবাইল ফোনে বার্তা২৪.কমকে বলেন, " তিনদিন আগে সর্বশেষ বিআইডব্লিউটিএর ঢাকার একটি দল এসে উদ্ধার কার্যক্রম চালিয়েছিল। কিন্ত নিখোঁজদের সন্ধান পায়নি। এ সময় জানতে চেয়ে এক প্রশ্নের উত্তরে কথা বলতে না চেয়ে তিনি বলেন" ওই সব বিষয় নিয়ে আপনি স্যারের সাথে কথা বলেন"।

এসব ব্যাপারে গাইবান্ধা পানি উন্নয়ন বোর্ডের নির্বাহী প্রকৌশলী হাফিজুল হক ও সংশ্লিষ্ট কাজের ঠিকাদার শাহরিয়ারের মোবাইল নম্বরে একাধিকবার কল করলেও তারা রিসিভ করেননি।